কর্মবাদ

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ১৯:২৩, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

কর্মবাদ ভারতীয় দর্শনের একটি নৈতিক ধারণা। কর্মবাদ অনুযায়ী প্রত্যেক মানুষকে তার কৃতকর্মের ফলভোগ করতে হবে। কর্মফল কখনোই নষ্ট হয় না। কর্মফলের মধ্য দিয়ে শুভ, অশুভ, পাপ ও পুণ্য সংরক্ষিত থাকে। এ কারণে কর্মবাদকে নৈতিক মূল্যের সংরক্ষণ নিয়ম বলে। কর্মবাদ এক প্রকার নৈতিক কার্যকারণবাদ। কর্মবাদের মূলকথা হচ্ছে মানবজীবনে সুখ-দুঃখ ভোগ কর্মের ফলমাত্র। কর্ম হচ্ছে কারণ আর সুখ-দুঃখ ভোগ হচ্ছে কর্মফল। সৎকাজের জন্য পুণ্য এবং অসৎ কাজের জন্য পাপ ভোগ করতে হবে। কর্ম এক ধরনের ‘অদৃশ্য শক্তি’  উৎপন্ন করে যার ফলে জীবকর্ম অনুসারে ভবিষ্যতে সুখ-দুঃখ ভোগ করে। কর্মবাদ তাই একটি সর্বব্যাপী নৈতিক নিয়ম ও কর্মফল সৃষ্টি করার অদৃশ্য শক্তিকে বোঝায়। কর্মবাদের ওপর ভিত্তি করেই ভারতীয় দর্শনে জন্মান্তরবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মৃত্যুর পর আত্মা নতুন দেহ ধারণ করে। বর্তমান জীবনের কৃতকর্মের ফলভোগ যদি বর্তমান জীবনে শেষ না হয়, তাহলে কর্মফল ভোগের জন্য তাকে দেহধারণ করে জন্মগ্রহণ করতে হবে, কারণ কর্মফল বিনষ্ট হয় না, সংরক্ষিত থাকে। ভারতীয় দার্শনিকগণ কর্মবাদের সাহায্যে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎকে একই সূত্রে গ্রথিত করেন। শ্রীমদ্ভগবদ্ গীতায় জন্মান্তরবাদকে ‘নতুন বস্ত্র পরিধান’, বৌদ্ধদর্শনে ‘ভবচক্র’ এবং বেদান্ত দর্শনে ‘নিত্য ও সনাতন আত্মা’ স্বীকারের মাধ্যমে সমর্থন করা হয়।

কেউ কেউ ভারতীয় দর্শনে কর্মকে সকাম কর্ম ও নিষ্কাম কর্ম-এই দুইভাগে ভাগ করা হয়েছে। শুধু সকাম কর্মই কর্মবাদের অধীন, নিষ্কাম কর্ম কর্মবাদের অধীন নয়। আমাদের রাগ, দ্বেষ ও মোহবশত যে কর্ম সম্প্রদান করা হয় এবং ফলের আকাঙ্ক্ষা করে যে কর্ম করা হয় তাই-ই সকাম কর্ম। সকাম কর্মের ফলে জীবকে বারবার সংসার জীবনে প্রবেশ করে কর্মফল ভোগ করতে হয়। সকাম কর্ম জীবের বন্ধন সূচনা করে। জীবন ও জগতের প্রকৃত স্বরূপ সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করে রাগ, দ্বেষ ও মোহমুক্ত হয়ে বেদবিহিতভাবে কর্ম করলে নিষ্কাম কর্ম সম্পাদন হয়। নিষ্কাম কর্মের ফলে কর্মফল বিনাশ ও পুনর্জন্ম রোধ হয়।

অনেকে আবার ভারতীয় দর্শনে কর্মকে দুইভাগে ভাগ করেছেন: অনারদ্ধ কর্ম ও আরদ্ধ কর্ম। যে কর্মের ফলভোগ শুরু হয়নি তাকে অনারদ্ধ কর্ম এবং যে কর্মের ফলভোগ শুরু হয়েছে তাকে আরদ্ধ কর্ম বলে। অনারদ্ধ কর্মকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে: সঞ্চিত কর্ম ও সঞ্চীয়মান কর্ম। সঞ্চিত কর্ম হচ্ছে অতীত জীবনের কর্ম এবং সঞ্চীয়মান কর্ম হচ্ছে বর্তমান জীবনের কর্ম। জৈন, ন্যায়, বৈশেষিক ও মীমাংসা দার্শনিকদের মতে-কর্ম এক প্রকার শক্তি সৃষ্টি করে এবং এই শক্তিই কর্মফল প্রদান করে। জৈন দর্শনে এই শক্তিকে ‘কষায়’, মীমাংসা দর্শনে ‘অপূর্ব’, বৌদ্ধ দর্শনে ‘সংস্কার’ নামে অভিহিত করা হয়। ভারতীয় দর্শনে কর্মবাদ ও স্বাধীন ইচ্ছার মধ্যে কোনো সংঘাত নেই। বর্তমান অতীতের কর্মদ্বারা নির্ধারিত হওয়া সত্ত্বেও জীব নিজ স্বাধীন ইচ্ছার মাধ্যমে নিষ্কাম কর্মের দ্বারা পুনর্জন্ম রোধ করে মোক্ষলাভে সক্ষম হতে পারে। তাই ভারতীয় দর্শনে কর্মবাদ অদৃষ্টবাদ নয়। জীব কর্মফলের আশা পরিত্যাগ করে নিষ্কাম কর্মের দ্বারা তার অদৃষ্টকে জয় করতে পারে। বন্ধন থেকে মুক্ত মানুষ সকল কর্মের ঊর্ধ্বে উঠে মুক্ত ও স্বাধীন জীবনযাপন করতে পারে। শাশ্বত ও অমোঘ নৈতিক নিয়মই ভারতীয় দর্শনকে আশাবাদী করে তুলেছে।  [প্রদীপ কুমার রায়]