পাঁচ পীর
পাঁচ পীর বাংলায় পীরানী বিশ্বাসের বিবর্তনে এক তাৎপর্যপূর্ণ উত্তরণ। দূরদূরান্তে ইসলামের বিস্তৃতির ফলে মুসলিম জনগণ বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সংস্পর্শে আসে। এর ফলে একদিকে যেমন ইসলাম অন্য ধর্মকে প্রভাবিত করে, অন্যদিকে ইসলাম এবং মুসলিমগণও অপর ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হয়। এই প্রভাবিত হওয়ার প্রক্রিয়াটি প্রধানত পীর বা আওলিয়া-দরবেশদের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।
পাঁচ পীরের বন্দনা বাংলার কোনো কোনো অঞ্চলে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান ও মেদিনীপুর জেলায় প্রচলিত ছিল। গৃহ-দেবতা হিসেবে পাঁচ পীরের বন্দনা বেদি তৈরি হতো গৃহস্থের বাড়ির কোনো ঘরের উত্তর-পশ্চিম কোণে কাদা মাটি দিয়ে উঁচু করে। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে, বিশেষ করে সমাজের নিম্নস্তরের জনগণ পাঁচ-পীরের বন্দনা করত। মাটির বেদির উপর মানুষের মাথার আদলে এক খন্ড লোহা এবং পাঁচ-পীরের প্রতীক স্বরূপ পাঁচ-আঙ্গুল স্থাপিত হতো। পাঁচ পীরের দরগাহ নামে সোনারগাঁয়ে একটি দরগাহ আছে। পূর্ব-বাংলার উপকূলীয় জেলার নাবিকেরা নৌ-যাত্রার পূর্বে আপদ-বিপদ থেকে পরিত্রাণের মানসে পাঁচ পীরের সঙ্গে পীর বদরকেও স্মরণ করে।
‘পাঁচ পীর’ বন্দনা কখন থেকে শুরু হয় তা সঠিক করে বলা কঠিন। সোনারগাঁয়ের পাঁচ পীরের দরগাহ কখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাও জানা যায় নি। দরগাহর পাশে একটি মসজিদ আছে। কিন্তু মসজিদের গায়ে নির্মাণের তারিখ সম্বলিত কোনো লিপি সংস্থাপিত নেই। পালাগানে পাঁচ পীরের সঙ্গে পীর বদরকে যুক্ত করা হলেও, বদরকেও শনাক্ত করা যায় না। অনেক এলাকা আছে যেখানে পীর বদরের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়। অবশ্য পালাগানের পীর বদরকে যদি চট্টগ্রাম বিজয়ের সঙ্গে জড়িত পীর বদর বা বদর শাহের সঙ্গে অভিন্ন ধরা হয়, তবে পাঁচ পীরের ধারণা চৌদ্দ শতকের বলে অনুমান করা যায়। অবশ্য পরবর্তীকালেও বদরের নামের সঙ্গে পাঁচ পীরের নাম সংযুক্ত হয়ে থাকতে পারে।
এই পাঁচ পীর কারা তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। পাঁচ পীরের যে তালিকা বিভিন্ন স্থানে পাওয়া যায় তা অভিন্ন নয়, এ সকল তালিকায় স্থানীয় পীরদের নাম রয়েছে। তবে একজন ‘গাজী মিয়া’র নাম সকল তালিকায় দেখা যায়। কিন্তু এই গাজী মিয়া কে তা সঠিক জানা যায় না। সাধারণত ধর্মযুদ্ধে মৃত্যু বরণকারীদের শহীদ এবং ধর্মযুদ্ধে বিজয়ীদের বলা হয় গাজী। গাজী উপাধি ছিল সাহসিকতা ও বীরত্বের প্রতীক। গ্রামের দরিদ্র জনগণ তাই ক্ষমতার প্রতীকরূপে পাঁচ পীরের বন্দনা করত এবং তাঁদের নিরাপদ আশ্রয় কামনা করত। [আবদুল করিম]