দত্ত, সি.আর
দত্ত, সি.আর বীর উত্তম (১৯২৭-২০২০) বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধকালে ৪ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার। সিআর দত্তের পুরো নাম চিত্তরঞ্জন দত্ত। তিনি ১৯২৭ সালের ১লা জানুয়ারি আসামের শিলংয়ে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার চাকরির সুবাদে তাঁর পরিবার তখন আসামে অবস্থান করছিল। তাঁর পিতার নাম উপেন্দ্র চন্দ্র দত্ত এবং মাতা লাবণ্য প্রভা দত্ত। তাঁর পৈতৃক বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট থানার মিরাশী গ্রামে।
সি.আর দত্ত ১৯৪৩ সালে হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এন্ট্রান্স এবং খুলনার দৌলতপুর কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং বি.এস.সি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৫১ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং পরের বছর কমিশন লাভ করেন।
সি.আর দত্ত ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে ৩ মাসের ছুটি নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে হবিগঞ্জে আসেন। ২৫শে মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট নামে বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্বিচারে গণহত্যা এবং ২৬শে প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। এমতবস্থায়, তিনি চাকরিতে যোগদান করতে ফিরে না গিয়ে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এ সময় হবিগঞ্জের কর্নেল আব্দুর রব এমএনএ ও মানিক চৌধুরী এমএনএ-এর সঙ্গে একান্ত বৈঠকে মেজর সি.আর দত্ত সিলেট অঞ্চলের সামরিক নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং সিলেট শহর পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত করার সংকল্প গ্রহণ করেন। ২৭শে মার্চ তাঁরা ৩০-৩৫ জন সেনাসদস্য, কিছুসংখ্যক পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ, ছাত্র-যুবক ও রাজনৈতিক কর্মীসহ রশীদপুর চা-বাগানে পৌঁছে ঘাঁটি স্থাপন করেন। ৩১শে মার্চ রশীদপুর চা-বাগান ঘাঁটি থেকে শ্রীমঙ্গল পৌঁছে পাকিস্তানি বাহিনীকে হটিয়ে মৌলভীবাজার হয়ে তাঁরা সিলেট শহর অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকেন। ৪ঠা এপ্রিল সি.আর দত্ত তাঁর বাহিনী নিয়ে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ ও গোলাপগঞ্জ উপজেলার শেরপুরে পৌঁছেন। কোম্পানীগঞ্জ, সিলেট সদর ও বালাগঞ্জ উপজেলার শাদীপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের ৩ দিন ব্যাপী ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে হানাদার বাহিনী সিলেট শহরের দিকে পালিয়ে যায়। ৬ই এপ্রিল সিলেট শহর দখলের চূড়ান্ত যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে পাকিস্তানি সৈন্যরা সিলেট শহর ছেড়ে সালুটিকর বিমানবন্দর ও লাক্কাতুরা চা-বাগানে আশ্রয় নেয়। এ দুটি স্থান ছাড়া ১০ই এপ্রিল পর্যন্ত সিলেট শহরসহ জেলার বিস্তীর্ণ এলাকার ওপর মুক্তিযোদ্ধাদের দখল প্রতিষ্ঠিত হয়।
বিমানে করে পাকিস্তানি বাহিনীর সৈন্য বৃদ্ধি ও তাদের ভারী অস্ত্রের মুখে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে বেশি দিন সিলেটে টিকে থাকা সম্ভব হয়নি। এপ্রিলের শেষে দিকে তাঁরা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আশ্রয় নেন। মুক্তিযুদ্ধকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য জুলাই মাসে সমগ্র দেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হলে সিলেটের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল জুড়ে প্রায় ১০০ মাইল সীমান্তবর্তী এলাকা নিয়ে ৪ নং সেক্টর গঠিত হয়। মেজর সি.আর দত্ত এ সেক্টরের কমান্ডার নিযুক্ত হন। আসামের খোয়াই-এ ছিল ৪ নং সেক্টরের সদর দপ্তর। নিয়মিত বাহিনীর দুই হাজার সদস্য এবং ৮ হাজার গেরিলা নিয়ে এ সেক্টরের মুক্তিবাহিনী গঠিত ছিল। অভ্যন্তরীণভাবে এ সেক্টরকে ৬টি সাব-সেক্টরে ভাগ করা হয়। অসংখ্য উঁচু পাহাড়, টিলা এবং শতাধিক চা-বাগান থাকায় গেরিলা অপারেশনের জন্য এ সেক্টর ছিল খুবই উপযোগী।
অক্টোবর-নভেম্বর মাসে সি.আর দত্তের বাহিনীর সঙ্গে হানাদার বাহিনীর একাধিক যুদ্ধে সীমান্তবর্তী এলাকাসমূহ মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসতে থাকে। ৩রা ডিসেম্বর এ বাহিনী কানাইঘাট দখল করতে সক্ষম হয়। ১৬ই ডিসেম্বর মেজর সি.আর দত্ত তাঁর বাহিনী নিয়ে সিলেট শহরের খাদিম নগর পৌঁছে যান। ১৭ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে সিলেট হানাদারমুক্ত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য মেজর সি.আর দত্ত-কে বাংলাদেশ সরকার ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করে।
স্বাধীনতার পর সিআর দত্ত সেনাবাহিনীতে পুনর্বহাল হন। ১৯৭১ সালের পূর্বেই তিনি মেজর, মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি লে. কর্নেল এবং ১৯৭৬ সালে তিনি মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন। ১৯৮৪ সালে তিনি সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। সেনাবাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় তিনি ব্রিগেড কমান্ডার, বিডিআর (বর্তমান বিজিবি)-এর মহাপরিচালক, হেডকোয়ার্টার্স চিফ অব লজিস্টিকস, বিআরটিসি ও মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যানসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। এদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সুরক্ষার জন্য সি.আর দত্ত প্রতিষ্ঠা করেন ‘বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ’। আমৃত্যু তিনি এ পরিষদের সভাপতি ছিলেন।
চিত্তরঞ্জন দত্ত ২০২০ সালের ২৫শে আগস্ট ৯৩ বছর বয়সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি মনীষা রায়ের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এ দম্পতি ৩ কন্যা এবং এক পুত্র সন্তানের জনক-জননী। ঢাকা মহানগরীর কাঁটাবন থেকে কারওয়ান বাজার সিগন্যাল পর্যন্ত সড়কটি বীর উত্তম সি.আর দত্ত সড়ক নামে নামকরণ করা হয়েছে। [মনিরুজ্জামান শাহীন]
তথ্যসূত্র বিস্তারিত দ্রষ্টব্য, হারুন-অর-রশিদ (সম্পাদিত), বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ, দশম খণ্ড-, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা ২০২০