বাংলাদেশ মেরিন একাডেমী
বাংলাদেশ মেরিন একাডেমী বাণিজ্য জাহাজের জন্য দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে ১৯৬২ সালে চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ একাডেমী আন্তর্জাতিক বাণিজ্য জাহাজের ক্যাডেট, ডেক অফিসার এবং মেরিন ইঞ্জিনিয়ানদের প্রশিক্ষণ ও অনুশীলনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে। চট্টগ্রামের অদূরে, কর্ণফুলী এবং বঙ্গোপসাগরের মোহনায় গড়ে ওঠে এ মেরিন একাডেমী। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এর পরিচালনার দায়িত্বে ছিল পাকিস্তান নৌ বাহিনী। স্বাধীনতা লাভের পর মেরিন একাডেমীর পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করে বাংলাদেশ সরকার। প্রারম্ভিকভাবে প্রতিবছর ৪০ জন ক্যাডেট নিয়ে এর অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল (২০ জন নৌবিদ্যা এবং ২০ জন নৌ-প্রকৌশল বিদ্যায়)। বর্তমানে প্রতিবছর ২০০ ক্যাডেট একাডেমীতে ভর্তি হয়। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এ পর্যন্ত একাডেমী হতে প্রায় চার হাজার নৌবিদ্যা এবং নৌ প্রকৌশল শাখার ক্যাডেট তাদের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে বাণিজ্যিক জাহাজে মাস্টার মেরিনার এবং নৌ প্রকৌশল পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন।
বাংলাদেশ মেরিন একাডেমীতে ভর্তি হওয়ার জন্য একজন পরীক্ষার্থীকে এইচএসসি (বিজ্ঞান) বা এ লেভেল সমাপ্ত করে ক্যাডেট বাছাই পর্বের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়। লিখিত (পদার্থবিদ্যা, গণিত, ইংরেজি এবং সাধারণ জ্ঞান), মৌখিক এবং শারিরিক যোগ্যতার পরীক্ষায় চুড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হলে একজন পরীক্ষার্থীকে ক্যাডেট হিসেবে মেরিন একাডেমীতে ভর্তির মনোনয়ন দেওয়া হয়। বর্তমানে নৌবিদ্যা (নটিক্যাল) এবং নৌপ্রকৌশল (মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং) শাখায় সমান সংখ্যক অর্থাৎ একশত করে সর্বমোট দুশত ক্যাডেট প্রতিবছর বাংলাদেশ মেরিন একাডেমীতে ভর্তি হয়। নৌ শাখার একজন ক্যাডেট সিম্যানশিপ (Seamanship), নেভিগেশন (Nevigation), চার্টওয়ার্ক (Chartwork), যোগাযোগ, শিপস স্ট্যাবিলিটি (Ship’s Stability) জাহাজ লোডিং-আনলোডিং (Loading-Unloading) এর মত পেশাগত বিষয়ে তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জন করে। অপরদিকে নৌ প্রকৌশল শাখার একজন ক্যাডেট, মেরিন ইঞ্জিন, জেনারেটর, অক্সিলিয়ারি মেশিনারি, তড়িৎকৌশল, বিভিন্ন সিস্টেম, স্ট্রেনথ্ অব মেটেরিয়াল, শিপস স্ট্রাবিলিটি, মেশিন ড্রইং এর মত পেশাগত বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। পেশাগত বিষয়ের পাশাপাশি উভয় শাখার ক্যাডেটরা, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, গণিত এবং ইংরেজির মত একাডেমিক বিষয়ে দু’বছর লেখাপড়া করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হতে বি.এসসি ডিগ্রি অর্জন করে। এরপর একজন ক্যাডেট দু’বছর পেশাগত ও একাডেমিক বিষয়ে অধ্যয়ন শেষে চুড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বাৎসরিক কুচকাওয়াজের (Passing Out Parade) মাধ্যমে বাস্তব জীবনে প্রবেশ করে। এরপর ডেক ক্যাডেট অথবা মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং ক্যাডেট হিসাবে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন বা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক জাহাজে যোগদান করে। নূন্যতম এক বছরের বাস্তব ও ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ শেষে পুনরায় ফেইজ থ্রি কোর্সে মেরিন একাডেমী বা অন্যকোন গ্রহণযোগ্য নৌশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগদান করে। পরবর্তীকালে ক্লাশ থ্রি পরীক্ষায় ডিজি শিপিং অথবা অন্যকোনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে সার্টিফিকেট অর্জন করে। এরপর বাণিজ্যিক জাহাজে চাকুরির পাশাপাশি ক্লাশ টু এবং ক্লাশ ওয়ান পরীক্ষায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে সার্টিফিকেট অর্জন করে। এভাবে একজন নৌ বা প্রকৌশল শাখার ডেক অফিসার বা নৌ প্রকৌশলীকে ধাপে ধাপে চাকুরির পাশাপাশি প্রয়োজনীয় পরীক্ষায় অংশগ্রহণ তথা সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে যথাক্রমে ক্যাপ্টেন বা চিফ ইঞ্জিনিয়ার হতে আনুমানিক সাত থেকে নয় বছর সময় লেগে যায়। এরপর পূর্ণ দক্ষতা অর্জনকারী একজন ক্যাপ্টেন বা চিফ ইঞ্জিনিয়ার বাণিজ্যিক জাহাজে চাকুরি করতে পারে। এর পাশাপাশি পোতাশ্রয়, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক জাহাজ সংক্রান্ত ব্যবসা, শিপ বিল্ডিং, ইন্সুরেন্স জাহাজ সার্ভে, মেরিন প্রশিক্ষণসহ নানা ধরনের ল্যান্ড বেইজ পেশায় আত্মনিয়োগ করতে পারে।
জাপানের Ocean Policy Research Foundation এক পরিসংখ্যানে দেখিয়েছে আগামী ৪০ বছরে (অর্থাৎ ২০৫০ সাল নাগাদ) নৌ বাণিজ্যিক জাহাজে ৩৬৪,০০০ কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রয়োজন দেখা দিবে। যুক্তরাজ্যের Precious Associates Limited প্রতিষ্ঠানটি এক পরিসংখ্যানে দেখিয়েছে ২০০৮ সালে বিশ্ব নৌ-বাণিজ্যিক জাহাজ বহরে কর্মকর্তার চাহিদা ছিল ৫৩৩,০০০ জন এবং একই সময়ে উপযুক্ত কর্মকর্তার যোগান ছিল ৪৯৯,০০০ জন। অর্থাৎ বিশ্ব নৌ-বাণিজ্যিক জাহাজ বহরে কর্মকর্তার ঘাটতি ছিল ৩৪,০০০। প্রতিষ্ঠানটির পরিসংখ্যান মতে, ২০১২ সালে জাহাজের ডেক ও নৌ-প্রকৌশলীর প্রয়োজন হবে ৮৬,১০০। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মত একটি দরিদ্র ও তীব্র কর্মসংস্থান সংকটের দেশে মেরিন পেশা সূবর্ণ সুযোগ হয়ে এসেছে।
বাংলাদেশ মেরিন একাডেমীর উন্নত প্রশিক্ষণদান পদ্ধতি, গুণগত মান এবং একাডেমীর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যোগ্য তথা পেশাগতভাবে দক্ষ নৌ-কর্মকর্তাদের উপর আস্থা রেখে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক নৌ-প্রতিষ্ঠানের (IMO), বিশ্ব নৌ বিশ্ববিদ্যালয় (সুইডেন) তার ১৪টি শাখার অন্যতম হিসাবে মেরিন একাডেমীক ১৯৯০ সালে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশ ২০০১ সালের ২৭ জুলাই UNCLOS অনুযায়ী বঙ্গোপসাগরে আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘ নৌ সনদে স্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশ বর্তমানে IMO White List স্বীকৃত দেশ। বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চলমান বিশ্বের নৌ জাহাজ বহরের চাহিদার বিপরীতে নৌ-কর্মকর্তাদের তীব্র সংকটের কথা বিবেচনা করে আগামী জুন ২০১৩ সাল নাগাদ বাংলাদেশে আরও ৬টি (রংপুর, পাবনা, খুলনা, বরিশাল, নারায়ণগঞ্জ ও সিলেট) মেরিন একাডেমী প্রতষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছেন (২০১১)। তাছড়া ২৬ মার্চ ২০১১ সালে বাংলাদেশ মেরিন একাডেমীকে ‘বঙ্গবন্ধু মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়’ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। [খন্দকার আক্তার হোসেন]