আজাদ হিন্দ ফৌজ
আজাদ হিন্দ ফৌজ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে (১৯৩৯-১৯৪৫ সাল) অক্ষশক্তি সমর্থনকারী সুভাষচন্দ্র বসু, রাসবিহারী বসুর মতো কয়েকজন সংগ্রামী নেতার চেষ্টায় গড়ে ওঠা ভারতীয় স্বাধীনতাকামী সামরিক বাহিনী।
১৯৪১ সালের ১৭ জানুয়ারি সুভাষ বসু গোপনে কলকাতা ত্যাগ করে জার্মানিতে গমন করেন। বার্লিনে তিনি জার্মানির সমর্থনে ভারতের অস্থায়ী স্বাধীন সরকার গঠন করেন এবং বার্লিন বেতার সম্প্রচারের মাধ্যমে তাঁর ধ্যানধারণা প্রচার করতে থাকেন। জার্মানি থেকে তিনি জাপানের সঙ্গেও যোগাযোগ স্থাপন করেন। এ সময়ই জার্মানির ভারতীয় সম্প্রদায় সুভাষকে ‘নেতাজী’ উপাধি দেয়। এখানেই ‘জয় হিন্দ’ স্লোগানের জন্ম।
ইতোমধ্যে ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে মালয়ে জাপানিদের কাছে ইংরেজরা পরাজিত হলে ১৪নং পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন মোহন সিং একজন ভারতীয় ও একজন ইংরেজ সেনানায়কসহ জাপানিদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে জাপানিদের অস্বাভাবিক সাফল্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অবস্থানরত ভারতীয়দের স্বাধীনতার ব্যাপারে উত্তেজিত করে তোলে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারত স্বাধীনতাকামী ছোট ছোট সংঘ গড়ে ওঠে। এরকমই একটি সংঘের নেতা ছিলেন প্রীতম সিং। প্রীতম সিং ও জাপানি সেনানায়ক মেজর ফুজিহারা বন্দি ভারতীয় সৈন্যদের নিয়ে একটি ভারতীয় বাহিনী গঠনের জন্য মোহন সিংকে অনুরোধ করেন, প্রথমে ইতস্তত করলেও পরে তিনি এতে রাজি হন। ব্রিটিশ সেনানায়ক ৪০,০০০ ভারতীয় সৈন্যকে জাপান সরকারের প্রতিনিধি মেজর ফুজিহারার হাতে তুলে দিলে তিনি তৎক্ষণাৎ মোহন সিং-এর কাছে তাদের সমর্পণ করেন। বলা যেতে পারে এটাই ছিল আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠনের প্রথম পদক্ষেপ।
পরবর্তীকালে জাপানিরা মালয় উপদ্বীপ অতিক্রম করে ১৯৪২ সালের ১৫ ফের্রুয়ারি সিঙ্গাপুর দখল করে। তারা আরও উত্তরে অগ্রসর হয়ে বার্মা (বর্তমান মায়ানমার) আক্রমণ করে এবং ১৯৪২ সালের ৭ মার্চ রেঙ্গুন (বর্তমান ইয়াঙ্গুন) অধিকার করে। খ্যাতনামা বিপ্লবী রাসবিহারী বসু এ সময়ে জাপানে অবস্থান করছিলেন। ১৯৪২ সালের ২৮ মার্চ রাসবিহারী টোকিওস্থ ভারতীয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গকে এক সভায় আহবান করেন। সভায় স্থির হয়, জাপানের অধিকৃত সমুদয় স্থানের ভারতীয় অধিবাসীদের নিয়ে ভারতীয় স্বাধীনতা সংঘ স্থাপন এবং ভারতীয় সেনানায়কদের অধীনে ভারতের একটি জাতীয় সেনাবাহিনী গঠন করা হবে। এ উদ্দেশ্যে ১৯৪২ সালের ১৫ জুন ব্যাংককে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ২৪ জুন ১৯৪২ পর্যন্ত অধিবেশন চলে এবং ৩৫টি প্রস্তাব গৃহীত হয়। একটি প্রস্তাবে সুভাষচন্দ্র বসুকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আমন্ত্রণ জানানোর সিদ্ধান্ত হয়।
ব্যাংকক সম্মেলনের আগেই ১৯৪২ সালের এপ্রিলে মোহন সিং ভারতীয় সেনানায়কদের নিয়ে একটি সভা করেন এবং একটি বিধিবদ্ধ বাহিনী সংগঠিত করেন। ব্যাংকক সম্মেলনে এ সংগঠিত বাহিনী গঠনের বিষয়টি গৃহীত হয় এবং মোহন সিং-এর সেনাপতি নির্বাচিত হন। সম্মেলনে স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য একটি ৫ সদস্যবিশিষ্ট কার্যকর সমিতি গঠিত হয় এবং রাসবিহারী বসু হন এর সভাপতি। ১৯৪২ সালের ১ সেপ্টেম্বর প্রকাশ্যে আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করা হয়।
১৯৪৩ সালের ১৩ জুন সুভাষচন্দ্র বসু টোকিও পৌঁছুলে জাপানের প্রধানমন্ত্রী তোজো তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা জানান এবং জাপানি পার্লামেন্টে ভারতের স্বাধীনতার ব্যাপারে জাপানের সাহায্যের কথা ঘোষণা করেন। ১৯৪৩ সালের ২ জুলাই সুভাষ সিঙ্গাপুরে আগমন করলে বিরাট জনতা তাঁকে সংবর্ধনা জানায়। ৪ জুলাই রাসবিহারী বসু পদত্যাগ করেন এবং সুভাষ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভারতীয় স্বাধীনতা সংঘের সভাপতি হন। ‘নেতাজী’ নামে অভিহিত সুভাষ অস্থায়ী স্বাধীন ভারত সরকার গঠনের প্রস্তাব ঘোষণা করেন। পরদিন নেতাজী আজাদ হিন্দ ফৌজ পরিদর্শন করে ‘দিল্লি চলো’ আহবানে নতুন উন্মাদনার সৃষ্টি করেন। ২৫ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে সেনাপতি পদ গ্রহণ করে সুভাষ বসু আজাদ হিন্দ ফৌজের উন্নতি ও শৃঙ্খলা বিধানে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৪৩ সালের ২১ অক্টোবর নেতাজী পূর্ব এশিয়ার সমবেত প্রতিনিধিদের সমক্ষে অস্থায়ী স্বাধীন ভারত সরকার প্রতিষ্ঠা এবং ২৩ অক্টোবর ব্রিটেন ও আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।
আজাদ হিন্দ ফৌজকে এমনভাবে গঠন করা হচ্ছিল যে, তারাও জাপানি সৈন্যের সঙ্গে ভারত অভিযানে আসবে। কিন্তু জাপানি সেনাপতি টেরাউচি তিনটি কারণে এতে আপত্তি জানান। তিনি মনে করেন পরাজয়ের কারণে ভারতীয়রা ভগ্নোৎসাহ, জাপানিদের মতো কষ্টসহিষ্ণু নয় এবং মূলত তারা ভাড়াটে সৈনিক। তাই তিনি বলেন যে, জাপানিরাই ভারত অভিযানে যাবে এবং ভারতীয় বাহিনী সিঙ্গাপুরে থাকবে। সুভাষ এ প্রস্তাব মেনে নিতে পারেন নি। অনেক আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয় যে, মাত্র এক রেজিমেন্ট ভারতীয় সৈন্য জাপানি সৈন্যদলের সঙ্গে ভাগ হয়ে যুদ্ধ করবে, যদি দেখা যায় তারা যুদ্ধক্ষেত্রে জাপানিদের সমকক্ষ তাহলে আরও ভারতীয় সৈন্য গ্রহণ করা হবে। যুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য পূর্বের গান্ধী, আজাদ ও নেহরু ব্রিগেডে বিভক্ত আজাদ হিন্দ ফৌজ থেকে বাছাই করে ‘সুভাষ ব্রিগেড’ নামে নতুন একটি ব্রিগেড গঠিত হয়।
১৯৪৪ সালের জানুয়ারির প্রথম দিকে সুভাষ ব্রিগেড রেঙ্গুনে পৌঁছে। ইতোমধ্যে সিদ্ধান্ত হয় যে, ভারতীয় বাহিনী এক ব্যাটেলিয়ন অপেক্ষা ছোট হবে না, দলনায়ক হবেন একজন ভারতীয়, জাপান-ভারত যৌথ পরিকল্পনায় যুদ্ধ পরিচালিত হবে এবং নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে ভারতীয়রা স্বতন্ত্রভাবে যুদ্ধ করবে। আরও সিদ্ধান্ত হয় যে, আরাকানে কালাদান নদীর উপত্যকায় ও লুসাই পাহাড়ের পূর্বে চীন পাহাড়ের অন্তর্গত কালাম ও হাকা নামক দুটি কেন্দ্রে যুদ্ধ পরিচালিত হবে।
সুভাষ ব্রিগেডকে তিনটি ব্যাটেলিয়নে ভাগ করে নেওয়া হয়। প্রথম দলটি কালাদান নদীর উভয় তীর দিয়ে অগ্রসর হয়ে পলেতোয়া ও দলেৎমে অধিকার করে এবং কয়েকদিন পর ৬৪ কিমি দূরে ভারত সীমানার মউডক নামক ব্রিটিশ ঘাঁটি দখল করে। এখানে অস্ত্র ও খাবার সরবরাহ দুঃসাধ্য দেখে জাপানিরা ফিরে যেতে চাইলেও ভারতীয়রা রাজী হয় নি। ফলে একটি মাত্র কোম্পানিকে ক্যাপ্টেন সুরযমলের অধীনে রেখে বাকিরা ফিরে যায়। জাপানি সেনানায়ক ভারতীয়দের দেশপ্রেম দেখে এক প্লাটুন জাপানি সৈন্য বিদেশি সেনানায়কের অধীনে রেখে যান।
এদিকে সুভাষ ব্রিগেডের বাকি দুটি দল জাপানিদের কাছ থেকে হাকা-কালাম সীমানার দায়িত্ব বুঝে নেয়। মণিপুরে ইমফলের পতন হলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, আজাদ হিন্দ ফৌজ কোহিমায় অবস্থান নেবে যাতে তারা ব্রহ্মপুত্র পার হয়ে বাংলায় প্রবেশ করতে পারে। গান্ধী ও আজাদ নামে অন্য দুটি ব্রিগেডও ইমফলের দিকে অগ্রসর হয়। ২১ মার্চ জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইংরেজ মুক্ত ভারতীয় অঞ্চলে নেতাজীর নেতৃত্বে অস্থায়ী স্বাধীন ভারত সরকারের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে বলে ঘোষণা করেন। বহু বাধাবিঘ্ন, খাদ্য ও অস্ত্রের অভাব সত্ত্বেও আজাদ হিন্দ ফৌজ ভারতের অভ্যন্তরে ২৪১ কিমি পর্যন্ত অগ্রসর হয়।
এ ঘোষণার অল্প কয়েকদিন পরেই প্রশান্ত মহাসাগরে আমেরিকা ও ব্রিটিশ বাহিনী তাদের শক্তি বৃদ্ধি করে এবং জাপান আক্রমণের উদ্যোগ নেয়। ফলে জাপানিরা ভারত অভিযান পরিকল্পনা বাতিল করে। আজাদ হিন্দ ফৌজও পিছু হটতে বাধ্য হয়। মিত্রবাহিনী বার্মা পুনর্দখল করলে আজাদ হিন্দ ফৌজ আত্মসমপর্ণ করতে বাধ্য হয়।
ভারত সরকার ক্যাপ্টেন শাহ নওয়াজ, ক্যাপ্টেন রশিদ প্রমুখ আজাদ হিন্দ ফৌজের বেশ কয়েকজন সেনানায়ককে কঠোর দন্ডাদেশ প্রদান করে। কিন্তু এ সিদ্ধান্ত ব্যাপক জনক্ষোভের সৃষ্টি করলে সরকার বাধ্য হয়ে এ শাস্তি প্রত্যাহার করে নেয়।
যদিও নেতাজীর আজাদ হিন্দ ফৌজ ভারতের স্বাধীনতা অর্জন করতে পারেনি, তাদের এ চেষ্টা ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবোধের সৃষ্টি করে পরবর্তীকালে তা স্বাধীনতা আন্দোলনে এক বিরাট অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। [মোঃ মুক্তাদির আরিফ মোজাম্মেল]