বাতজনিত রোগ
বাতজনিত রোগ (Rheumatic disease) বাতরোগের সঙ্গে সম্পর্কিত পেশি, কঙ্কালতন্ত্র ও যোজক কলার প্রদাহজনিত যে-কোন রোগ। সব বয়সের এবং স্ত্রী ও পুরুষ উভয়েই বাতরোগে আক্রান্ত হয়, তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আক্রমণের হার বৃদ্ধি পায়। এই রোগের লক্ষণীয় উপসর্গ হলো পেশি কঙ্কালে (musculoskeletal) ব্যথা ও আড়ষ্টতা। সচরাচর রোগের বিশদ ইতিহাস শুনে ও সতর্কতার সঙ্গে দৈহিক পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করা হয়। ল্যাবরেটরি পরীক্ষা ও ইমেজিং (imaging) রোগ নির্ণয় এবং রোগের ক্রম পরিণতি অনুধাবনে সাহায্য করতে পারে। মাত্র গুটিকয়েক পরীক্ষা এই রোগ নির্ণয়ের জন্য নির্দিষ্ট। যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মানুষের দেহের বিকলাঙ্গতার জন্য প্রধান কারণ হিসেবে এই রোগকে দায়ী করা হয়। রোগটি বাংলাদেশেও বহুদৃষ্ট। বিভিন্ন ধরনের বাতজনিত রোগের মধ্যে অস্থিসন্ধি জ্বর (Rheumatic fever) এবং সাধারণভাবে পরিচিত বাতরোগ (Rheumatism) এদেশে অধিক পরিচিত।
অস্থিসন্ধি জ্বর শিশু ও তরুণদের মধ্যে সচরাচর দৃষ্ট জ্বর ও স্ফীত অস্থিসন্ধি দ্বারা চিহ্নিত একটি রোগ। শিশু ও তরুণের হূদরোগের অন্যতম কারণ হলো অস্থিসন্ধি জ্বর। উন্নত দেশে এই রোগের প্রাদুর্ভাব একেবারে নিচু স্তরে নেমে এসেছে, কিন্তু উন্নয়নশীল দেশে এর সংখ্যা ১ লক্ষে ১৪০ জনেরও বেশি। বাংলাদেশে প্রতি ১০০০ শিশুর মধ্যে অন্তত ৪টি শিশু এতে আক্রান্ত হয়। অনেক সময় গলপ্রদাহের ঘটনা ঘটলেও অস্থিসন্ধি জ্বরের শতকরা প্রায় ৩০-৫০ ভাগ রোগীতে গলা ব্যথার কোন ইতিহাস পাওয়া যায় না। বৈশিষ্ট্যগতভাবে অস্থিসন্ধি জ্বরে বার বার আক্রমণের প্রবণতা দেখা যায় এবং যদিও রিউমেটিক নামটি অস্থিসন্ধির সঙ্গে প্রাসঙ্গিক, কিন্তু হূৎপিন্ডের সঙ্গে এর সম্পৃক্ততা একে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।
অস্থিসন্ধি জ্বর ৫-১৫ বছর বয়সীদের মধ্যে প্রায়শ দেখা যায়। চার বছর বয়সের আগে হয় কদাচিৎ এবং ১৫ বছরের পর ক্রমে কম দেখা যেতে থাকে। সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থানের দিক থেকে স্বল্পবিত্তের মানুষের মধ্যে এই রোগের প্রাদুর্ভাব অপেক্ষাকৃত বেশি দেখা যায়। অত্যধিক স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে বসবাস, পুষ্টিহীনতা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা অস্থিসন্ধি জ্বরের প্রাদুর্ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
অস্থিসন্ধি জ্বর হূৎপিন্ডের কপাটিকা ও হূদ্বেষ্টে অধিক ক্ষতিসাধন করে। এ রোগে বেশ কয়টি নিদানিক উপসর্গ প্রকাশ পায়, সেসবের মধ্যে বেশি দেখা যায় বড় অস্থিসন্ধির প্রদাহ, হূৎপ্রদাহ ও হূৎপিন্ডের প্রাচীরের স্তরসমূহ ফুলে যাওয়া ইত্যাদি। সব সময় জ্বর থাকেই।
হূৎপিন্ডের ক্ষতি সীমিত করা, উপসর্গসমূহের উপশম ও স্ট্রেপ্টোকক্কাস ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ দমনের প্রতি দৃষ্টি রেখে অস্থিসন্ধি জ্বর চিকিৎসার লক্ষ্য স্থির করা হয়। তীব্র অস্থিসন্ধি জ্বরের রোগীকে বিছানায় পুরো বিশ্রাম গ্রহণ, পর্যাপ্ত পরিমাণ অ্যাসপিরিন (aspirin) ও দীর্ঘ ক্রিয়াশীল পেনিসিলিন (penicillin) সেবন করানো হয়। রোগ স্থিতাবস্থায় না আসা পর্যন্ত অবশ্যই অব্যাহত বিশ্রাম গ্রহণ করতে হবে। অ্যাসপিরিন কাজ না করলে বা রোগীতে যদি হূৎপ্রদাহ থাকে সেক্ষেত্রে মাঝে মাঝে কর্টিকোস্টেরয়ড (corticosteroid) ব্যবহার করা হয়। চিকিৎসার অতি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো স্ট্রেপ্টোকক্কাল সংক্রমণের প্রতিষেধক হিসেবে দীর্ঘ ক্রিয়াশীল পেনিসিলিন ইনজেকশন ব্যবহার করা। এটি একটি প্রতিরোধ্য ব্যাধি, প্রথম পর্যায়ে প্রতিরোধক ব্যবস্থা গৃহীত হলে রুগ্নতা ও মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কম হয়।
বাতরোগ হাত পায়ের সন্ধিস্থলের পেশিতে তীব্র ব্যথা, প্রদাহ ও আড়ষ্টতাজনিত এক রোগ। এর সঙ্গে অঙ্গ-প্রতঙ্গ নাড়াচাড়ায় সীমাবদ্ধতা দেখা দেয়। অস্থিসন্ধিতে বাত সীমাবদ্ধ থাকলে একে অস্থিসন্ধির প্রদাহ বলা হয়। বিভিন্ন ধরনের সন্ধিপ্রদাহ ও বাতরোগকে কখনও কখনও নানাভাবে শ্রেণিবিভক্ত করা হয়, যথা অস্থায়ী অস্থিসন্ধিপ্রদাহ (অস্থিসন্ধি জ্বর); স্থায়ী অস্থিসন্ধিপ্রদাহ (বাতগ্রস্ত অস্থিসন্ধিপ্রদাহ, গেঁটেবাত); আঘাতজনিত অস্থিসন্ধিপ্রদাহ; স্ফীতিজনিত অস্থিসন্ধিপ্রদাহ; সংক্রামক বাতরোগ (গণোরিয়াজাত অস্থিসন্ধিপ্রদাহ); পেশিবাত (পেশিপ্রদাহ, পেশিশূল) এবং পুনরাক্রমী বাতরোগ। বাতরোগে কয়েক ঘণ্টা থেকে প্রায় এক সপ্তাহ পর্যন্ত তাপ ও ফোলাসহ অস্থিসন্ধি ব্যথা থাকে। প্রায়শ হাঁটু এ রোগের শিকার হয়, কিন্তু রোগটি নিশ্চিতভাবে একই অস্থিসন্ধিসমূহে সব সময় ফিরে আসে না।
বাংলাদেশে ব্যাপক সংখ্যক জনগণের মধ্যে কয়েক ধরনের বাতরোগ বহুদৃষ্ট হলেও ৪০ ঊর্ধ্ব প্রবীণ মানুষের মধ্যে এর প্রাদুর্ভাব বেশি। [এ.কে.এম মহিবুল্লাহ]