ঘোষ, অরবিন্দ
ঘঘোষ, অরবিন্দ (১৮৭২-১৯৫০) জাতীয়তাবাদী নেতা, আধ্যাত্মিক সাধক, দার্শনিক। ১৮৭২ সালের ১৫ আগস্ট কলকাতায় তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা কৃষ্ণধন ঘোষ ছিলেন বিলেতফেরত ডাক্তার এবং মাতা স্বর্ণলতা ছিলেন কলকাতার প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব রাজনারায়ণ বসুর জ্যেষ্ঠা কন্যা। পাশ্চাত্য ভাবধারায় গড়ে তোলার লক্ষ্যে পিতা অরবিন্দকে প্রথমে দার্জিলিঙে ইংরেজি স্কুলে এবং পরে বিলেতে সেন্ট পলস স্কুলে শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। তিনি কেমব্রিজ থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কিংস কলেজে অধ্যয়ন করেন। ১৮৯০ সালে অরবিন্দ ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন, কিন্তু শিক্ষানবিশকালে অশ্বচালনা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করায় সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত হন।
বিলেতে থাকা অবস্থায় অরবিন্দ সংবাদপত্রের মাধ্যমে ভারতে ব্রিটিশ অপশাসনের কথা জানতে পেরে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তখন থেকেই তাঁর অন্তরে ভারতকে বিদেশি শাসনমুক্ত করার বাসনা জাগ্রত হয়। তিনি ১৮৯৩ সালে দেশে ফিরে বরোদা এস্টেটে চাকরিতে যোগদান করেন। ১৯০০ সালে বরোদা কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক এবং ১৯০৪ সালে অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। অরবিন্দ বরোদায় বিপ্লবী গুপ্ত সংগঠনের সংস্পর্শে আসেন এবং অনুজ বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে বিপ্লবীমন্ত্রে দীক্ষিত করে ওইরূপ দল গঠনের জন্য বাংলায় প্রেরণ করেন। এ সময় স্বরাজ আন্দোলন-এর সূত্রপাত হলে অরবিন্দ তা পূর্ণভাবে সমর্থন করেন।
অরবিন্দের রাজনৈতিক আদর্শ ও কর্মপন্থার তিনটি দিক ছিল: এক. গুপ্ত বৈপ্লবিক প্রচারকার্য চালানো এবং সশস্ত্র বিদ্রোহের প্রস্ত্ততি হিসেবে সংগঠন গড়ে তোলা; দুই. সমগ্র জাতিকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্ত্তত করার উদ্দেশ্যে প্রচারকার্য চালানো এবং তিন. অসহযোগ ও প্রতিরোধের মাধ্যমে বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করা।
ব্রিটিশ শাসনের কঠোর দমননীতির প্রতিক্রিয়া হিসেবে বাংলায় সন্ত্রাসবাদ গড়ে উঠলে অরবিন্দ আপস নয় (১৯০৩) নামে একটি বই লিখে বিপ্লবী দলের সদস্যদের মধ্যে গোপনে প্রচার করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে স্বদেশী আন্দোলন শুরু হলে বরোদার চাকরি ছেড়ে তিনি বাংলায় আসেন এবং জাতীয় কংগ্রেসের বিভিন্ন কর্মকান্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। তিনি ১৯০৬ সালে কলকাতায় জাতীয় কলেজের (বর্তমান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়) প্রথম অধ্যক্ষ ও বিপিনচন্দ্র পালের বন্দেমাতরম্ ইংরেজি সংবাদপত্রের সম্পাদক হন। এ পত্রিকায় জনৈক পাঠকের রাজদ্রোহী বক্তব্য প্রকাশিত হলে ১৯০৭ সালে অরবিন্দ ও বিপিনচন্দ্র পাল অভিযুক্ত হন। বিপিনচন্দ্রের ছয়মাস জেল হয় এবং অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় অরবিন্দ মুক্তি পান। পাঁচ বছর (১৯০৬-১৯১০) সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িত থেকে তিনি কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদী নেতা ও বিপ্লবী দলের নেপথ্য নায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল ম্যাজিস্ট্রেট কিংস ফোর্ডকে হত্যার উদ্দেশ্যে বোমা মারা হলে রেলগাড়ির আরোহী দুজন ইউরোপীয় মহিলা নিহত হয়। এ অপরাধে ৩ মে অরবিন্দকে গ্রেফতার করা হয় এবং ৯ মে পুলিশ অস্ত্রশস্ত্র, বোমা ও অন্যান্য কাগজপত্রসহ বারীন ও তাঁর সঙ্গীদের গ্রেফতার করে। তাঁদের সকলের বিরুদ্ধে আলিপুর বোমা মামলা শুরু হয়। মামলার রায়ে কারও কারও শাস্তি হয়, কিন্তু অরবিন্দ শেষপর্যন্ত নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে মুক্তি পান (৬ মে ১৯০৯)।
জেলে থাকা অবস্থায় অরবিন্দের জীবনে পরিবর্তন শুরু হয়। তিনি আধ্যাত্মিক সাধনার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ১৯১০ সালে রাজনীতি ত্যাগ করে পন্ডিচেরী গমন করেন এবং সনাতন ধর্ম প্রচার ও আশ্রম প্রতিষ্ঠার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এভাবে বিপ্লবী অরবিন্দ ‘ঋষি অরবিন্দে’ পরিণত হন। পন্ডিচেরিতে অরবিন্দ যোগসাধনা নামে একটি পুস্তক প্রকাশ করেন এবং বাংলা ও ইংরেজি পত্রিকায় নিয়মিত যোগসাধনা ও হিন্দুধর্ম-বিষয়ক রচনা প্রকাশ করেন। তিনি বেদ, উপনিষদ, ষড়দর্শন, গীতা, পুরাণ প্রভৃতি হিন্দুধর্মীয় গ্রন্থ অধ্যয়ন করে প্রাচীন ভারতের ধর্ম ও দর্শনশাস্ত্রে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। অরবিন্দের দার্শনিক চিন্তা যে সূত্রের ওপর গড়ে ওঠে তা হলো: এক. সবকিছু ব্রহ্ম থেকে জাত এবং ব্রহ্মেই লয় প্রাপ্ত হচ্ছে, এ চক্র চিরন্তন; দুই. জীবন ও মৃত্যু একই চক্রের দুটি দিক, এটি আত্মার পুনরুজ্জীবন; তিন. বিশ্বজগতের যা শাশ্বত নীতি তা-ই মানবাত্মা ও নিখিল প্রকৃতির পরিণাম নির্ধারণ করে; চার. মানুষের লক্ষ্য হলো দিব্যজীবন, যা ব্রহ্মে মিশে যায়; আত্মজ্ঞানের মাধ্যমেই সে দিব্যজীবনের সন্ধান পাওয়া যায়।
অরবিন্দ শেষজীবন পন্ডিচেরির আশ্রমে অতিবাহিত করেন। এ সময় তিনি ধর্ম, দর্শন ও ভারতীয় সংস্কৃতির ওপর বহু গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর গ্রন্থের সংখ্যা ৩৮। সেগুলির অধিকাংশই ইংরেজিতে রচিত। কয়েকখানি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে: Essays on the Gita, The Foundations of Indian Culture, The Life Divine (১৯৩৯), Savitri (১৯৫০), Mother India, The Age of Kalidasa, The Significance of Indian Art, Lights on Yoga, A System of National Education, The Renaissance in India, Speeches of Aurovinda। বাংলায় প্রকাশিত তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা হলো: ভারতের নবজন্ম (১৯১৫), পন্ডিচেরীর পত্র (১৯২১), কারা কাহিনী (১৯২১), ধর্ম ও জাতীয়তা (১৯৩১), যোগ-সাধনার ভিত্তি (১৯৪২), ভারতে রাষ্ট্রনীতিক প্রতিভা ইত্যাদি। ১৯৫০ সালের ৫ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়।
[রামদুলাল রায়]