আর্য

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ১৮:১০, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

আর্য  জাতি খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দে বাংলা অঞ্চলে প্রবেশ করতে শুরু করে। তৎকালে বাংলা অসংখ্য  ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বা উপরাষ্ট্রে বিভক্ত ছিলো। প্রত্যেক রাষ্ট্র স্বশাসিত নৃগোষ্ঠী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো। পূর্ববর্তী বৈদিক আর্যগণ উপনিবেশ গড়ার ক্ষেত্রে নানা কারণে এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে আসার ব্যাপারে অনাগ্রহী ছিল। কারণ তাদের দৃষ্টিতে পূর্বাঞ্চলীয় ভূখন্ডে ছিল অশুচি ও দস্যু বা বর্বর জনগোষ্ঠীর বাস।

মৎস্য পূরাণের এক বর্ণনায় দেখা যায় যে, এক অন্ধ বৃদ্ধ সাধু ভুলবশত নিম্নগাঙ্গেয় উপত্যকার স্রোতে ভেলা ভাসিয়েছিলেন। বালী নামের এক নিঃসন্তান রাজা বংশ রক্ষা ও রাজ্যের উত্তরাধিকারীর জন্য বৃদ্ধ সাধুকে আশীর্বাদ করার অনুরোধ করেন। সাধুর আশীর্বাদে রাজা তাঁর বৃদ্ধা রানীর গর্ভজাত পাঁচটি পুত্র সন্তানের জনক হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন। পাঁচ পুত্রের নাম রাখা হয় অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুন্ড্র ও সূক্ষ্ম। রাজার পাঁচ পুত্র সন্তানের নামে বাংলার পাঁচটি ভূখন্ডের নামকরণ হয়। পৌরাণিক কাহিনীতে বর্ণিত এ পাঁচটি ভূখন্ডই পরবর্তীকালে মুগল শাসনামলের বাংলা ও বিহার অঞ্চলকে প্রতিনিধিত্ব করে।

বাংলা ভূখন্ড আর্যদের নিকট এতোটাই অপবিত্র ছিল যে, তারা সতর্কতার সঙ্গে এতদঞ্চলে প্রবেশ ও স্থায়ী বসবাস গড়া থেকে নিজেদের বিরত রেখেছিলো। সাধু ছিলেন অন্ধ এবং গঙ্গার জলস্রোতের অনুকূলে ভাসমান ভেলার গতির ওপর তাঁর কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিলো না বলেই তাঁর ভুলের কারণে দুর্ঘটনাবশত: আর্যদের সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগ সূচিত হয়েছিল।

যে কোনো প্রকারেই হোক, আর্যজাতি বাংলায় প্রবেশ করে এবং পরবর্তী পর্যায়ে তাদের এ অঞ্চলে প্রবেশ ছিল প্রায়ই আকস্মিক ও বিরল ঘটনা। সবচাইতে কৌতুহোলদ্দীপক হলো, আরও পরবর্তী সময়ের বৈদিক সাহিত্যের বিষয়াবলীতেও বাংলার জনগোষ্ঠীকে দস্যু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। মহাভারত এ বাংলার উপকূলবর্তী অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে ম্লেচ্ছ হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। ভগবত পুরাণে ও বাংলার জনগণকে বলা হয়েছে ‘পাপী’। ধর্মশাস্ত্রে পুন্ড্র ও বঙ্গীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সংস্পর্শে আসার পর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে মৃত্যুর পরবর্তী শেষ কৃত্যানুষ্ঠান আয়োজনের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। তথাপি সময়ের ব্যবধানে ধীরে ধীরে আর্য জাতির বাংলায় প্রবেশের সংখ্যা বেড়েছে এবং এ অঞ্চলে তাদের প্রভাব বিস্তারও ঘটেছে। বসবাসের উপযোগী ভূখন্ড হিসেবে পূর্ববর্তী আর্যগণ উচ্চ-গাঙ্গেয় উপত্যকা অঞ্চলসমূহ বেছে নিলেও মানব-ধর্মশাস্ত্র গ্রন্থের প্রণেতা ভূখন্ড পশ্চিম থেকে পূর্ব সমুদ্র পর্যন্ত বর্ধিত ছিল বলে বর্ণনা করেন। যদিও আর্য আইন প্রণেতাগণ পুন্ড্র ও বঙ্গদেশীয় জনগোষ্ঠীকে মর্যাদাহানিকর জাতি হিসেবে চিহ্নিত করতো। যে সকল ক্ষত্রীয় বাংলার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছিলো, তাদেরকেও অশুদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল।

মহাভারত এর তীর্থ যাত্রা খন্ডে করতোয়া ও নিম্ন গাঙ্গেয় অঞ্চলের অনেকগুলো ভূ-ভাগকে পাপীদের পাপ স্খলনের স্থান হিসেবে নির্দিষ্ট করে চিহ্নিত করে দেয়। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সময়ের ব্যবধানে আর্য জাতির নিকট বাংলা অঞ্চল আর অপবিত্র স্থান বা অস্পৃশ্য ছিলো না। কারণ তারা পাপ স্খলনের উপায় বের করেছিল। তবে একথা নিশ্চিত করে বলার এমন কোনো উৎস নেই যে, আর্যগণ ব্যাপকহারে বাংলায় এসেছিল। প্রাথমিক পর্যায়ে আগত আর্যগণ নিজেদের আবাস গড়ে তোলার জন্য বেশ কয়েকটি অঞ্চলকে আবাসযোগ্য পবিত্র স্থান হিসেবে গড়ে নিয়েছিল। এ প্রক্রিয়ায় আর্যদের মাধ্যমে বাংলার উচ্চ গাঙ্গেয় অঞ্চলসমূহে আর্য সংস্ক…ৃত প্রবেশ করে। অবশ্য নিম্নগাঙ্গেয় অঞ্চলের নদীতীরবর্তী জনগোষ্ঠীকে তারা কখনোই তাদের সংস্পর্শে আসার যোগ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। আর্যগণ বাংলায় বসবাস গড়ে তুললেও স্থানীয় জনগণের সঙ্গে মেলামেশার ক্ষেত্রে তারা নানা ধরণের বিধিনিষেধ বজায় রেখে চলতো।

খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দের মধ্যে বাংলায় অসংখ্য শক্তিশালী রাষ্ট্রের উত্থান ঘটে যাদের বিরুদ্ধে আর্যগণ সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছিল। মহাকাব্য - রামায়ণ এ বর্ণিত এক কাহিনীতে দেখা যায় যে, কর্ণ, কৃষ্ণ এবং ভীমসেন নামের মহান আর্যনায়কগণ বাংলার শক্তিশালী রাজাদের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে জয়লাভ করেছিলেন। এ কাহিনী থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, আর্যগণ অন্ততপক্ষে বাংলার রাষ্ট্র নায়কগণকে সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে শুরু করেছিল। বঙ্গ ও পুন্ড্রদের পরাজিত করে কৃষ্ণ একজন যোদ্ধা হিসেবে নিজের অবস্থান তৈরি করেছিলেন। পূর্বাঞ্চলে অভিযানকালে ভীমসেন বাংলার সকল স্থানীয় যুবরাজদের পরাজিত করেছিলেন। এ সকল পৌরাণিক কাহিনী বাংলার জনগোষ্ঠী সম্পর্কে আর্যদের পরিবর্তিত মানসিকতার সূচক হিসেবে কাজ করে এবং স্থানীয় নৃতাত্ত্বিক সমাজ ব্যবস্থায় আর্য সংস্কৃতির প্রভাবের সূচনারও ইঙ্গিত বহন করে।  [সিরাজুল ইসলাম]