পাট কার্পেট
পাট কার্পেট বাংলাদেশের পাটকলে উৎপাদিত প্রধান তিনটি পণ্যের একটি। অন্য দুটি হচ্ছে চট এবং বস্তা। কাগজের ব্যাগের ব্যবহার ব্যাপক মাত্রায় বৃদ্ধির ফলে মোড়কজাতীয় পণ্য হিসেবে পাটের তৈরি বস্তার চাহিদা অতিমাত্রায় কমে যায় এবং এর ফলে পাট থেকে বিপুল পরিমাণে কার্পেট উৎপাদন শুরু হয়। ১৯৫১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে কার্পেট তৈরির কাজে ৬৭৪টি এন্টারপ্রাইজ ছিল এবং এগুলির মধ্যে ৩টি বিদ্যুৎ শক্তিতে পরিচালিত হতো। কার্পেট তৈরির কাজ মূলত কুটির শিল্পের আওতাভুক্ত। উনিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে সরকার কিছু পাটকল প্রতিষ্ঠা করে এবং ১৯৫৫-৫৬ সালে এই পাটকলগুলি ১,৩০,০০০ মেট্রিক টন পাটের গাঁট বাঁধে এবং এর পরিমাণ ১৯৬৯-৭০ সালে বৃদ্ধি পেয়ে ৫,৬১,০০০ মেট্রিক টন হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই মিলগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ১৯৭২-৭৩ সালে উৎপাদন কমে ৩,১৫,০০০ মেট্রিক টনে নেমে আসে। ১৯৮১-৮২ সালে পাটকলগুলির সংস্কারের ফলে পুনরায় এগুলির উৎপাদন ৫,৭৭,৪৫৮ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়। কিছুসংখ্যক পাটকলের স্যাকিং লুমকে কার্পেট লুমে রূপান্তর করা হয়। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট ৬৫,১০০ মেট্রিক টন ক্ষমতাসম্পন্ন সাতটি কার্পেট মিল ছিল। পরবর্তীকালে কিছু নতুন মিল প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং ১৯৯৮ সালে এ মিলগুলির কার্পেট উৎপাদনের মাত্রা ছিল ৪২,৫৮১ মেট্রিক টন।
১৯৮০ সালের পূর্বে প্রতিষ্ঠিত সাতটি কার্পেট মিলের মধ্যে ২টি স্থানীয় ব্যক্তিখাতে, ৩টি রাষ্ট্রীয় খাতে এবং অবশিষ্ট ২টি ইরাকের ঋণ সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ সরকার কার্পেটসহ প্রধান প্রধান পাটজাত সামগ্রী উৎপাদনে নিয়োজিত পাটকলগুলিকে সহায়তা করার জন্য জুট সেক্টর অ্যাডজাস্টমেন্ট রিফর্ম প্রোগ্রাম নামে একটি কর্মসূচি গ্রহণ করে। এ কর্মসূচিতে পাটকলগুলিকে বিরাষ্ট্রীয়করণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়, তবে ২০০১ সাল পর্যন্ত খুব অল্পসংখ্যককেই ব্যক্তিখাতে সমর্পণ করা সম্ভব হয়। পাকিস্তান আমলে পাট শিল্পগুলি তাদের উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি-বোনাসের মাধ্যমে ভর্তুকি প্রদান করে উৎপাদনব্যয় অপেক্ষা কমমূল্যে বিক্রয় করতো।
ভর্তুকি প্রদানে দুটি শর্ত বিবেচনা করা হয়: এক, চাকরি সৃষ্টি এবং দুই, বৈদেশিক মুদ্রা আয়। উৎপাদকরা ১৯৬৯-৭০ সালে কার্পেট রপ্তানির জন্য প্রতি টনে ১,৩৪৫ টাকা হারে বোনাস সুবিধা গ্রহণ করে। সত্তরের দশকে মোট বিক্রয়ের শতকরা ১১ ভাগ বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশন (BJMC) সম্পন্ন করে। ১৯৮০ দশকের শুরু থেকে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাজারে কার্পেটের উৎপাদন ও বিক্রয়ে গতিশীলতা আসে এবং প্রাক্কলন অনুযায়ী ১৯৮৫ সালে ৫৩,৪৫৮ মেট্রিক টন কার্পেট উৎপাদিত হয়। এই উৎপাদনের মাত্র ১৫৮ মেট্রিক টন অভ্যন্তরীণ বাজারে বিক্রয় হয় এবং অবশিষ্টাংশ বিদেশে রপ্তানি হয়। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাজারের মধ্যে বিক্রয় মূল্যের তেমন পার্থক্য ছিল না। টনপ্রতি অভ্যন্তরীণ বিক্রয় মূল্য ছিল ২৩,১৭১ টাকা এবং রপ্তানি মূল্য ২৩,৮৭৪ টাকা। ১৯৮৩ সালে বিজেএমসি-এর নিয়ন্ত্রণাধীন মিলগুলি ৭১,৮৪১ টন কার্পেট মোট ১.৮৯ বিলিয়ন টাকায় রপ্তানি করে। তবে তুলনামূলক উচ্চ মূল্যের কারণে সিনথেটিক কার্পেটের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ধীরে ধীরে বাজার হারাতে শুরু করে পাট কার্পেট। বর্তমানে বাংলাদেশের বেসরকারি পাট কলগুলিতে আর মেশিনের সাহায্যে কার্পেট তৈরি করা হয় না। বিজেএমসির নিয়ন্ত্রাধীন পাটকলগুলিতেও উৎপাদনের পরিমাণ কমছে, ২০০৫ সালে তারা মাত্র ২০ হাজার টন পাট কার্পেট উৎপাদন করে।
কার্পেট একটি মূল্য-সংযোজন শিল্প। কার্পেট উৎপাদনে মোট উৎপাদন ব্যয়ের প্রায় শতকরা ৪৪ ভাগ দ্রব্য ব্যয় এবং ৩৮ ভাগ রূপান্তর ব্যয়। ব্যয় কাঠামোতে শতকরা ৪১ ভাগ কাঁচা পাট, অন্যান্য প্রত্যক্ষ মাল ২.৭ ভাগ, ক্ষয়ক্ষতি ২০.২ ভাগ, বেতন ৩.৪ ভাগ, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ ৬.৬ ভাগ, জ্বালানি ও শক্তি ৪.৩ ভাগ, প্রশাসন ৫.২ ভাগ, বিক্রয় ও বিলিবণ্টন ১.৬ ভাগ, অন্যান্য ৭.৮ ভাগ এবং অবচয় ৭.২ ভাগ। [এম হবিবুল্লাহ]