খান, আবুল কাসেম
খান, আবুল কাসেম (১৯০৫-১৯৯১) আইনশাস্ত্রজ্ঞ, রাজনৈতিক নেতা ও শিল্পপতি আবুল কাসেম খান (এ.কে. খান নামে পরিচিত) চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ (বর্তমানে চাঁদগাঁও) থানার মোহরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। আবুল কাসেম খানের পরিবার নিজেদেরকে ষোল শতকের গৌড়ের আমীর হামযা খানের বংশধর বলে দাবি করেন। তার পিতা আব্দুল লতিফ খান ছিলেন চট্টগ্রামস্থ ফতেহাবাদের একজন সাব-রেজিস্ট্রার। তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে বি.এ (সম্মান) ও এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৩৪ সালে তিনি কলকাতা হাইকোর্টে ওকালতি শুরু করেন। তাঁর সময়কার অধিকাংশ মেধাবী শিক্ষার্থীদের ন্যায় তিনিও ১৯৩৫ সালে বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অবতীর্ন হন এবং সাফল্যের সাথে বিচার বিভাগে মনোনয়ন লাভ করেন। ১৯৩৫ সালে মুনসেফ হিসেবে যোগদান করে এ.কে. খান ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের সদস্য হিসেবে কাজ করেন। এর পরই তিনি পদত্যাগ করে ব্যবসায়ে আত্মনিয়োগ করেন।
এ.কে. খান তার ব্যবসায়িক উদ্যোগের শুরুতেই শ্বশুর আব্দুল বারী চৌধুরীর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। কিন্তু তাঁর উন্নত মেধাশক্তি ও সিভিল সার্ভিসের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তিনি ব্যবসায়ে নতুন সম্ভাবনার পথ উন্মুক্ত করেন। তিনি তার শিল্প উদ্যোগে বৈচিত্র্য আনেন এবং দ্রুত নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন, যেমন একটি ম্যাচ ফ্যাক্টরি, প্লাইউড্ ফ্যাক্টরি, কটন টেক্সটাইল মিল, নৌচালন কোম্পানি (পাকিস্তান ন্যাশনাল স্টীমশিপ্ কোম্পানি), একটি ডক্ইয়ার্ড ও ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি। খান অচিরেই জাতীয়ভাবে একজন প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিতে পরিণত হন। বস্ত্তত তিনি পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের মধ্যে প্রথম বড় মাপের আধুনিক শিল্পপতিরূপে পরিগণিত।
উন্নত মেধা, আমলাতান্ত্রিক ও ব্যবসায়িক পটভূমি নিয়ে এ.কে. খান অনুরূপ দক্ষতা ও সাফল্যের সাথে রাজনৈতিক জীবনে প্রবেশ করেন। ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগ এর প্রার্থী হিসেবে তিনি কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেমব্লির অব ইন্ডিয়ার সদস্য নির্বাচিত হন। [Image:খান, আবুল কাসেম_html_d35c3431.jpg|thumb|400px|right|আবুল কাসেম খান]]
ভারত বিভাগের পর তিনি পাকিস্তান কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেমব্লির সদস্য ছিলেন। সংসদে তিনি নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান শাসনের ক্ষেত্রে তাঁর ধারণা সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করার চেষ্টা করেন। সংসদে তাঁর বক্তব্য পাকিস্তান এবং তার নিজ প্রদেশ পূর্ববঙ্গের প্রতি তার দেশাত্মবোধের পরিচয় বহন করেন।
এ বক্তব্যে তাঁর শিক্ষা, প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার সুস্পষ্ট প্রকাশ ঘটে। তিনি মনে করতেন, পাকিস্তানের টিকে থাকা ও সমৃদ্ধি শুধু শূন্য প্রতিশ্রুতিতে নয় বরং দুপক্ষের ন্যায়সঙ্গত ও ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের ওপর নির্ভরশীল। তাঁর মতে, মূলত কেন্দ্রীয় সরকারকেই এ দায়িত্ব পালন করতে হবে। ১৯৫১-৫২ সালের বাজেট বিলে আলোচনায় অংশ নিয়ে এ.কে. খান নিম্নোক্ত বক্তব্য পেশ করেন (২৪ মার্চ ১৯৫১):
‘‘স্যার, আমি কথাগুলি না বলে পারছি না এবং আমি আশা করি আমার বক্তব্যকে সংকীর্ণ প্রাদেশিক মনোভাবাপন্ন বলে কেউ অপব্যাখ্যা করবেন না। স্যার, বর্তমান যুগটি বিকেন্দ্রীকরণ ও আঞ্চলিক স্বয়ং সম্পূর্ণতার যুগ। আমরা দেখতে পাচ্ছি, এ ছয়-সালা পরিকল্পনায় পূর্ব বাংলায় যেখানে মোট জনগোষ্ঠীর ৫৬ শতাংশ লোক বাস করে সেখানে বরাদ্দের পরিমাণ রাখা হয়েছে শতকরা ২৩ ভাগেরও কম। কৃষিখাতে ৮২ কোটি টাকা বরাদ্দ ধরা হয়েছে এবং পূর্ব বাংলার জন্য পরিকল্পিত প্রকল্পগুলির জন্য সাকুল্য বরাদ্দ দেখানো হয়েছে ৫.৬ কোটি টাকা। পানি-বিদ্যুৎ শক্তি উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৪৫ কোটি টাকা এবং সেখানে পূর্ব বাংলার অংশ মাত্র ৫ কোটি টাকা। শিল্পখাতে বস্ত্রশিল্পে (পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য) বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৩০ কোটি টাকা এবং পাটশিল্পে (পূর্ব বাংলার জন্য) ধরা হয়েছে মাত্র ১১ কোটি টাকা। স্যার, এর থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, শুধু অতীতে নয়, বর্তমানে নয়, ভবিষ্যতেও দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনায় পূর্ব বাংলা তার ন্যায্য অংশীদারিত্ব পাবে না। এর কারণ জানতে পারি কি ? ... কেন্দ্রীয় সচিবালয়ে পূর্ব বাংলার কদাচিৎ প্রতিনিধিত্ব এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ে কোনো প্রতিনিধিত্ব না থাকার মতো দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতিই কি এ জন্য দায়ী? গত চার বছরে আপনার বৈদেশিক মুদ্রার শতকরা ৮০ ভাগ অর্জন করেছে পূর্ব বাংলা। ... স্যার, আমরা আমাদের প্রতিরক্ষা খাতে প্রায় ৮০ কোটি টাকা ব্যয় করছি, অথচ এ খাতে পূর্ব বাংলার জন্য ব্যয় করা হচ্ছে দুকোটি টাকার সামান্য বেশি। ... উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তাদের সাম্প্রতিক ষড়যন্ত্র সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, দেশের প্রতিরক্ষা কাজে কোনো নির্দিষ্ট প্রদেশের (পাঞ্জাব) ওপর নির্ভর করা উচিত নয় এবং তা বিপজ্জনকও বটে। আমরা (বাঙালিরা) শুধু সুযোগ সুবিধার কথা বলি। আমাদের লোকেরা দেশের প্রতিরক্ষায় নিজেদের ন্যায্য অংশ লাভের জন্য খুবই উদ্বিগ্ন। আমরা সাদা চামড়া আদমীদের তাদের বোঝা থেকে অব্যাহতি দিয়েছি (উপনিবেশিক শ্বেতাঙ্গ প্রভুরা গর্ব করতেন যে, ভারতীয়দের সভ্য করার জন্যই তারা এদেশে এসেছিলেন), আর এখন আমাদের যে ভাইরা আমাদের নিরাপত্তা বিধান করেন বলে দাবি করছেন তাদের বোঝাও আমরা আনুপাতিক হারে কমাতে চাই। ... স্যার, পাকিস্তানকে নিশ্চিত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে দেশের প্রতিটি অংশের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে গড়ে তুলতে হবে সে ভিত্তি। বাঙালিই হোক, বালুচই হোক, সিন্ধি বা পাঞ্জাবি যা-ই হোক দেশের প্রতিটি লোকের জন্য সমান সুযোগ সুবিধা থাকতে হবে।’’
এ.কে. খানের বক্তব্য ছিল ভবিষ্যৎ আঞ্চলিক বৈষম্য ও প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নের পরিষ্কার পূর্বাভাস। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর জাতীয় ও প্রাদেশিক রাজনীতির পরিবর্তন ও জটিলতা তাকে ব্যথিত করে এবং এ পরিস্থিতিতে নিরাশ হয়ে তিনি রাজনীতি থেকে অবসর নেন এবং পুনরায় ব্যবসা ও শিল্পে মনোযোগ দেন। কিন্তু শীঘ্রই আইয়ুব সরকারের আমলের প্রথমদিকে রাজনীতিতে ফিরে আসেন। তিনি ১৯৫৮ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত শিল্প, পূর্ত, সেচ, বিদ্যুৎ ও খনিজ সম্পদের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলেন। অবশ্য শাসনতান্ত্রিক ও প্রাদেশিক ইস্যুতে তিনি আইয়ুব খানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। তিনি ১৯৬২ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত নিজ নির্বাচনী এলাকা থেকে পাকিস্তান গণপরিষদের বিরোধী দলীয় সদস্য ছিলেন। তিনি ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং ১৯৯১ সালের ৩১ মার্চ মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি পরিবার পরিজন ও বন্ধু মহলে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেন। তিনি যে একজন প্রতিশ্রুতিশীল কর্মোদ্যোগী ছিলেন তাঁর রাজনৈতিক জীবনের কর্মকান্ড থেকেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি ছিলেন দানশীল ও জনহিতৈষী ব্যক্তি। তাঁর একটি পারিবারিক প্রকাশনা (এ.কে. খান স্মরণিকা ১৯৯১) থেকে জানা যায় যে, মৃত্যুর প্রাক্কালে তিনি তাঁর ব্যবসা বাণিজ্য ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের মুনাফার শতকরা ৩০ ভাগ ধর্মীয় কাজে, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার প্রসারে দান করে যান। [সিরাজুল ইসলাম]