বাঘা যতীন
বাঘা যতীন (১৮৭৯-১৯১৫) বিপ্লবী ও ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী। তাঁর প্রকৃত নাম যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। তিনি ঝিনাইদহ জেলার অধিবাসী ছিলেন। তিনি কোন অস্ত্রের সাহায্য ছাড়াই খালি হাতে বাঘ হত্যা করার পর তাঁকে বাঘা যতীন নামে অভিহিত করা হয়। এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাস করার পর তিনি সাঁটলিপি ও টাইপ শেখেন এবং পরবর্তী সময়ে বেঙ্গল গভর্নমেন্টের স্টেনোগ্রাফার নিযুক্ত হন। যতীন ছিলেন শক্ত-সমর্থ ও নির্ভীকচিত্ত এক যুবক। অচিরেই তিনি একজন আন্তরিক, সৎ, অনুগত এবং পরিশ্রমী কর্মচারী হিসেবে নিজের দক্ষতা প্রমাণ করেন। তাঁর মধ্যে আত্মমর্যাদা ও জাতীয়তাবোধ অত্যন্ত দৃঢ় ছিল। অরবিন্দ ঘোষ এর সংস্পর্শে এসে যতীন শরীর গঠন আখড়ায় গাছে চড়া, সাঁতার কাটা ও বন্দুক ছোঁড়ার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। যুগান্তর দলে কাজ করার সময় নরেনের (মানবেন্দ্র নাথ রায়) সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয় এবং অচিরেই তাঁরা একে অপরের আস্থাভাজন হন।
১৯০৮ সালে যতীনসহ কয়েকজন বিপ্লবীকে আলীপুর ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত করা হয়। এ মামলার বিচারে বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে যাবজ্জীবন নির্বাসন, অন্যদের বিভিন্ন মেয়াদে জেল এবং অনুশীলন সমিতিকে বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে যতীন এবং নরেনকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তাঁরা উভয়েই হাওড়া-শিবপুর এলাকায় আত্মগোপন করেন এবং অন্যান্য বিপ্লবীর সঙ্গে গুপ্তভাবে বিপ্লবী কর্মকান্ড চালিয়ে যান।
যতীনকে পুনরায় হাওড়া-শিবপুর ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতার করা হয় এবং তাঁর সঙ্গে অন্যান্য যাঁরা গ্রেফতার হন তাঁদের ‘যতীন গ্যাং’ নামে অভিহিত করা হয়। অত্যাচারের শিকার হয়ে তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের মৃত্যু হয় এবং অপর কয়েকজন পাগল হয়ে যান। সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে যতীন এ মামলা থেকে মুক্তি পেলেও তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। জেলে থাকা অবস্থায় যতীন এবং নরেন সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের এক দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তাঁরা দেশপ্রেমিক বিভিন্ন দলকে ঐক্যবদ্ধ করার পরিকল্পনা করেন এবং এ উদ্দেশ্যে নরেন সন্ন্যাসিরূপে ব্যাপকভাবে সমস্ত ভারত ভ্রমণ করে বাংলাসহ বিভিন্ন এলাকার বিপ্লবীদের সংগঠিত করেন। বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দ হুগলি এবং মেদিনীপুরের বন্যার ত্রাণকার্য উপলক্ষে একত্রিত হন। তাঁরা যতীন মুখোপাধ্যায় এবং রাসবিহারী বসুকে যথাক্রমে বাংলা এবং উত্তর ভারতের নেতা মনোনীত করেন।
ভারতবর্ষের বাইরেও বিপ্লবীদের সংগঠিত করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়। সানফ্রানসিসকো শহরে যুগান্তর আশ্রম প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং শিখ সম্প্রদায় এ সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ইউরোপে অবস্থানরত ভারতীয় বিপ্লবীরা ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স পার্টি গঠনের উদ্দেশ্যে বার্লিনে সমবেত হন এবং তাঁরা এতে জার্মানির সাহায্য কামনা করলে জার্মান সরকার সম্মত হয়। কলকাতাস্থ জার্মান কনসাল জেনারেলের সঙ্গে আলোচনার জন্য ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স পার্টি যতীন মুখোপাধ্যায়ের নিকট একজন দূত পাঠান। ইতোমধ্যে যতীনকে বিপ্লবী দলসমূহের কমান্ডার-ইন-চিফ করা হয়। যতীনকে বালেশ্বরে (উড়িষ্যা) গুপ্ত অবস্থায় রেখে নরেন বাটাভিয়া যান এবং সেখানে জার্মান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জাহাজে অস্ত্র প্রেরণ ও অর্থনৈতিক সাহায্য বিষয়ে আলোচনা করেন।
অবশ্য পুলিশ ধানক্ষেতে যতীনের গুপ্ত আশ্রয়ের সন্ধান পায়। ১৯১৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর পুলিশের সঙ্গে ব্যাপক গুলি বিনিময়ের পর দু’জন বিপ্লবী আত্মসমর্পণ করেন। পুলিশ আহত অন্য দু’জনের সাথে যতীনের মৃতদেহ উদ্ধার করে। আহত দুজনের একজন ছিলেন মাদারিপুরের চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী, যার কিছুক্ষণ পরেই মৃত্যু হয়। [টি হোসেন]