ইকোলজিক্যাল কেমিস্ট্রি
ইকোলজিক্যাল কেমিস্ট্রি (Ecological Chemistry) বা প্রতিবেশগত রসায়ন হলো গবেষণার একটি শাখা, যা রাসায়নিক সংকেতের মাধ্যমে একটি প্রদত্ত বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে বা বিভিন্ন জীবের মধ্যে জটিল মিথস্ক্রিয়া বোঝার সাথে সম্পর্কিত। প্রতিবেশগত রসায়ন বাস্তুবিদ্যা এবং প্রাণরসায়নের মতো দুটি বৈচিত্র্যময় শাখার সমন্বয়ে উদ্ভূত হয়েছে। এটি জীবন্ত প্রাণীর মিথস্ক্রিয়ায় জড়িত রাসায়নিকের অধ্যয়ন। প্রতিবেশগত রসায়ন সর্বত্র রয়েছে। জীবের মধ্যে রাসায়নিকভাবে মধ্যস্থতামূলক মিথস্ক্রিয়া জৈবিক সংস্থার সমস্ত স্তরে, জীবাণু থেকে মানুষ, সমগ্র জীবকুল এবং বাসস্থান জুড়ে বিস্তৃত।
সমগ্র জীবজগতে পরস্পর মিথস্ক্রিয়ায় ব্যবহৃত একটি সাধারন ভাষা হলো রাসায়নিক সংকেত। এসব রাসায়নিক সংকেত পরিমাণে এতই কম থাকে যে তা সনাক্ত দুরূহ। এছাড়া এসব সংকেত খুবই লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট। নানারকম গৌণ যৌগ যেমন ফ্লাভোনয়েড, অ্যালকালয়েড, তারপিন, ফেনল ইত্যাদি প্রতিবেশে নানারকম জীবের যোগাযোগ ও কথোপকথনে সুনির্দিষ্টভাবে ব্যবহৃত হয়। যেমন পতঙ্গের মধ্যে যৌন মিলনের জন্য নানা রকম অতি ক্ষুদ্র জৈব অণু ফেরোমোন ব্যবহৃত হয়। বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত সহ¯্রাধিক ফেরোমোন আবিস্কার করেছেন। এদের কিছু কিছু ফেরোমোন ট্রেপ হিসেবে কৃষিতে ক্ষতিকর পোকা দমনে টেকসই এবং মানব স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ প্রযুক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
নানারকম গৌণ যৌগ প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রাণী এবং উদ্ভিদ বা উদ্ভিদ এবং উদ্ভিদ বা উদ্ভিদ এবং অণুজীবের মধ্যে ঘটে যাওয়া জটিল মিথস্ক্রিয়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ইকোলজিক্যাল কেমিস্ট্রির মধ্যে রয়েছে উদ্ভিদের পরাগায়ন এবং উৎপাদনশীলতার জৈব রসায়ন, উদ্ভিদ ও অন্যান্য জীবের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইত্যাদি। যে রাসায়নিকগুলি প্রজাতির মধ্যে বার্তাবাহক হিসাবে কাজ করে তাদের সাধারণত সেমিওকেমিক্যাল হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। গ্রীক ভাষায় সেমিওন মানে একটি সংকেত। রাসায়নিক সংকেত বা জীবে কার্যকরী ক্ষুদ্র রাসায়নিক পদার্থগুলি, যা পরস্পর মিথস্ক্রিয়ায় ব্যবহৃত হয়, তাদেরকে ইকোকেমিকেল বা সেমিওকেমিকেল বলা হয়। রাসায়নিক বাস্তুবিদ্যার ক্ষেত্রে এগুলি সাধারণত ফেরোমোন, অ্যালোমোন, কাইরোমোন, আকর্ষক এবং প্রতিরোধককে অন্তর্ভুক্ত করতে ব্যবহৃত হয়। সমস্ত পোকামাকড় সেমিওকেমিক্যাল ব্যবহার করে, যা পোকামাকড় এবং কীটপতঙ্গের জৈবিক নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করা যেতে পারে।
সেমিওকেমিক্যাল অস্থায়ী এবং পরিবেশগতভাবে নিরাপদ। শুধুমাত্র ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ তাদের দ্বারা বিরূপভাবে প্রভাবিত হয়, তাই সেমিওকেমিক্যাল তুলনামূলকভাবে অ-বিষাক্ত। জার্মান জৈব রসায়নবিদ অ্যাডলফ বুটেনান্ড্ট প্রথম এই জাতীয় রাসায়নিক, বোম্বিকোল (একটি রাসায়নিকভাবে ভাল বৈশিষ্ট্যযুক্ত ফেরোমোন যা স্ত্রী রেশম কীট দ্বারা সঙ্গীদের আকৃষ্ট করার জন্য নিঃসৃত হয়) চিহ্নিত করেছিলেন। স্টিঙ্ক বাগ, ব্লিস্টার বিটল সেমিওকেমিক্যাল নিঃসৃত করে, যা অ্যালোমন নামে পরিচিত। কাইরোমোনের একটি পরিচিত উদাহরণ হল মানুষের ঘামের ল্যাকটিক অ্যাসিড উপাদান, যা মশাকে আকর্ষণ করে। ফুলের গন্ধ প্রতিবেশগত রসায়নের সাধারণ উদাহরণ যা প্রেরক এবং প্রাপক উভয়কেই উপকৃত করে। তৃণভোজীদের বিরুদ্ধে উদ্ভিদ প্রজাতির প্রতিরক্ষার একটি সাধারণ রূপ হল অ্যালোমোন উৎপাদন। বিবর্তনীয় বাহু প্রতিযোগিতার (Evolutionary arm race) কারণে কখনও কখনও অ্যালোমোন কাইরোমোনে পরিণত হয়। টেকসই কৃষি, পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য বায়োরেশনাল উপায়ে ফসলের উদ্ভিদে পোকামাকড় এবং রোগজীবাণু নিয়ন্ত্রণে ইকোলজিক্যাল কেমিস্ট্রির জ্ঞান প্রয়োগ করা যেতে পারে। [মো. তোফাজ্জল ইসলাম]