ক্যানসার

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ১৯:৫৪, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)

ক্যানসার (Cancer)  বিশৃঙ্খল ও অনিয়মিত কোষবিভাজনঘটিত এক মারাত্মক রোগ। এ রোগের ম্যালিগন্যান্ট কোষের অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধির মাধ্যমে গড়ে ওঠা টিউমার সুস্থ কোষসমূহকে হটিয়ে আক্রান্ত প্রত্যঙ্গের স্বাভাবিক ক্রিয়াকর্মে বাধা সৃষ্টি করে। ম্যালিগন্যান্ট কোষগুলি তাদের অবস্থান স্থল থেকে রক্তপ্রবাহ বা লসিকাতন্ত্রের মাধ্যমে শরীরের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে।

ক্যানসার অনেক ধরনের। ফুসফুস বা অন্ত্রের ক্যানসারের মতো আছে আরও কতক বহুদৃষ্ট ক্যানসার। অন্যগুলি বিরল। ক্যানসারের সম্ভাব্য কারণ অনেকটা ব্যাখ্যাতীত। সিগারেটের ধোঁয়া, অন্যান্য ধোঁয়া, অ্যাসবেস্টসের গুঁড়া, এক্সহস্ট নির্গত গ্যাস এবং শিল্পের নানা রাসায়নিকের মতো দ্রব্যাদি প্রারম্ভিক কারণ বলা হয়। এক্সরে ও তেজষ্ক্রিয়তার মতো কিছু ভাইরাসও ক্যানসারজনিত রোগ সৃষ্টি করতে পারে।

ক্যানসার এক কালব্যাধি, উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসহ পৃথিবীর সর্বত্র এ রোগ বিস্তৃত। উন্নয়নশীল দেশে আগামী ২০-২৫ বছরের মধ্যে এ ব্যাধির সম্ভাব্য প্রকোপ দ্বিগুণ বৃদ্ধি পাবে বলে অনুমান করা হয় এবং সে প্রেক্ষিতে এখনই প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যাবশ্যক। দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অপুষ্টিজনিত অন্যান্য রোগসমস্যা ও স্বাস্থ্যরক্ষা সম্পর্কে সর্বসাধারণের অজ্ঞতার কারণে বাংলাদেশে ক্যানসার পরিস্থিতি গুরুতর আকার ধারণ করবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।

ক্যানসার নিয়ন্ত্রণ বলতে বোঝায় প্রাথমিক প্রতিরোধ, আগাম শনাক্তি (অর্থাৎ দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রতিরোধ), চিকিৎসা, পুনরাক্রমণের চিকিৎসা ও প্রশমনকর সেবা এবং সেসঙ্গে অধিক রোগগ্রস্ত ও দুরারোগ্য রোগীদের ব্যথা উপশম করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ। ক্যানসার নিয়ন্ত্রণের যথার্থ উদ্দেশ্য হলো ক্যানসার মৃত্যুর হার কমিয়ে এ রোগের মোট অভিঘাত হ্রাস।

অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশেই ক্যানসার সংক্রান্ত নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান নেই। বাংলাদেশের পরিস্থিতি অধিকতর অসন্তোষজনক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) থেকে উন্নয়নশীল দেশ সম্পর্কে প্রাপ্ত পরিসংখ্যানের আলোকে বাংলাদেশের মতো ১৩ কোটি জনসংখ্যার দেশে প্রতি বছর ক্যানসারে আক্রান্ত হয় প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ এবং মারা যায় প্রায় ১.৫ লক্ষ।

সারণি  বাংলাদেশে বিদ্যমান ক্যানসার ও সেগুলির কারণ

বাংলাদেশে ক্যানসার পরিস্থিতি  ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী পুরুষে সচরাচর দৃষ্ট ক্যানসারের পরিসংখ্যান নিম্নরূপ: ফুসফুস ২১%, স্বরযন্ত্র ১৩%, মুখগহবর ১২%, লিউকোমিয়া/লিম্ফোমা ৮%, গলবিল ৬%, অন্ননালী ৫%, অন্যান্য ৩৫% এবং নারীর ক্ষেত্রে জরায়ুগ্রীবা ২৪%, স্তন ১৭%, মুখগহবর ১৩%, ডিম্বাশয় ৬%, লিউকেমিয়া/লিম্ফোমা ৫%, অন্ননালী ৪%, অন্যান্য ৩১%। [১৯৮৫-৯২ সময়কালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের রেডিওথেরাপি বিভাগে চিকিৎসাপ্রাপ্ত ২১,২৩৮ জন ক্যানসার রোগীর (১৪,২২২ পুরুষ ও ৭,০৭৬ নারী) তথ্যের ভিত্তিতে।]

রোগের কারণ  ধূমপান ফুসফুস ক্যানসারের প্রধান কারণ (প্রায় ৮৫%)। এক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বে মৃত্যুহার মোট ক্যানসার আক্রান্তের ৩৫% এবং বাংলাদেশে ২১%। তামাকপাতা চর্বণ মুখের ক্যানসারের অন্যতম প্রধান কারণ এবং মোট ক্যানসার রোগীর মধ্যে এ হার প্রায় ১৩%। এদেশের অনেকেই পানের সঙ্গে জর্দা, কিমাম ইত্যাদি তামাকঘটিত উপকরণ ব্যবহার করেন। খৈনি ও গুলি থেকে মাড়ি ও চিবুকের ক্যানসার হয়ে থাকে। নস্যি ব্যবহারেও নাকের ক্যানসার হতে পারে। মুখগহবর ও দাঁতের অযত্ন থেকে ক্যানসার হওয়া সম্ভব। তামাকের ব্যবহার কেবল ফুসফুস ও মুখগহবরের ক্যানসারের জন্যই নয়, স্বরযন্ত্র, গলবিল, অন্ননালী, অগ্ন্যাশয়, বৃক্ক ও মূত্রস্থলীর ক্যানসারের জন্যও দায়ী। এদেশের মানুষ ধূমপান ও তামাকপাতা ব্যবহার বন্ধ করলে সব ধরনের ক্যানসারের অর্ধেকই নিশ্চিত হ্রাস পেত।

বাংলাদেশে নারীর জরায়ুগ্রীবা ক্যানসারের মূল কারণ সম্ভবত ঘন ঘন সন্তানপ্রসব যেজন্য জরায়ুগ্রীবার ক্ষত ও প্রদাহ দেখা দেয়। প্রসবের সংখ্যা কমিয়ে এ ধরনের ক্যানসারের সম্ভাবনাও কমানো যায়। এতে জনসংখ্যাও হ্রাস পায়। অপরিণত বয়সে যৌনকর্ম, বাল্যবিবাহ, বহুগামিতা, যৌনরোগ, হার্পেস ভাইরাস, মানুষের প্যাপিলোমা ভাইরাস, নিম্ন আর্থ-সামাজিক অবস্থান এবং ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যের অযত্নও অধিক মাত্রার জরায়ুগ্রীবার ক্যানসারের জন্য দায়ী। যৌনকর্মীদের এ ধরনের ক্যানসারের ঝুঁকি অত্যধিক। লিঙ্গাগ্রের ত্বকচ্ছেদ পুরুষের শিশ্ন ক্যানসারের আশঙ্কা অনেকটাই কমায় ও অংশত সহবাসিনীর জরায়ুগ্রীবার ক্যানসারও।

বাংলাদেশে নারীর দ্বিতীয় সহজদৃষ্ট ক্যানসার হলো স্তনক্যানসার। গর্ভহীনা নারী, স্তনক্যানসারগ্রস্ত মায়ের কন্যা, সন্তানকে দুগ্ধদানে অনীহ মা, অধিক চর্বিযুক্ত খাদ্যে আসক্তরা অধিক সংখ্যায় স্তনক্যানসারে আক্রান্ত হয়।

মুখগহবর, স্বরযন্ত্র, গলবিল ও বিশেষত লিভারের ক্যানসার মদ্যপায়ীদের মধ্যে এবং একইসঙ্গে ধূমপান বা তামাক চর্বন করলে অধিক দেখা যায়। যে HBV লিভার ক্যানসারের অন্যতম কারণ সেটির প্রতিরোধে এখন টিকা উদ্ভাবিত হয়েছে ও সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহূত হচ্ছে। উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় শর্করা প্রধান খাদ্যের মধ্যে যেসব ছত্রাক প্রচুর পরিমাণে জন্মে সেগুলি থেকে উৎপন্ন আফলাটক্সিন হলো যকৃতের একটি শক্তিশালী ক্যানসারপ্রসূ পদার্থ।

অধিক চর্বিযুক্ত খাদ্য স্তন, বৃহদন্ত্র-মলাশয়, জরায়ু ও প্রস্টেট ক্যানসারের আশঙ্কা বাড়ায়। পক্ষান্তরে অধিক অাঁশযুক্ত খাদ্য বৃহদন্ত্র-মলাশয়ের এবং ভিটামিন A, C, E সমৃদ্ধ খাদ্য স্বরযন্ত্র ও ফুসফুসের ক্যানসারের আশঙ্কা কমায়।

ক্যানসার প্রতিরোধ  বর্তমানে ক্যানসারের এক-তৃতীয়াংশ প্রতিরোধ, এক-তৃতীয়াংশ নিরাময় ও বাকিদের জন্য যন্ত্রণা উপশম বা লাঘব সম্ভব। উন্নত দেশের সাম্প্রতিক তথ্যাদি থেকে দেখা যায় যে, একমাত্র ফুসফুসের ক্যানসার ছাড়া অন্যান্য সব ধরনের ক্যানসার ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। দ্রুত শনাক্তি, উন্নত চিকিৎসা ও জীবনধারার অনুকূল পরিবর্তনের ফলে এ সাফল্য সম্ভব হয়েছে। মোট ক্যানসার মৃত্যুর সংখ্যাবৃদ্ধির কারণ মূলত ধূমপান। ক্যানসার প্রতিরোধ হতে পারে প্রাথমিক ও দ্বিতীয় পর্যায়ের। প্রাথমিক পর্যায়ে আছে রোগের সূত্রপাত ঘটার পূর্বাহ্ন ব্যবস্থা আর সেজন্য দরকার ক্যানসারের কারণগুলি জানা এবং সেগুলি এড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ। ক্যানসার প্রতিরোধের দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে ক্যানসারের প্রাথমিক লক্ষণগুলি সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান এবং নিজে স্তন ও মুখগহবর পরীক্ষা দ্বারা এবং অতঃপর নিয়মিত পরীক্ষা, অর্থাৎ বুকের এক্সরে, ম্যামোগ্রাফি ও অন্যান্য বিশেষ পরীক্ষা দ্বারা আগেভাগে রোগশনাক্তি।

ক্যানসার নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে রয়েছে কোনো সম্প্রদায় বা দেশে ক্যানসারের সামগ্রিক অভিঘাত মোকাবিলায় বিবিধ কর্মকান্ড: রোগের পূর্বাহ্ন শনাক্তি ও প্রারম্ভিক অবস্থায় যথাযথ চিকিৎসা, চিকিৎসাপ্রাপ্তদের নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা ও পুনর্বাসন, রোগের পুনরাবির্ভাবের চিকিৎসা ও দুরারোগ্যদের ব্যথা নিরাময়ের ব্যবস্থা। ক্যানসার রেজিস্ট্রি থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদির ভিত্তিতে মাঝে মাঝে কর্মসূচির মূল্যায়নও আবশ্যক।  [এস ফজলুল হক]

স্তনক্যানসার  স্তনের ম্যালিগন্যান্টজনিত অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। স্তনক্যানসার ৪০-৫০ বছর বয়সী নারীদের একটি গুরুতর স্বাস্থ্যসমস্যা। স্তনের অধিকাংশ ক্যানসারই দুগ্ধস্রাবী গ্রন্থিনালিতে এবং কয়েকটি খোদ গ্রন্থিতে দেখা দেয়। প্রাথমিক লক্ষণ হলো স্তনে পিন্ডের উৎপত্তি যা কালক্রমে বৃদ্ধি পায়। এক্ষেত্রে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসা সাহায্য অত্যাবশ্যক।

বাংলাদেশে স্তনক্যানসারের কোনো নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান নেই। জানা যায় যে, বছরে প্রায় ২ লক্ষ ক্যানসার রোগী চিকিৎসা পায় এবং মারা যায় ১ লক্ষ ৫০ হাজার। এদের মধ্যে স্তনক্যানসারের রোগীর কোনো পৃথক হিসাব নেই, কেননা স্তনক্যানসার রোগীরা রোগের শুরুতে কমই হাসপাতালে আসে। নগর ও শহরে এটি ঘটে চিকিৎসা সুবিধার স্বল্পতার জন্য, আর গ্রামাঞ্চলে রয়েছে আরেকটি বাড়তি কারণ সামাজিক বাধা। তবে, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী মহিলাদের স্তনক্যানসারের প্রাদুর্ভাব প্রায় ১৭%।

১৯৯০ দশকের গোড়ার দিকে এক্স-রেভিত্তিক ম্যামোগ্রাফি শনাক্তি প্রযুক্তি চালু হয়। এ ব্যবস্থায় সহজেই স্তনক্যানসার শনাক্ত করা যায়। ঢাকা শহরের কয়েকটি মাত্র বেসরকারি ক্লিনিকে লভ্য ম্যামোগ্রাফি সুবিধা প্রধানত সন্দেহজনক স্তন-ক্যানসার শনাক্তিতে ব্যবহূত হয় আর নগণ্যসংখ্যক লোক মনিটরিংয়ের জন্য এ সুযোগ গ্রহণ করে। প্রায় ৪০ বছর বয়সী মহিলাদের একবার এবং ৫০ বছর বয়স পর্যন্ত বছরে দু’বার আর ৫০ বছরের পর একবার ম্যামোগ্রাম নেওয়া উচিত বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।  [জিয়া উদ্দিন আহমেদ]