মুদ্রা বাজার
মুদ্রা বাজার একটি দেশের আর্থিক বাজারের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর্থিক বাজারের এ অংশে আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের হাতে থাকা স্বল্পমেয়াদি ধারযোগ্য তহবিল লেনদেন হয়ে থাকে। সাধারণত বাজারভিত্তিক দামে তথা সুদহারে এসব লেনদেন সম্পাদিত হয়। তবে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত সুদহারেও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি তাদের স্বল্পমেয়াদি উদ্বৃত্ত তহবিল লেনদেন করে থাকে। শরীয়া অনুসারী ব্যাংকসমূহ নিজেদের মধ্যে ঘোষিত মুদারাবা মুনাফা হারে তহবিল ধার প্রদান ও ধার গ্রহণ করে থাকে। একই মুনাফা হারে তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে ধার গ্রহণ করে। যেসব ব্যাংকের কাছে তারল্য উদ্বৃত্ত থাকে তারা তারল্য ঘাটতির ব্যাংকগুলোকে বাজারভিত্তিক সুদ বা মুনাফা হারে স্বল্পমেয়াদে ধার প্রদান করে। সুদ বা মুনাফা ভিত্তিক তারল্য প্রবাহের পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি তাদের হাতে থাকা আমানত পত্র, বিল, ট্রেজারি বিল এমনকি ট্রেজারি বন্ড বাট্টাকরণের মাধ্যমেও স্বল্পমেয়াদি তহবিল ঘাটতি পুরণ করে থাকে। একটি স্পন্দিত মুদ্রাবাজার ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্পমেয়াদি তহবিলের অবাধ প্রবাহ ও ন্যূনতম সুদ/মুনাফা হার নির্ধারিত হয়। এই হারকে কেন্দ্র করে অন্যান্য আর্থিক বাজারের সুদ/মুনাফা হার আবর্তিত হয়। অর্থাৎ স্বল্প মেয়াদি তহবিল লেনদেনের এই হারসমূহ অন্যান্য তহবিল বাজারের সুদ/মুনাফা নির্ধারণীতে ভিত্তি হার হিসেবেও কাজ করে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক, তফসিলী ব্যাংক, সরকার, আর্থিক কোম্পানি, চুক্তিভিত্তিক সঞ্চয়ী প্রতিষ্ঠান, যেমন- পেনশন তহবিল, বীমা কোম্পানি, সঞ্চয় ও ঋণদান সমিতি এবং কতিপয় অতফসিলী ব্যাংক মুদ্রাবাজারে অংশগ্রহণ করে। মুদ্রাবাজারের আর্থিক দলিল হিসেবে ট্রেজারি বিল, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারের স্বল্পমেয়াদি বন্ড, হস্তান্তরযোগ্য আমানত সার্টিফিকেট, ব্যাংকের স্বীকৃতিপত্র, বাণিজ্যিক পত্রের ন্যায় বিনিময়যোগ্য বিল, প্রতিশ্রুতিপত্র এবং সাধারণ মুদ্রাবাজার তহবিল ইত্যাদি কাজ করে থাকে। উন্নত মুদ্রাবাজারের পূর্বশর্তগুলি হচ্ছে: একটি সুসংগঠিত ব্যাংকিং ব্যবস্থা, দক্ষ কেন্দ্রীয় ব্যাংক, স্বল্পমেয়াদি সম্পদের লেনদেনকারী উন্নতমানের অনেক প্রতিষ্ঠান, দেশ ও বিদেশ হতে পর্যাপ্ত তহবিল প্রবাহ, স্বল্পমেয়াদি সম্পদের পর্যাপ্ত তারল্যাবস্থা, দ্রুত প্রেরণের সুবিধাসহ তহবিলের পূর্ণ গতিশীলতা; অভিন্ন এবং বাজারভিত্তিক দাম বা সুদ/মুনাফা-হার কাঠামো, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্যে অতিমাত্রায় সংবেদনশীলতা এবং সর্বোপরি অর্থনৈতিক কার্যক্রমে স্থিতিশীলতা।
বাংলাদেশের মুদ্রাবাজার ধীরে ধীরে উন্নতি লাভ করছে। স্বাধীনতার পর থেকে এই বাজারে স্বল্পমেয়াদি নগদ ঋণ, জমাতিরিক্তের ঋণ এবং চলতি ঋণ প্রদানের মাধ্যমে বাজারের ব্যাপ্তি, পরিধি ও ঋণ প্রবাহের মাত্রা কয়েকগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। আশির দশকের শেষভাগ থেকে মুক্ত বাজার ব্যবস্থায় বেসরকারি ব্যাংকসমূহের অংশগ্রহণ দেশের মুদ্রাবাজার ব্যবস্থায় প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করেছে। এর ফলে স্বল্পমেয়াদি ঋণপ্রবাহ এর ঋণ চাহিদার মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক ন্যূনতম দাম তথা সুদ/মুনাফা হার বজায় থাকে। জুন ২০২১ সাল নাগাদ ১০,৭৮৮টি ব্যাংক শাখা মুদ্রাবাজারে স্বল্পমেয়াদি ঋণের চাহিদা ও সরবরাহ ব্যবস্থায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে।
বাংলাদেশের মুদ্রাবাজার অনেক পরিবর্তন ও ক্রমবিকাশের মাধ্যমে বর্তমান অবস্থায় পৌঁছেছে। প্রথম অবস্থায় স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে মুদ্রাবাজার আর্থিক বাজারের একটি প্রধান অংশ ছিল। পুঁজি বাজার অর্থ বাজারের সামান্য অংশে পরিব্যাপ্ত ছিল। স্বাধীনতার পর সমস্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়। দেশের মুদ্রাবাজারের প্রগতি ও ক্রমবিকাশ ১৯৭১ সাল হতে আরম্ভ করে আশির দশকের শুরু পর্যন্ত সরকারের বিভিন্ন হস্তক্ষেপজনিত আইন এবং প্রবিধান দ্বারা পরিচালিত হয়। এজন্য মুদ্রাবাজারে মুক্ত বাজারের প্রকৃত অবস্থা প্রতিফলিত হয়নি। উক্ত সময়ে তফসিলী ব্যাংকের শাখা বিস্তারের মাধ্যমে দেশে একটি বড় আকারের আর্থিক কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয়। একই সময়ে সরকারি খাতে বিশেষায়িত আর্থিক প্রতিষ্ঠান আর্থিক সম্পদ আহরণের লক্ষ্যে এবং স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ও বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। বাজারে অংশগ্রহণকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে এ সময়ে নির্দেশিত ঋণপ্রদান পদ্ধতি, ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা এবং কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পূর্বনির্ধারিত সুদ-হার ব্যবস্থায় তাদের কার্যাবলি পরিচালনা করতে হতো। তলবি মুদ্রাবাজারের সুদহার নমনীয় ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক সহজ পুনঃঅর্থসংস্থান সুবিধা বলবৎ থাকার কারণে তলবি মুদ্রাবাজারের কার্যাবলি যথেষ্ট সীমিত পর্যায়ে থেকে যায়।
দেশের ব্যাংকিং খাতকে প্রতিযোগিতামূলক করণের প্রয়াসে উনিশ শতকের আশির দশকে দুটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক বেসরকারিকরণসহ বেশ কিছু বেসরকারি ব্যাংক স্থাপনের পদক্ষেপ নেয়া সত্ত্বেও নিয়ন্ত্রণমূলক ধারা অব্যাহত থাকার কারণে বাজারভিত্তিক কর্মকা- বিকাশে বাধাগ্রস্ত হয়। প্রয়োজনীয় আর্থিক হাতিয়ারের অভাবও বাজার বিকাশের অন্তরায় ছিল। তবে এসব পদক্ষেপের ফলে বাজারভিত্তিক মূল্য প্রতিফলন পূর্বক সঞ্চয় আহরণ ও সঞ্চালনে ব্যাংকসমূহের মধ্যে প্রতিযোগিতার একটা নতুন মাত্রা যোগ হয়। এ অবস্থায় উত্তরণের ফলে বাংলাদেশের মুদ্রাবাজার প্রথমবারের মতো একটা প্রতিযোগিতামূলক চরিত্রের রূপ ধারণ করে। পরবর্তীকালে সরকার অনেকগুলি দেশি-বিদেশি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদন দেয়। এই প্রক্রিয়ায় দেশে একটি স্পন্দনশীল মুদ্রাবাজার গড়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
উল্লেখ্য যে, উনিশ শতকের নব্বইয়ের দশকের পূর্বে প্রকৃত অর্থে দেশে কোনো মুদ্রাবাজার ছিল না। কারণ অধিকাংশ অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলির আপদকালীন সময়ের জন্য অর্থের একমাত্র উৎস ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল ভূমিকা ছিল অর্থনীতিতে অর্থের যোগান নিশ্চিতকরণ। ১৯৯০ সালে আর্থিক খাত সংস্কার কর্মসূচির উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে স্পন্দনশীল অর্থবাজার সৃষ্টির সুযোগ হয় যেখানে দীর্ঘমেয়াদে সৃষ্ট বাধাসমূহ অপসারণ করা হয়। নিয়ন্ত্রণমুক্ত ঋণ কার্যক্রম ও সুদহার ব্যবস্থা প্রবর্তন, অগ্রাধিকার খাতে ঋণ প্রদানের সংস্কৃতি রহিতকরণ, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে উদারভাবে পূর্ণ অর্থায়ন ব্যবস্থা বাতিলকরণ দেশে বাজারভিত্তিক আর্থিক কার্যক্রমের ভিত্তি সূচিত করে। এছাড়া আর্থিক খাত সংস্থার কর্মসূচির আওতায় গঠিত টিম দেশে বাজারভিত্তিক হাতিয়ার চালুর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য ব্যাপক গবেষণামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করে। পরিশেষে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার সংশোধনের পর নতুন ইন্সট্রুমেন্ট হিসেবে ৩০ দিন মেয়াদি ও ৯১ দিন মেয়াদি বাংলাদেশ ব্যাংক বিল প্রবর্তন করা হয়। বর্তমানে ৭ ও ১৪ দিন মেয়াদি বাংলাদেশ ব্যাংক বিলও চালু আছে। এ ছাড়া মুদ্রাবাজারের গতি ও উন্নয়ন ত্বরাণ্বিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন মেয়াদের নতুন সরকারি ট্রেজারি বিল প্রবর্তন করা হয়। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক সীমিত আকারে সার্টিফিকেট অব ডেপোজিট (ঈউ) চালু করে। এইভাবে মুদ্রাবাজার দেশের উন্নয়নের জন্য অনুঘটকের ভূমিকায় অগ্রযাত্রা সূচিত করে। একই সঙ্গে এ সময়ে বাণিজ্য ও বৈদেশিক মুদ্রা হারেও উদারীকরণের পদক্ষেপ নেওয়া হয় যা মুদ্রাবাজার উন্নয়নে নব দিগন্তের সূচনা করে।
দেশের অর্থবাজার ইতিহাসে একটি প্রধান ঘটনা হলো অর্থবছর ২০০৩-এ সরকারি সিকিউরিটিগুলি সেকেন্ডারি মার্কেটে অন্তর্ভুক্তকরণ। সেকেন্ডারি মার্কেট উন্নয়নের জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির জন্য রিপো ও রিভার্স রিপো চালু করা হয়। যথাযথভাবে তারল্য ব্যবস্থাপনার জন্য ব্যাংকসমূহ সরকারি ট্রেজারি বিল বন্ধক রেখে এই সমস্ত সুবিধা ব্যবহার করে। অধিকন্তু, প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি মার্কেটে সিকিউরিটিজগুলি লেনদেনের জন্য প্রথমবারের মতো প্রাইমারি ডিলার নিয়োগ করা হয়। বাজারে বর্তমানে (২০২০ পর্যন্ত) ২২টি প্রাইমারি ডিলার তাদের কার্যক্রম চালু রেখেছে।
ব্যাপকভাবে ব্যাংকিং খাত ও নন-ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান সম্প্রসারিত হলেও মুদ্রাবাজার মূলত দুইটি ভাগে বিভক্ত হয়ে আছে: (১) প্রাতিষ্ঠানিক ও (২) অপ্রতিষ্ঠানিক। প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি (২০২১ পর্যন্ত) হলো: বাংলাদেশ ব্যাংক (শীর্ষ), ৬টি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক, ৪২টি দেশীয় এবং ৯টি বিদেশি বেসরকারি ব্যাংক, ৩টি বিশেষায়িত (উন্নয়ন), ৩৫টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও অনেকগুলি অ-তফসিলী ব্যাংক। অ-প্রতিষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানগুলি হলো: মানি লেন্ডার এবং ছোট ছোট সমবায় সংগঠন যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। দেশের মুদ্রাবাজারের প্রধান উপাদান হলো- আন্তঃব্যাংক বাজার, কল-মানি বাজার, রিপো ও রিভার্স রিপো বাজার এবং বন্ড মার্কেট।
আশির দশকের শুরুতে বাংলাদেশের মুদ্রাবাজার দুটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বিরাষ্ট্রীয়করণ এবং কিছু বেসরকারি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করে। এই অগ্রগতির সাথে মুদ্রাবাজার দেশে প্রতিযোগিতামূলক বাজারের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। তারপরও নির্দেশিত সুদহার কাঠামো এবং অগ্রাধিকার ঋণদান পদ্ধতি দেশে একটি বাজারভিত্তিক মুদ্রাবাজার উন্নয়নে প্রতিবন্ধক হিসেবে বহাল ছিল। ২০২০ সালে দেশের মুদ্রাবাজারের কাঠামোতে বাংলাদেশ ব্যাংক (বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার ১৯৭২) এর আওতাধীন প্রতিষ্ঠানসমূহ হচ্ছে ৬টি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক (১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ বলে প্রতিষ্ঠিত), ৩টি বিশেষায়িত ব্যাংক (১৯৭৩ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত), ৪২টি দেশীয় বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক (১৯৮৩ থেকে ২০২০ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত), ৯টি বিদেশি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক, সরকারি ও বেসরকারি ৩৫টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন এর আওতাধীন ২টি স্টক এক্সচেঞ্জ, ১টি সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি কোম্পানি, ৬৬টি মার্চেন্ট ব্যাংক, ৫১টি এ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি, ১২টি সিকিউরিটিজ কাস্টডিয়ান এবং ৮টি ক্রেডিট রেটিং প্রতিষ্ঠান এবং বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ এর আওতাধীন ৩৫টি জীবন বীমা ও ৪৬টি সাধারণ বীমা প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা মুদ্রাবাজারের সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে।
১৯৯০ সালকে বাংলাদেশের মুদ্রাবাজার ক্রমবিকাশের একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করা যায়। ঋণ কার্যক্রমকে বিনিয়ন্ত্রণ করে, পুনঃঅর্থসংস্থান সুবিধাকে পুনঃবাট্টাকরণ সুবিধায় রূপান্তর করে এবং নির্দেশিত সুদহার কাঠামো বিলোপ করে দেশে একটি বাজারভিত্তিক আর্থিক কাঠামো প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এ সময় থেকে ব্যাপক আর্থিক খাত সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। পরবর্তীকালে বিভিন্ন প্রকারের মুদ্রাবাজার দলিল, যথা আমানত সার্টিফিকেট, এবং বিভিন্ন মেয়াদি (সর্বোচ্চ ৩৬৪ দিন মেয়াদি) সরকারি বিল প্রবর্তনের ফলে বাংলাদেশে মুদ্রাবাজার অগ্রগতির ধারা ত্বরান্বিত হয়। মুদ্রাবাজারে কাঙ্খিত মাত্রার তারল্য বজায় রাখার উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০০৯ সালে ৩০দিন মেয়াদি এবং ২০১৬ সালে ৭ দিন ও ১৪ দিন মেয়াদি বাংলাদেশ ব্যাংক বিল ইস্যু করে।
গঠন প্রকৃতি অনুযায়ী বাংলাদেশের মুদ্রাবাজারকে প্রধানত সংগঠিত ও অসংগঠিত এ দুভাগে ভাগ করা যায়। অসংগঠিত মুদ্রাবাজারে মহাজন ও সমবায় প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ-বহির্ভূত থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংক, তফসিলী ব্যাংক এবং অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে নিয়ে দেশে সংগঠিত মুদ্রাবাজার গড়ে উঠেছে। বিশ্বের অন্যান্য মুদ্রাবাজারের গঠনপ্রকৃতির ন্যায় বাংলাদেশের মুদ্রাবাজারেও তিনটি সুস্পষ্ট অবয়ব, যথা আন্তঃব্যাংক বাজার, তলবি মুদ্রাবাজার এবং বিল বাজার বিদ্যমান আছে।
আন্তঃব্যাংক আমানত এবং ঋণ হিসেবে স্বল্পমাত্রায় কার্যক্রম পরিচালনা করে। এর সুদহার ব্যাংকসমূহের মধ্যে স্বল্পমেয়াদি তহবিলের চাহিদা ও সরবরাহের মাত্রা এবং আন্তঃব্যাংক লেনদেন সম্পর্কের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়ে থাকে। ঐতিহ্যগতভাবে সাময়িক তহবিলের প্রয়োজনে তফসিলী ব্যাংকসমূহ পরস্পরকে ধার প্রদান এবং পরস্পর থেকে ধার গ্রহণ করে থাকে। মাঝে মাঝে ব্যাংকসমূহ তাদের আহরিত সম্পদের একটা অংশ অন্য কোন ব্যাংকের নিকট আমানত হিসেবে রাখে এবং আমানতের বিপরীতে প্রয়োজনে ধার গ্রহণ করে। তাছাড়া, ছোট ব্যাংকগুলি আমানত হিসেবে বড় ব্যাংকগুলির নিকট তাদের তহবিল নিরাপত্তার কারণে সংরক্ষণ করে থাকে।
অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহও ঘাটতি ব্যাংকসমূহকে তহবিল ধার প্রদানের সুবাদে দেশের আন্তঃব্যাংক বাজারে অংশগ্রহণ করে থাকে। আন্তঃব্যাংক আদান-প্রদান যদিও প্রধানত ঢাকা শহরে কেন্দ্রীভূত, দেশের অন্যান্য স্থানেও উক্ত আদান-প্রদান কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয়। তহবিল ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে ব্যাংকের শাখাসমূহ তাদের নিজস্ব প্রধান কার্যালয়ে যখন অতিরিক্ত তহবিল প্রেরণ করতে পারে না তখন উক্ত তহবিল সাধারণত নিকটবর্তী বড় অফিস বা অন্য কোন ব্যাংকে সংরক্ষণ করে এবং প্রয়োজনে ব্যবহার করে। লক্ষণীয় যে, কোন কোন ব্যাংক আধুনিক দায় ও সম্পদ ব্যবস্থাপনার অভাবে আন্তঃব্যাংক বাজার থেকে বড় অঙ্কের টাকা ঋণ গ্রহণ করে থাকে।
আন্তঃব্যাংক আদান-প্রদান মুদ্রাবাজারের অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়া সত্ত্বেও এটি সমগ্র ব্যাংকিং কার্যক্রমের একটি সামান্য অংশরূপে ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৯ সময়কালে আন্তঃব্যাংক আমানত ব্যাংক ব্যবস্থার সমগ্র আমানতের মাত্র শতকরা ২ থেকে ৫ ভাগে পরিব্যাপ্ত ছিল। আর্থিক খাত সংস্কার কর্মসূচির বাস্তবায়ন সময়কালে (১৯৯০-৯৬) আরও হ্রাস পেয়ে ১.৬ শতাংশ থেকে ২.৫ শতাংশে বিদ্যমান ছিল। এরপরে আন্তঃব্যাংক আমানত বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং ডিসেম্বর ১৯৯৭ শেষে ৪.৯ শতাংশে দাঁড়ায়। তবে ২০০১-২০১০ মেয়াদে আন্তঃব্যাংক আমানতের পরিমাণের গড় হার ছিল মোট আমানতের শতকরা ৩.৪ ভাগ যা ২০১১-২০২০ মেয়াদে কমে দাঁড়ায় শতকরা ২.৪ ভাগে। সর্বশেষ জুন ২০২০ মাসে মোট আন্তঃব্যাংক আমানতের পরিমাণ ছিল ৪০০.৫ বিলিয়ন টাকা যা একই সময়ে মোট আমানতের ২.৫ ভাগ। কোভিড অতিমারিজনিত স্বল্প ঋণ চাহিদার কারণে জুন ২০২০ মাস শেষে ব্যাংকিং খাতে অতিরিক্ত তারল্য বেড়ে দাঁড়ায় ১.৪ ট্রিলিয়ন টাকা।
ব্যাংকের আমানত ১৯৮৬ সালের জুন থেকে ১৯৯১ সালের জুন পর্যন্ত ১২২.৬ বিলিয়ন টাকা বা বার্ষিক গড়ে ২২ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ১৯৯১ সালের জুন থেকে ১৯৯৮ জুন পর্যন্ত আমানতের বার্ষিক গড় বৃদ্ধির হার ছিল ১৮ শতাংশ। মুদ্রাবাজারের অনুন্নত অবস্থা দেশের আমানত প্রবৃদ্ধির ধারা থেকে প্রত্যক্ষ করা যায়। সুদহার কাঠামো হ্রাস করা সত্ত্বেও উক্ত সময়ে দেশের আমানত সম্পদ বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা যায়।
মুদ্রাবাজারের দলিল হিসেবে বাংলাদেশে আমানত সার্টিফিকেট ১৯৮৩ সালে প্রবর্তন করা হয়। মুদ্রাবাজারে এ দলিল প্রচলনের উদ্দেশ্য ছিল মুদ্রাবাজারকে শক্তিশালী করা এবং অব্যবহৃত তহবিলকে ব্যাংক ব্যবস্থার আওতায় আনা। কালো টাকা এবং অনার্জিত আয় দেশের বৃহত্তর আর্থ-সামাজিক উপকারে আনার চেষ্টা করা হয়। উৎপাদনের উদ্দেশ্যে ব্যবহার এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রতি হুমকি হ্রাস করার লক্ষ্যে কালো টাকা আহরণের প্রচেষ্টা গৃহীত হয়। বাহক-আমানত সার্টিফিকেট নির্দিষ্ট মেয়াদে বাংলাদেশি নাগরিক, শিল্প প্রতিষ্ঠান ও কোম্পানির নিকট ব্যাংক কর্তৃক ইস্যু এবং পরিশোধযোগ্য। আমানত সার্টিফিকেটে ক্রেতা বা বাহকের নাম উল্লেখ করা থাকে না। সুদহার অন্যান্য আমানতের ন্যায় নির্ধারিত হয় না। আমানত সার্টিফিকেটের সুদহার সার্টিফিকেট ইস্যুর দিনে মুদ্রাবাজারে তহবিলের চাহিদা ও সরবরাহের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হয়। আমানত সার্টিফিকেটের অভিহিত মূল্য এবং পূর্বে পরিশোধযোগ্য সুদের পার্থক্য ব্যাংক কর্তৃক ইস্যুর সময় গৃহীত হয়। আমানত সার্টিফিকেটের বাহক অন্য ক্রেতার নিকট তা বিক্রয় করতে পারে। সার্টিফিকেটের নম্বর, সুদহার, বিক্রয়ের তারিখ এবং নগদায়নের তারিখ ব্যতীত অন্যকোন তথ্য ব্যাংক লিপিবদ্ধ করে রাখে না। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত অভিহিত মূল্যের ওপরে কোন ব্যাংক কোন আমানত সার্টিফিকেট ইস্যু করতে পারে না।
২০০০-২০১০ সময়কালে আন্তঃব্যাংক বাজারে (inter-bank market) কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। গচ্ছিত অর্থের প্রত্যয়নপত্র the Certificate of Deposit) বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এই সময়কালে ব্যাংকের আমানত গড়ে ৩০ শতাংশের বেশি বেড়ে গিয়েছিল যা দেশের আর্থিক খাতের গভীরতা বৃদ্ধির নিদর্শক। অতি সক্রিয় কল মার্কেটের প্রচলন এবং বিল/বন্ডের জন্য সেকেন্ডারি বাজারের সুযোগ উন্মুক্ত হওয়ায় প্রথাগত অর্থে আন্তঃব্যাংক বাজারের তাৎপর্য তার গুরুত্ব হারায় যা আন্তঃব্যাংক বাজারে ক্ষুদ্র আকারের লেনদেনে প্রতিফলিত হয়।
তলবি মুদ্রাবাজার সমগ্র মুদ্রাবাজারের একটি সংবেদনশীল অংশ যেখানে ব্যাংক এবং অ-ব্যাংক আর্থিক খাত থেকে অনেক প্রতিষ্ঠান নিয়মিত অংশগ্রহণ করে থাকে। প্রাথমিকভাবে এ বাজার আন্তঃব্যাংক বাজার হিসেবে গড়ে ওঠে। ব্যাংকসমূহ সাময়িক তহবিল ঘাটতির সময়ে সাধারণত অন্য ব্যাংক থেকে যাদের উদ্বৃত্ত তহবিল আছে, ধার গ্রহণ করে। উনিশ শতকের আশির দশকের শুরুতে ব্যাংকসমূহ যেহেতু সরকারি খাতে ছিল তখন বাংলাদেশ ব্যাংক হতে রেয়াতি হারে পুনঃঅর্থসংস্থান সুবিধা গ্রহণ করত। এ সময়ে ব্যাংকসমূহের তলবি মুদ্রাবাজার হতে তহবিল সংগ্রহ করার প্রয়োজনীয়তা তেমন ছিল না। তাছাড়া, নির্দেশিত সুদহার কাঠামো, কেন্দ্রীয় ব্যাংক হতে সহজে ধার গ্রহণের সুবিধা এবং অগ্রাধিকার খাতে ঋণ প্রদানের নির্দেশ ইত্যাদি বাংলাদেশের তলবি মুদ্রাবাজার উন্নয়নের প্রধান বাধা ছিল। এতদসত্ত্বেও, ব্যাংকসমূহ তাদের দায়-সম্পদের সাময়িক গরমিল দূর করার জন্য তলবি মুদ্রাবাজারে আংশিক অংশগ্রহণ করত।
১৯৮৩ ও ১৯৮৪ সালে উত্তরা ও পূবালী ব্যাংক বিরাষ্ট্রীয়করণ এবং বেসরকারি খাতে ব্যাংক ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য নতুন ব্যাংককে অনুমতি প্রদানের মাধ্যমে বাংলাদেশে তলবি মুদ্রাবাজারের পরিবর্তনের ধারা শুরু হয়। পরবর্তীকালে, আশির দশকে আরও বেসরকারি ব্যাংকের অনুপ্রবেশে মুদ্রাবাজারের এ অংশটি উন্নয়নের নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়। তাছাড়া, ১৯৮৫ সালে দুটি বিনিয়োগ কোম্পানি এবং ১৯৮৯ সালে একটি লিজিং কোম্পানিকে মুদ্রাবাজারে অংশগ্রহণের অনুমতি প্রদান করা হয়।
আর্থিক খাত সংস্কার কর্মসূচির আওতায় মুক্তবাজার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রচলনের ফলে তলবি বাজারে অধিক প্রতিযোগিতামূলক অবস্থা তৈরি হয়। সুদহার কাঠামোর বিনিয়ন্ত্রণ, অগ্রাধিকার ঋণদান কর্মসূচির বিলোপ, ঋণপ্রদান ও আমানত সংগ্রহে ব্যাংকসমূহের স্বাধীনতা, বেসরকারি ব্যাংক এবং অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান যথা লিজিং কোম্পানি, আর্থিক এবং বিনিয়োগ কোম্পানিসমূহের উত্তরোত্তর সংখ্যাবৃদ্ধি দেশের তলবি মুদ্রাবাজারের সাবলীল উন্নয়নের ধারা সুচিত করে। বর্তমানে বিশেষায়িত ব্যাংক এবং অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ সমস্ত ব্যাংককে তলবি মুদ্রাবাজারে অংশগ্রহণের অনুমতি প্রদান করা হয়েছে। তলবি মুদ্রাবাজারের মৌলিক বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নরূপ:
তলবি মুদ্রাবাজারের আদান-প্রদান প্রধানত ঢাকাভিত্তিক। সমস্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান অফিস ঢাকায় অবস্থিত। দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শাখাসমূহের অতিরিক্ত তহবিল ঢাকায় তাদের নিজস্ব প্রধান অফিসে বিনিয়োগের জন্য পাঠায়। প্রধান কার্যালয়সমূহ তাদের সচরাচর তারল্য চাহিদা মেটানোর পর অতিরিক্ত তহবিল তলবি মুদ্রাবাজারে বিনিয়োগ করে থাকে।
যেহেতু ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য কোন দালাল বা মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান নেই, সেজন্য তলবি মুদ্রাবাজারে আদান-প্রদান সাধারণত দ্বিপাক্ষিক আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে স্থির করা হয়। যেহেতু তলবি ঋণ কোন জামানত ছাড়াই প্রদান করা হয়, ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ধার গ্রহণকারী ব্যাংক/প্রতিষ্ঠানকে বাছাই করতে সবসময়েই সতর্ক থাকে।
বিদেশি ব্যাংকসমূহ তলবি মুদ্রাবাজারে তারল্য সরবরাহের প্রধান উৎস। দেশীয় ব্যাংকের তুলনায় বিদেশি ব্যাংকের তহবিল সংগ্রহের খরচ খুব কম হওয়ায় বিদেশি ব্যাংকগুলি তলবি মুদ্রাবাজারে ঋণ প্রদানের জন্য অতিরিক্ত তারল্য ধারণ করতে পারে। ধার গ্রহণেও বিদেশি ব্যাংকগুলি দেশীয় ব্যাংকের তুলনায় সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। বিদেশি ব্যাংকগুলিতে দেশীয় ব্যাংক এবং জাতীয়করণকৃত ব্যাংকের তুলনায় তাদের পোর্টফোলিওতে কম পরিমাণ অনাদায়ি ব্যাংক ঋণ আছে। স্থানীয় বেসরকারি ব্যাংকগুলি তলবি মুদ্রাবাজার হতে নিয়মিত ঋণ গ্রহণ করে থাকে।
বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থায় তথ্যকাঠামো এখনও সেকেলে। এজন্য তহবিলের চাহিদা ও সরবরাহ তথ্য বাজারে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের নিকট সুস্পষ্ট নয়। উদ্বৃত্ত তহবিলের অধিকারী ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ দেশীয় ঘাটতি ব্যাংকসমূহের এই অসম্পূর্ণ বাজার পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করে থাকে।
বাংলাদেশ ব্যাংক তলবি মুদ্রাবাজারে ঋণ গ্রহণ ও প্রদানকারী ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কিছু নির্দেশ জারি করেছে। যদিও তলবি মুদ্রাবাজারে অংশগ্রহণের কোন বাধ্যবাধকতা নেই, ধার গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের তারল্য পরিস্থিতি, ধার পরিশোধের ক্ষমতা এবং ধার পরিশোধের উৎস বিবেচনা করে ব্যাংকসমূহকে তলবি মুদ্রাবাজারে ধার প্রদানের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
তলবি বাজারে তহবিলের চাহিদা ও সরবরাহ মাঝে মাঝে অশান্ত থাকার পর সারাবছর পরিবর্তনশীল থাকে। তলবি মুদ্রাবাজারের আদান-প্রদান এবং সুদের হার সরকারি ট্রেজারি বিল বাজার, ব্যাংক ঋণের মৌসুমি চাহিদা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি, পুনর্বাট্টা হার, খোলা বাজার কার্যক্রম, সংবিধিবদ্ধ তহবিল সংরক্ষণ আবশ্যকতার পরিবর্তন, ব্যাংকের অতিরিক্ত তারল্য পরিস্থিতি ইত্যাদির সাথে জড়িত। তলবি মুদ্রাবাজারের আদান-প্রদান ও সুদহারের ওঠানামা সাধারণত নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বেশি থাকে এবং এজন্য এ সময়ে সুদের হার বৃদ্ধি পায়।
আন্তঃব্যাংক বাজারের অনুন্নত অবস্থা তলবি মুদ্রাবাজারে সুদের নিম্ন ও উচ্চ হারের ব্যবধানের মধ্যে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। সেপ্টেম্বর, ১৯৮৫ থেকে জুন, ১৯৯২ পর্যন্ত সময়কাল তলবি মুদ্রাবাজারের সুদের সর্বনিম্নহার ছিল ব্যাংক হারের উপরে। তলবি মুদ্রাবাজারের একটি বিশেষ দিক এই যে, আর্থিক খাত সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন সময়কালে তলবি মুদ্রাবাজারে সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ সুদহারের ব্যবধান বেশি ছিল। এ অবস্থার উদ্ভব এ কারণে হয়েছিল যে, আর্থিক খাত সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নকালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হতে সহজ পুনঃঅর্থসংস্থান সুবিধা বিলোপের ফলে ব্যাংকসমূহের বাংলাদেশ ব্যাংক ছাড়া অন্যকোন উৎস হতে তহবিল সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পায়। এরপর আন্তঃব্যাংক তলবি বাজারের সুদহার ব্যাংক হারের নি¤েœ অবস্থান করে। ব্যাংকসমূহের অতিরিক্ত নগদ রিজার্ভ বৃদ্ধির সাথে সাথে আন্তঃব্যাংক তলবি মুদ্রাবাজারের সুদহার সে অনুসারে পরিবর্তিত হয়েছিল। অভিজ্ঞতা হতে দেখা যায় যে, ব্যাংকসমূহে যখন যথেষ্ট অতিরিক্ত নগদ তহবিল থাকে তখন আন্তঃব্যাংক সুদহার হ্রাস পায়, কিন্তু ব্যাংকসমূহের অতিরিক্ত নগদ তহবিল হ্রাসের সাথে সাথে আন্তঃব্যাংক সুদহার বৃদ্ধি পায়। সাধারণভাবে বিদেশি ব্যাংকসমূহ এবং বিশেষ করে ইসলামি ব্যাংকসমূহ রাষ্ট্রায়ত্ত ও দেশি সরকারি ব্যাংকসমূহের তুলনায় অধিক পরিমাণে অতিরিক্ত নগদ তহবিল সংরক্ষণ করে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশি ব্যাংকগুলিই আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারের তহবিল সরবরাহের প্রধান উৎস। আর্থিক খাত সংস্কার কর্মসূচি প্রবর্তনের পূর্বে আন্তঃব্যাংক বাজারে বিশ্বাসযোগ্যতার কিছুটা হ্রাস ঘটায় এবং প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশ অনুযায়ী বিদেশি ব্যাংকসমূহ আন্তঃব্যাংক বাজারে ঋণ প্রদানের চেয়ে অধিক পরিমাণে তারল্য সংরক্ষণ করতে পছন্দ করত। তাছাড়া, ধার প্রদান ও গ্রহণকারী ব্যাংকসমূহের মধ্যে তথ্যে ব্যবধানও আন্তঃব্যাংক বাজার আদান-প্রদানকে নিরুৎসাহিত করত।
১৯৯৭ সালে আন্তঃব্যাংক তলবি বাজারের সুদের হার সর্বোচ্চ শতকরা ২২.৯ ভাগে পৌঁছে। সর্বোচ্চ হারের রেকর্ড দেখা যায় ২০০২ সালে শতকরা ৩৫.৪ ভাগ, ২০০৩ সালে শতকরা ৩৫.০ ভাগ, ২০০৪ সালে শতকরা ৫৪.৭ ভাগ, ২০০৫ সালে শতকরা ১২০.০ ভাগ এবং ২০১০ সালে শতকরা ১৯০.০ ভাগ পৌঁছে। তবে সর্বোচ্চ হারের রেকর্ডগুলি সাময়িক আকষ্মিকতা এবং স্বল্প পরিমাণের জন্য ছিল বিধায় উচ্চহারগুলি বাজার প্রতিনিধিত্বমূলক ছিল না। ২০১৩ সালের পর থেকে সর্বোচ্চ হার একক ঘরের উপরে ওঠেনি। জুন ২০২১ মাসে আন্তঃব্যাংক তলবি মুদ্রাবাজারের গড় হার ছিল শতকরা ২.২৫ ভাগ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি পরিবর্তন এবং কতিপয় অনাকাঙিক্ষত বিষয় উপস্থিতির ফলে অর্থবছর ২০০১ থেকে অর্থবছর ২০০৬ এই সময়কালে কল মানি মার্কেটে সবচেয়ে বেশি অস্থিরতা পরিলক্ষিত হয়। বৈদেশিক মুদ্রা ক্লিয়ারিং একাউন্টে রক্ষিত ব্যালেন্সের পরিবর্তে কেবল দেশীয় মুদ্রায় নগদ জমার হিসাবায়ন (CRR) বাধ্যতামূলককরণের নতুন পদ্ধতি প্রচলন, অভ্যন্তরীণ বাজার হতে সরকারের বর্ধিত ঋণ গ্রহণ এবং বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা বৃদ্ধি কলমানির হার উঠানামার পেছনে উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পর্যাপ্ত তারল্য সহায়তা পাওয়া সত্ত্বেও প্রাথমিক ডিলারদের (Primary Dealers) আচরণও এর জন্য অনেকটা দায়ী। কারণ তারা যোগ্য (deserving) ব্যাংকসমূহকে রিপো সুবিধা দেওয়ার চাইতে বরং উচ্চ হারে কল মার্কেটে ধার দেয়ায় বেশি আগ্রহী ছিল। একইসাথে স্থানীয় বেসরকারি ব্যাংকসমূহের যাদের পরিমাণ নন-পারফরমিং ঋণ এবং পুঁজি স্বল্পতা রয়েছে তাদের পক্ষে বাজারে প্রবেশাধিকার এত সহজ ছিল না। বাজারের এই বিভাজনের কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসমূহ সহ সবল ব্যাংকসমূহ কল মার্কেটের মাধ্যমে ঐ সকল ব্যাংকসমূহকে ধার দিতে অনাগ্রহী ছিল। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিতব্য নগদ সম্পদের বাধ্যবাধকতা Reserve Requirements পূরণে অপারগ ব্যাংকসমূহ বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর শাস্তি এড়ানোর জন্য প্রায়ই মধ্যস্বত্ত্বভোগী (broker) ব্যাংকসমূহ থেকে উচ্চ হারে ঋণ নিতে বাধ্য হয়। অধিকন্তু, নিয়ন্ত্রণমুক্ত ব্যবস্থার (deregulated regime) আওতায় অনেক ব্যাংক উচ্চাভিলাসী (aggressive) ও সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের প্রয়াসে তারল্য পরিপক্ক পরিলেখা (liquidity maturity profile) বিবেচনা না করে তাদের অতিরিক্ত ফান্ড ব্যবহার করতে থাকে। যখনই এ সকল ব্যাংক তারল্য স্বল্পতার সম্মুখীন হয় তখনই তারা সুদের হারের উচ্চ প্রভাব বিবেচনা না করে বাজারে ভিড় জমায়।
বিল বাজার সরকারি ট্রেজারি বিল ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আগে এটি পূর্বনির্ধারিত সুদহারে তিন মাস মেয়াদি সরকারি ট্রেজারি বিল আদান-প্রদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ব্যাংকিং কোম্পানি অ্যাক্ট অনুযায়ী তফসিলী ব্যাংকসমূহ অনুমোদিত জামানতপত্র হিসেবে তাদের সংবিধিবদ্ধ তারল্য সংরক্ষণের আবশ্যকতা পূরণের জন্য এ সমস্ত বিল ক্রয় করতে বাধ্য ছিল। তদুপরি, ব্যাংকিং খাত হতে অতিরিক্ত নগদ তারল্য তুলে নেওয়া এবং সরকারের বাজেট ঘাটতি পূরণের জন্য ব্যাংক ব্যবস্থা হতে ধার গ্রহণে সাহায্য করতে এ সমস্ত দলিল ব্যবহার করা হতো। বাস্তবিক পক্ষে এ ছিল সরকারি ঋণের নিদর্শনাপত্রের বাজার যেখানে আসল ও সুদ সরকার কর্তৃক জামিনদারকৃত। বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের পক্ষে ট্রেজারি বিল ক্রয় ও বিক্রয় ব্যবস্থার সম্পূর্ণ দায়িত্বে ছিল। সরকারি ট্রেজারি বিলের প্রাপ্যতা সরকারের রাজস্ব কার্যক্রমের ওপর নির্ভরশীল ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিলের সরবরাহ হ্রাস ও বৃদ্ধি করার কোন সুযোগ ছিল না। তাছাড়া, বিলের সুদহার বাজারভিত্তিক ছিল না এবং সময় সময় সরকার কর্তৃক একতরফাভাবে নির্ধারণ করা হতো। তফসিলী ব্যাংক ছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংককেও সরকারি ট্রেজারি বিলের একটা অংশ ধারণ করতে হতো।
অপরপক্ষে, শিল্পায়নের শ্লথগতি এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে ধীর প্রবৃদ্ধির কারণে দেশে বাণিজ্যিক বিলপত্রের বাজার খুব সীমিত থেকে যায়। প্রথা অনুযায়ী তফসিলী ব্যাংকসমূহ প্রধানত দুই ধরনের বাণিজ্যিক বিল, যথা- অভ্যন্তরীণ বিল ও রপ্তানি বিল অর্থায়ন করে আসছে। এ বিলগুলি বাজারজাত করা যায় এবং প্রতিযোগিতামূলক হারে বাজারে পুনঃবিক্রয় করা যায়। সাধারণত এ বিলের বাহক ব্যাংকের নিকট নগদ তহবিলের জন্য বিক্রয় করে। বিলের অভিহিত মূল্য থেকে সংগ্রহের মাশুল এবং বিলের অবশিষ্ট সময়ের সুদ বাদ দিয়ে ব্যাংক বিলের বাহককে মূল্য প্রদান করে থাকে। ব্যাংক ব্যবস্থায় নগদ ঋণ প্রদানের প্রচলন সক্রিয় বাণিজ্যিক বিল বাজার উন্নতির পথে প্রধান অন্তরায় বলে প্রতীয়মান হয়। স্ট্যাম্প শুল্ক, পদ্ধতিগত অসুবিধা এবং বিলের প্রাপক কর্তৃক অতিরিক্ত দলিল সম্প্রদানের অনীহা বাণিজ্যিক বিল বাজার উন্নয়নের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। তবে আর্থিক খাত সংস্কার কর্মসূচি প্রবর্তনের সাথে দেশে বাণিজ্যিক বিল বাজার ক্রমান্বয়ে উন্নত হচ্ছে। এটি বাংলাদেশের বিল বাজারে নতুন দিগন্তের সূচনা করে। বাংলাদেশ ব্যাংক মাসিক নিলামে ১০০ টাকা সমমূল্যে বাট্টায় বিলটি ছাড়ে। ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্যের মধ্যে ব্যক্তি, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, কোম্পানি ও কর্পোরেশন হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক বিলে বিনিয়োগের যোগ্য। প্রথমত বিলটি মুদ্রানীতির চাহিদা অনুযায়ী ব্যাংক ব্যবস্থার তারল্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য চালু করা হয়। মাধ্যমিক বাজার উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক খোলা বাজার কার্যক্রম চালুর উদ্দেশ্যেও বিলটি ছাড়া হয়। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ ব্যাংক ৩০দিন মেয়াদি বাংলাদেশ ব্যাংক বিল চালু করে। এ বিলগুলির নিলামের সংগঠন সময় বৃদ্ধি করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের নিয়মিত নিলাম সত্ত্বেও, বাজারে সরকারি ট্রেজারি বিলের আদান-প্রদান অব্যাহত থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংক বিলকে সংবিধিবদ্ধ তারল্য সংরক্ষণের জন্য অনুমোদিত জামানত হিসেবে ঘোষণার পর বিলটির নিলাম স্থগিত করা হয়। অপরদিকে, চার প্রকার সরকারি ট্রেজারি বিলের, যথা ৩০ দিন, ৯০ দিন, ১৮০ দিন এবং ১ বছর মেয়াদি বিলের নিলাম সাপ্তাহিক ভিত্তিতে ১৯৯৮ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়। এ ট্রেজারি বিলগুলি পরবর্তীতে নতুন প্রবর্তিত ২৮ দিন, ৯১ দিন, ১৮২ দিন, ৩৬৪ দিন, ২ বছর এবং ৫ বছর মেয়াদি সরকারি ট্রেজারি বিল দ্বারা ১৯৯৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বর থেকে প্রতিস্থাপন করা হয়।
যদিও ২০১০ সাল পর্যন্ত ট্রেজারি বিলের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে, তবুও এখন পর্যন্ত এটি মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পরিবর্তনের অংশ হিসাবে ২০০৪ সালে ৫ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বিলের নিলাম স্থগিত করা হয়। ফরাসি ট্রেজারি বিল নিলামের পদ্ধতি অনুসারে বিলসমূহ ইস্যু করার ব্যবস্থা করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় সর্বনিম্ন ঈল্ড থেকে শুরু করে নিলামের জন্য ঘোষিত পরিমাণ ট্রেজারি বিলের সম্পূর্ণটাই নিলামে অংশ গ্রহণকারীদের ইস্যু করা হয়। কাট অব ঈল্ডে নিলাম ডাকে অংশ গ্রহণকারীদের মধ্যে আনুপাতিক হারে আংশিক বিল বরাদ্দ দেয়া হয়। ট্রেজারি বিল বাজারের আর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে ২০০৩ সালের ২০ অক্টোবর থেকে এ হাতিয়ারসমূহ ইলেক্ট্রনিক রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে লেনদেন হচ্ছে। ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ট্রেজারি বিলের ক্রয়-বিক্রয় এবং স্থানান্তর প্রক্রিয়া অনলাইন পদ্ধতিতে সম্পন্ন হচ্ছে। এই সমস্ত নতুন বিপণন কৌশল এবং ব্যবস্থাপনা দেশের আর্থিক বাজারের ভিত্তিকে প্রশস্ত এবং গভীরতর করণে সহায়ক হবে। তারিখ এবং পরিমাণ সম্বলিত নিলাম পঞ্জিকা প্রকাশের মাধ্যমে ট্রেজারি বিলের বাজার ভিত্তিক কার্যক্রম ২০০৭ সালে শুরু হয়। তাছাড়া, ট্রেজারি বিলের প্রচলিত ধারাকে আন্তর্জাতিক প্রথার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার জন্য ২ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বিলের নিলাম বন্ধ করা হয়েছে। অধিকন্তু ৩০ দিন মেয়াদি বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের সাথে সাদৃশ্য থাকায় ওভার ল্যাপিং এড়াতে ২৮ দিন মেয়াদি সরকারি ট্রেজারি নিলাম ২০০৮ সালের ১ জুলাই হতে বন্ধ করা হয়েছে। এর ফলে বাজারে ৯১ দিন, ১৮২ দিন এবং ৩৬৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিল চালু থাকে। মুদ্রাবাজারে কাঙ্খিত মাত্রার তারল্য বজায় রাখার উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০০৯ সালে ৩০দিন মেয়াদি এবং ২০১৬ সালে ৭ দিন ও ১৪ দিন মেয়াদি বাংলাদেশ ব্যাংক বিল ইস্যু করে যা এখনও প্রচলিত আছে। সরকারের ব্যয় কর্মসূচিতে অর্থায়নের জন্য অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে দীর্ঘ অর্থসংস্থানের জন্য ষান্মাসিক সুদ কুপনভিত্তিক ৫ বছর, ১০ বছর, ১৫ বছর এবং ২০ বছর মেয়াদি বাংলাদেশে সরকার ট্রেজারি বন্ডের প্রচলন করা হয়েছে যা মুদ্রাবাজারে ক্রয় বিক্রয় হয়। ভিন্ন ভিন্ন নিলামে ধার্যকৃত ঈল্ডভিত্তিক এ সমস্ত বন্ড ২০০৭ সাল থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রেতার চাহিদানুযায়ী অভিহিত মূল্যে প্রতিটি এককের গুণিতক হিসেবে নিলামে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ইস্যু করে আসছে। এ সমস্ত বন্ড রেপো সুবিধা গ্রহণের জন্য জামানত হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
বিল বাজারের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ যদিও বিল মার্কেট এখনও ব্যাপকভাবে সীমাবদ্ধ গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ, তবুও বিধিবদ্ধ তারল্য আবশ্যকতার বাধ্যবাধকতাহীন আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বৃহৎ কর্পোরেট অথবা নন-কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান, আধাসরকারি অথবা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান যাদের সাময়িক উদ্ভূত তহবিল রয়েছে অথবা যাদের ভবিষ্য তহবিল রয়েছে তারা প্রতিযোগিতা বহির্ভূতভাবে সরকারি ট্রেজারি বিলে বা বন্ডের নিলামে অংশ গ্রহণের মাধ্যমে উক্ত অর্থ বিনিয়োগ করতে পারে। এভাবে সাম্প্রতিক সময়ে বিল বা বন্ড বাজারের আওতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অংশের সেকেন্ডারি মার্কেটের পরিধিও আস্তে আস্তে বিকাশমান যা হাতিয়ারসমূহের তারল্যহীনতাকে দূর করবে। এই হাতিয়ায়সমূহ সরকারের ঋণ চাহিদার ভিত্তিতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের কাছে নিলামের মাধ্যমে বিক্রি হয়। [সৈয়দ আহমেদ খান এবং এ. সামাদ সরকার]