বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষ
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ ও কতিপয় অভ্যন্তরীণ নৌপথের উন্নয়ন, রক্ষণাবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে গঠিত একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা। বাংলাদেশের অভ্যন্তরভাগে নদ-নদী, শাখা নদী, খাল-হাওর মিলিয়ে যে প্রায় চবিবশ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ নৌ-যোগাযোগ নেটওয়ার্ক রয়েছে সেগুলির তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব এই কর্তৃপক্ষের। বর্তমানে (২০০৯ সালে) বাংলাদেশে বর্ষা মৌসুমে নাব্য নদীপথ রয়েছে ৬ হাজার কিলোমিটার। তবে রাতে যান্ত্রিক নৌযান চলাচলের সুবিধা রয়েছে মাত্র প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার নৌপথে। শুষ্ক মৌসুমে নদীপথের নাব্যতা হ্রাস পাওয়ায় নৌপথের দৈর্ঘ্য তিন হাজার আটশত কিলোমিটারে নেমে আসে। অথচ ১৯৭২ সালে দেশে নাব্য নৌপথ ছিল ১২ হাজার কিলোমিটার। ১৯৭৪ সালে নৌপথে ১৬ শতাংশ যাত্রী এবং ৩৭ শতাংশ মালামাল পরিবহণ করা হয়েছিল। ১৯৯৪ সালে পরিচালিত একটি সরকারি সমীক্ষা অনুযায়ী দেখা যায় অভ্যন্তরীণ যান্ত্রিক নৌযান বছরে শতকরা ১৩ ভাগ যাত্রী ও ৩২ শতাংশ মালামাল পরিবহণ করে। এর পাশাপাশি দেশের ৮ লক্ষ ৯০ হাজার দেশি নৌকায় বছরে প্রায় ১২ লাখ টন মালপত্র পরিবহণ করে। এই হার দিনদিন হ্রাস পাচ্ছে। ২০০৬ সালে যাত্রী ও পণ্য পরিবহণের হার ছিল যথাক্রমে ৬% ও ২৭%।
সরকারি রেকর্ডপত্রে দেখা যায়, পূর্ববঙ্গের নৌপথে সর্বপ্রথম যান্ত্রিক নৌযান চলাচলের সূচনা ঘটে ১৮৪৪ সনের ৬ ফেব্রুয়ারি তারিখে। বৃটিশ আমলে দুটি কোম্পানির নৌযানে ৭০% যাত্রী ও মালামাল পরিবহণ হতো। ১৯৫৮ সালে একটি অধ্যাদেশবলে গঠিত পূর্ব পাকিস্তান অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষের উত্তরাধিকার হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের বিআইডব্লিউটিএ। সূচনালগ্নে বিআইডব্লিউটিএ যে কয়েকটি বিভাগের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল সেগুলি হলো ট্রাফিক, কনজার্ভেন্সি ওপাইলটেজ নৌপথ-বন্দর প্রকৌশল এবং হিসাব ও প্রশাসন বিভাগ। ১৯৫৮ সালে মাত্র ৩৭ কর্মকর্তা নিয়ে ইপিআইডব্লিউটি-এর কার্যক্রম শুরু হয়। পরে দেশে পাঁচটি নদীবন্দর প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯৬৩ সালে এই কর্তৃপক্ষের পকিল্পনা বিভাগ গঠিত হয় এবং পরের বছর বন্দর পরিদপ্তর গড়ে তোলা হয়। বর্তমানে (২০০৯ সালে) আইডব্লিউটি-এর রয়েছে মোট ১৪টি বিভাগ, একটি করে ওয়ার্কশপ এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এর মোট কর্মকর্তাকর্মচারীর সংখ্যা ৪২৮৭।
বিআইডব্লিউটিএ-র প্রধান নির্বাহী হচ্ছেন একজন চেয়ারম্যান। তাকে সহযোগিতা করেন দুজন সদস্য। এরাই বিভাগুলির দায়িত্বে নিয়োজিত পরিচালকদের নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। বিআইডব্লিউটিএ-র কার্যাবলি মোটামুটিভাবে দুইভাগে ভাগে বিভক্ত উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রণমূলক কার্যাবলি। প্রথম শ্রেণির কার্যাবলির মধ্যে রয়েছে নাব্যতা রক্ষার জন্য নৌপথ সংরক্ষণ ও নদীশাসন অর্থাৎ সংরক্ষণের কাজ, হাইড্রোগ্রাফি জরীপ, নাবিক প্রশিক্ষণ, আবহাওয়া ও নৌচালনা সম্পর্কিত তথ্য প্রদান, পাইলটেজ ও হাইড্রোগ্রাফিক সার্ভিস প্রদান, নতুন নৌপথ উন্নয়নসহ পুরাতন নৌপথের খননকার্য সম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রণয়ণ ও বাস্তবায়ন, অভ্যন্তরীণ নদীবন্দর ও টার্মিনালগুলির উন্নয়ন, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা, পল্লী অঞ্চলের নৌপরিবহণ ব্যবস্থার উন্নয়ন, নৌযানের ডিজাইন, নৌপথে মালামাল ভাসিয়ে টেনে আনা, পণ্য নামানো ও টার্মিনাল সুবিধা ও বন্দরের স্থাপনাসমূহ সম্পর্কে গবেষণা করা, সরকারের সাথে যোগসূত্র রক্ষা এবং সার্বিকভাবে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণের উন্নয়ন করা। বিআইডব্লিউটিএ-র নিয়ন্ত্রমূলক কার্যাবলির মধ্যে রয়েছে অভ্যন্তরীণ রুটে চলাচলকারী নৌযানগুলির যাত্রী ও মালপত্রের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন ভাড়া নির্ধারণ এবং ১৮৬ রুটে চলাচলকারী ৬৪৬টি যাত্রীবাহী লঞ্চের সময়সূচি অনুমোদন করা। ২০০০ সালে দেশে ২০০টি রুটে ৭৩৯টি নৌযান চলাচল করত। বর্তমানে (২০০৯ সালে) বছরে প্রায় ৯০ মিলিয়ন যাত্রী এবং ২০ মিলিয়ন টন পণ্য নৌপথে পরিবহণ করা হয়।
বিআইডব্লিউটিএ দেশের ২১টি নদীবন্দর এবং ৩৮০টি লঞ্চঘাট ও টার্মিনাল রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা করে থাকে। নদীবন্দরগুলি হচ্ছে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর, বরিশাল, খুলনা, পটুয়াখালী, বাঘাবাড়ী, টঙ্গী, মাওয়া, নরসিংদী, আরিচা, নগরবাড়ী, দৌলতদিয়া, চরজানাজাত, আশুগঞ্জ-ভৈরববাজার, ভোলা, বরগুনা, নওয়াপাড়া, মীরকাদিম, মেঘনাঘাট ও ছাতক। অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তর্ৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় যে ৯টি ফেরিঘাট পরিচালিত হয় সেগুলি হচ্ছে পাটুরিয়া, দৌলতদিয়া. মাওয়া, চরজানাজাত, মঙ্গলমাঝি, চাঁদপুর, শরিয়তপুর, ভোলা এবং লক্ষ্মীপুর। বিআইডব্লিউটিএ-র রয়েছে ৪৭৫টি বার্জ, পন্টুন ও ফ্লাট এবং ৮৬টি নৌযান; এগুলির মধ্যে রয়েছে ৭টি ড্রেজার, ৩টি উপকূলীয় সার্ভে জাহাজ, পরিদর্শন ও সমীক্ষার কাজে ব্যবহারের জন্য ১০টি লঞ্চ ও ১৯টি ওয়ার্কবোট, ২টি টাগ শিপ, ২টি উদ্ধারকারী ইউনিট, একটি প্রশিক্ষণ জাহাজ এবং ৩টি হাউজবোট। বিআইডব্লিউটিএ প্রতিবছর উপকূলে এক হাজার কিলোমিটার এবং তিন হাজার কিলোমিটার অভ্যন্তরীণ নৌপথ সার্ভে করে থাকে। এছাড়া এর বাৎসরিক খননকাজের পরিমাণ প্রায় ৫০ লক্ষ ঘনমিটার।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষ ১৯৪৮ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ১৩৭টি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। ২০০৯-২০১০ অর্থবছরে ১০টি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিআইডব্লিউটিএ-র কার্যক্রম জোরদার করার পাশপাশি বুড়িগঙ্গার তীর দখলমুক্ত করা এবং ঢাকা নগরীর চারদিকে বৃত্তাকার নৌপথ চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ সকল স্কিমের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল নদীবন্দর, ফেরিঘাট ও লঞ্চঘাটের প্রয়োজনীয় সুবিধাবৃদ্ধি ও উন্নয়ন, সমীক্ষা পরিচালনা এবং নদীখনন। এই কর্তৃপক্ষ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ সেক্টরের সুবিধাকে প্রাধান্য দিয়ে ১৯৭১ সালে নারায়ণগঞ্জে প্রতিষ্ঠা করে দেশের একমাত্র মেরিন ইনস্টিটিউট। ডেক পারসোনাল ট্রেনিং সেন্টার নামক এই প্রতিষ্ঠানটিতে ৭টি কোর্স চালু রয়েছে। এক বছর মেয়াদি শিক্ষানবিশ কোর্সের পাশাপশি এই কেন্দ্রটি বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্পোরেশন এবং সশস্ত্র বাহিনীর ডেককর্মীদের জন্য বাকি কোর্সগুলি পরিচালনা করে। এই কোর্সগুলির মেয়াদ তিন মাস করে। বিআইডব্লিউউটিএ-র মেরিন ওয়ার্কশপটি বরিশালে ১৯৬০ সালে স্থাপিত হয়। তৎকালীন পশ্চিম জার্মান সরকারের অর্থানুকূল্যে প্রতিষ্ঠিত এই ওয়ার্কশপে বিআইডব্লিউটিএ-র অধীন নৌযান ও পন্টুন নির্মাণ এবং ড্রেজার বহর ও পন্টুনের মেরামত করা হয়ে থাকে। এছাড়া এখানে অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি সংস্থাসমূহের নৌযান তৈরি এবং মেরামতের কাজও হয়ে থাকে।
[মাহবুবুল আলম]