রাজ্জাক, আবদুর
রাজ্জাক, আবদুর (১৯৪২-২০১৭) একজন জনপ্রিয় বাংলাদেশী চলচ্চিত্র অভিনেতা, পরিচালক, নির্মাতা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশের মানুষের কাছে তিনি ‘নায়করাজ রাজ্জাক’ নামে বেশি সুপরিচিত ও সমাদৃত। চলচ্চিত্র শিল্পের সাথে তিনি দীর্ঘ প্রায় ছয় দশক সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। এই সময়ে তাঁর অভিনীত বাংলা ও উর্দু চলচ্চিত্রের সংখ্যা চার শতাধিক। বিশ শতকের ষাট, সত্তর এবং এমনকি আশির দশকের শুরুতেও তাঁকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের একজন প্রধান অভিনেতা হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
রাজ্জাক ১৯৪২ সালের ২৩ শে জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ কলকাতার টালিগঞ্জে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আকবর হোসেন ও মাতার নাম নিসারুননেছা। রাজ্জাকের শৈশব এবং কৈশোর জীবন কেটেছে কলকাতায়। এখানকার বাঁশদ্রোণীর নিকটে খানপুর হাইস্কুলে তিনি পড়াশুনা করেন।
কলকাতার স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় শিশু-কিশোরদের নিয়ে লেখা নাটক ‘বিদ্রোহী’তে এক গ্রামীণ কিশোরের চরিত্রে অভিনয়ের মধ্যে দিয়েই রাজ্জাকের অভিনয় জগতে হাতেখড়ি হয়। নিজের প্রতিভার গুণে রাজ্জাক ধীরে ধীরে ছোট পর্দার নাটকে অভিনয় করার সুযোগ পেয়ে যান এবং কলকাতায় একজন নাট্যাভিনেতা হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করেন। ১৯৫৮ সালে ‘রতন লাল বাঙালি’ নামক সিনেমায় ছোট একটি চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে রাজ্জাক কলকাতার বাংলা চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। এরপর তিনি ‘পঙ্ক তিলক’ ও ‘শিলালিপি’সহ আরো দু’একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। অভিনয়ের নেশায় তিনি পাড়ি জমিয়েছিলেন বোম্বেতেও। সেখানকার অভিনয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘ফিল্মালয়ে’ কিছুদিন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
কলকাতায় অভিনয় করতে গিয়ে তিনি খ্যাতিমান অভিনেতা উত্তম কুমার, তপন সিনহা এবং পরিচালক পীযূষ সাহা প্রমুখের সংস্পর্শে আসেন। বো¤ে¦তে তিনি সাহচর্য পেয়ে ছিলেন কিংবদন্তি অভিনেতা দিলিপ কুমার ও শশধর মুখার্জী প্রমুখের। কলকাতার পরিচালক পীযূষ সাহার পরামর্শেই ১৯৬৪ সালে স্ত্রী খায়রুন্নেসা লক্ষ্মী এবং শিশুপুত্র বাপ্পারাজকে নিয়ে রাজ্জাক কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন। রাজ্জাকের ঢাকায় আসার পেছনে সে সময় কলকাতায় সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও অন্যতম কারণ ছিল। কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে প্রথমে তিনি থিয়েটারে কাজ শুরু করেন। এরপর ছোট পর্দার টেলিভিশনে ‘ঘরোয়া’ নামের ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করে তিনি দর্শকদের নজর কাড়েন।
১৯৬৬ সালে বশীর আহমেদ পরিচালিত ‘১৩ নম্বর ফেকু ওস্তাগার লেন’ সিনেমাতে একটি ছোট চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশী চলচ্চিত্রে রাজ্জাকের অভিনয় জীবনের অভিষেক ঘটে। তবে জহির রায়হান পরিচালিত ‘বেহুলা’ চলচ্চিত্রে নায়িকা সুচন্দার বিপরীতে প্রথম কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন। উল্লেখ্য যে, রাজ্জাক চলচ্চিত্রে প্রথম জুটি বেঁধে কাজ করেছেন জনপ্রিয় নায়িকা সুচন্দার সঙ্গে। এরপর একে একে কবরী, শাবানা ও ববিতার সঙ্গে জুটি বেঁধে কাজ করেন। তবে রাজ্জাক-কবরী জুটি বাংলা চলচ্চিত্রে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, চলচ্চিত্র জীবনে রাজ্জাক চার শতাধিক ছবিতে অভিনয় করলেও, তিন’শর বেশি ছবিতে তিনি কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করে বিরল কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। তিনি খ্যাতি লাভ করেছেন সুপারস্টার বা নয়াক রাজের। নায়ক হিসেবে রাজ্জাক সর্বশেষ অভিনয় করেন ১৯৯৪ সালে ‘অন্ধবিশ্বাস’ চলচ্চিত্রে। রাজ্জাক অভিনীত অসংখ্য জনপ্রিয় চলচ্চিত্র রয়েছে। এসব চলচ্চিত্রের মধ্যে ‘বেহুলা’, ‘আগুন নিয়ে খেলা’, ‘এতটুকু আশা’, ‘নীল আকাশের নিচে’, ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘ওরা ১১ জন’, ‘অবুঝ মন’, ‘রংবাজ’, ‘আলোর মিছিল’, ‘অশিক্ষিত’, ‘ছুটির ঘণ্টা’, ‘বড় ভালো লোক ছিল’ রংবাজ, আলোর মিছিল, বেঈমান, বাঁদী থেকে বেগম, সখী তুমি কার, রাজলক্ষী শ্রীকান্ত, শুভদা, দুই পয়সার আলতা, ‘চন্দ্রনাথ’ এবং ‘বাবা কেন চাকর’ ইত্যাদি অন্যতম। রাজ্জাক অভিনীত সর্বশেষ চলচ্চিত্রের নাম কার্তুজ। ২০১৫ সালে নির্মিত এ চলচ্চিত্রটির পরিচালক রাজ্জাকের পুত্র নায়ক বাপ্পারাজ। এতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন রাজ্জাকের ছোট পুত্র সম্রাট।
বাংলা চলচ্চিত্রের পাশাপাশি উর্দু চলচ্চিত্রও রয়েছে রাজ্জাকের অভিনয় ক্যারিয়ারে। রাজ্জাক অভিনীত উর্দু সিনেমার মধ্যে ‘আখেরি স্টেশন’, ‘উজালা’, ‘গৌরি’, ‘মেহেরবান’ এবং ‘পায়েল’ ইত্যাদি অন্যতম। বিশ শতকের নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে রাজ্জাক তাঁর নিজের পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘বাবা কেন চাকর’ দিয়ে দীর্ঘিদিন পর আবারো পশ্চিমবঙ্গের দর্শকের সামনে উপস্থিত হয়েছিলেন। অঞ্জলি ফিল্মস প্রযোজিত এ সিনেমাটি ১৯৯৮ সালে যৌথভাবে মুক্তি পায় পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে। এরপর কলকাতায় ‘অন্নদাতা’, ‘হিরো’, ‘এরই নাম প্রেম’ এবং ‘জন্মদাতা’ ইত্যাদি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি।
রাজ্জাক কেবল অভিনেতা হিসেবেই সফল ছিলেন না, চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। ১৯৭৭ সালে তিনি প্রথম পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তিনি ১৬টি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন। তাঁর পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্রের নাম ‘অনন্ত প্রেম’। ‘জীনের বাদশাহ’, ‘বদনাম’, ‘প্রফেসর’, ‘বাবা কেন চাকর’ ‘উত্তর ফাল্গুনী’ এবং আয়না কাহিনী’ ইত্যাদি রাজ্জাক পরিচালিত চলচ্চিত্রের অন্যতম। অভিনয় ও পরিচালনা ছাড়াও রাজ্জাক চলচ্চিত্র প্রযোজনার কাজও করেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের নাম ‘রাজলক্ষ্মী প্রডাকশন’। এই প্রডাকশন হাউজ থেকে বেশ কিছু জনপ্রিয় বাংলা চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। ২০১৬ সালে রাজ্জাক ‘চেয়ারম্যানের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র’ নামক একটি টেলিভিশন চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। চলচ্চিত্রটি তাঁর নিজের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান রাজলক্ষ্মী প্রডাকশন থেকে নির্মিত হয় এবং পরিচালনা করেন তাঁর পুত্র নায়ক সম্রাট। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নে তিনি নানাভাবে অবদান রাখেন। তাঁর উদ্যোগে ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি প্রতিষ্ঠা’ করা হয়। ১৯৮৪ সালে তিনি সমিতির প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
দুই বাংলার চলচ্চিত্রে রাজ্জাক ছিলেন একজন জনপ্রিয় কিংবদন্তি তুল্য অভিনেতা। অভিনয় দক্ষতা ও গুণে তিনি মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন, খ্যাতি লাভ করেছেন বাংলা চলচ্চিত্রের ‘নায়করাজ’ হিসেবে। অভিনয় শিল্পে অনন্য কৃতিত্ব ও অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে রাজ্জাক অর্জন করেছেন অনেক পুরস্কার ও সম্মননা। ২০১৫ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার সংস্কৃতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখার জন্য তাঁকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘স্বাধীনতা পদকে’ ভূষিত করে। ১৯৭৬, ১৯৭৮, ১৯৮২, ১৯৮৪ ও ১৯৮৮ সালে তিনি মোট পাঁচবার শ্রেষ্ঠ অভিনেতা ক্যাটাগরিতে ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’ লাভ করেন। ২০১৩ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে তাঁকে ‘আজীবন সম্মাননা’ পুরস্কার প্রদান করা হয়। এছাড়াও তিনি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি (বাচসাস) পুরস্কার’, ‘ইন্দো-বাংলা কলা মিউজিক পুরস্কার’, ‘ইফাদ ফিল্ম ক্লাব পুরস্কার’, ‘টেলিভিশন রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ট্রাব) পুরস্কার’ এবং ‘মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা পুরস্কার’সহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। রাজ্জাকই প্রথম বাংলাদেশী অভিনেতা যিনি জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের (UNFPA) শুভেচ্ছা দূত হিসেবে কাজ করার গৌরব অর্জন করেন।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের কিংবদন্তি অভিনেতা নায়করাজ রাজ্জাক ২০১৭ সালের ২১শে আগস্ট হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। [মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান]