অপারেশন জ্যাকপট
অপারেশন জ্যাকপট ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি নৌ-কমান্ডোরা বিভিন্ন অভিযানের মাধ্যমে অত্যন্ত অল্প সময়ে যুদ্ধের গতি সম্পর্কে বিশ্বকে ধারণা দিতে সক্ষম হয়। ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট পরিচালিত নৌ-কমান্ডো বাহিনীর প্রথম অভিযান ‘অপারেশন জ্যাকপট’ নামে পরিচিত। এদিন রাতে নৌ-কমান্ডোরা একযোগে মংলা, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ বন্দর আক্রমণ করে এবং পাকিস্তান বাহিনীর ২৬ টি পণ্য ও সমরাস্ত্রবাহী জাহাজ ও গানবোট ডুবিয়ে দেয়।
মুক্তিযুদ্ধকালে যুদ্ধাঞ্চলকে যে ১১ টি সেক্টরে ভাগ করা হয় এর মধ্যে ১০নং সেক্টরের অধীনে ছিল নৌ-কমান্ডো। মূলত সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকা, নদী ও সমুদ্র বন্দরসহ বাংলাদেশের সমগ্র জলপথ নিয়ে এ সেক্টর গঠিত হয়। নদীমাতৃক বাংলাদেশের সঙ্গে সমুদ্রপথে পাকিস্তানের যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া ছিল নৌ-কমান্ডো আক্রমণের উদ্দেশ্য। ১০নং সেক্টরের কোনো নির্দিষ্ট সেক্টর কমান্ডার ছিলেন না। অপারেশনের সময় কমান্ডোদের কাজের নিয়ন্ত্রণ থাকত যে এলাকায় অপারেশন পরিচালিত হবে সে এলাকার সেক্টর কমান্ডারের ওপর। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে ১৪৮ জন নৌ-কমান্ডোকে চারটি দলে ভাগ করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠানো হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য ৬০ জন কমান্ডো গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন সাবমেরিনার আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী (বীরউত্তম)। তবে চট্টগ্রামে নৌ-কমান্ডো অপারেশন পরিচালিত হয় সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিকুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে। ১৫ আগস্ট রাত ১২ টায় অপারেশন জ্যাকপট শুরু হয়। কমান্ডোরা জাহাজে মাইন সংযোজন করে ফেরত আসেন। কিছু মাইন নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বিস্ফোরিত হয়। ১৫ আগস্ট রাত ১-৪০ মিনিটে চট্টগ্রাম বন্দর প্রকম্পিত হয়। বন্দরে ‘এম.ভি হরমুজ’ এবং ‘এম.ভি আল-আববাস’ নামে দুটি পাকিস্তানি জাহাজসহ বেশ কয়েকটি বার্জ ও জাহাজ ধ্বংস হয়। এম.ভি হরমুজে ৯৯১০ টন এবং এম.ভি আল-আববাসে ১০,৪১৮ টন সমর সরঞ্জাম ছিল। সাবমেরিনার আহসানউল্লাহর (বীরপ্রতীক) নেতৃত্বে ৪৮ জন নৌ-কমান্ডো মংলা বন্দরে অভিযান করেন। বন্দরের ৬ টি জাহাজ মাইনের আঘাতে বিধ্বস্ত হয়। চাঁদপুর নদীবন্দর অভিযানে সাবমেরিনার বদিউল আলমের (বীরউত্তম) নেতৃত্বে ২০ জন নৌ-কমান্ডো সফল হন। তাঁরা ১৫ আগস্ট রাতে একই সময় চাঁদপুর বন্দরে মাইন দ্বারা কয়েকটি জাহাজ ধ্বংস করেন। সাবমেরিনার আবদুর রহমান (বীরবিক্রম) ও শাহজাহান সিদ্দিকের (বীরবিক্রম) নেতৃত্বে ২০ জনের কমান্ডো দল নারায়ণগঞ্জ ও দাউদকান্দি নদীবন্দরে সফল অভিযান পরিচালনা করে।
পাকিস্তান সরকার অবরুদ্ধ বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে বলে বহির্বিশ্বে যে প্রচারণা চালায় নৌ-কমান্ডোদের সফল অভিযানের মাধ্যমে তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়। বিশ্বের সংবাদমাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের নৌ-অভিযানের খবর ফলাও করে প্রচারিত হয়। এরপর থেকে কোনো বিদেশি জাহাজ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আসতে রাজি হয় নি। অপারেশন জ্যাকপটের কারণে মুক্তিযুদ্ধ বহির্বিশ্বে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে।
[আবু মো. দেলোয়ার হোসেন]