খানম, আয়শা
খানম, আয়শা (১৯৪৭-২০২১) আয়শা খানম ১৮ই অক্টোবর ১৯৪৭ সালে নেত্রকোণা জেলার গাবরাগাতি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মায়ের নাম জামাতুন্নেছা খানম, বাবার নাম গোলাম আলী খান। স্বামী মর্তুজা খান ছিলেন একজন প্রকৌশলী। এক কন্যা ঊর্মি খান যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ^বিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিষয়ে অধ্যাপনা করছেন।
আয়েশা খানম গাবরাগাতি গ্রামের বিদ্যালয়ে প্রাথমিক পাঠ সমাপ্ত করে নেত্রকোণার গার্লস হাই স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। সেখান থেকে এস.এস.সি পাস করে ময়মনসিংহ মমিনুন্নেসা গার্লস কলেজে ভর্তি হন। পরবর্তীতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
নেত্রকোণা গার্লস স্কুলে থাকাকালীন শরীফ শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাঁর আন্দোলনে হাতেখড়ি। পরবর্তীতে মমিনুননেসা কলেজে পড়াকালীন সময়ে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে জড়িত হন। ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মকা-ে আরো নিবিড়ভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন। ৬২’র শিক্ষা আন্দোলনসহ বিশেষ করে ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে রোকেয়া হলে অবস্থানকালে তিনি নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। তাঁর মধ্যে অনর্গল যুক্তিপূর্ণ ও তথ্যসমৃদ্ধ বক্তব্য প্রদানের বিশেষ গুণ ছিল। ১৯৬৯ সালে রোকেয়া হল ছাত্রী সংসদের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ও ১৯৭০ সালে সহসভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৭০ সালে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সহসভাপতি নির্বাচিত হন। ছাত্রাবস্থায় তিনি বামপন্থী আন্দোলনে যুক্ত হন। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ১৯৭১ সালে কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন।
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত শরণার্থী শিবির ও মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ‘ক্রাফটস হোস্টেলে’ থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি আগরতলায় চিকিৎসাসেবায় প্রাথমিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ক্যাম্পে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় কাজ করেন। ছাত্র-প্রতিনিধি হিসেবে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ থেকে বক্তৃতা দান করে জনমত তৈরির কাজে ভূমিকা রাখেন। স্বাধীনতার পর উচ্চশিক্ষা সমাপন শেষে বিভিন্ন পেশায় যোগদানের সুযোগ সামনে থাকলেও মানবমুক্তি তথা নারীমুক্তির আন্দোলনে সার্বক্ষণিকভাবে নিজেকে নিবেদন করেন। আমৃত্যু এই সংগ্রাম তিনি করে গেছেন। ১৯৭২ সালে তিনি মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এর সঙ্গে যুক্ত থেকে সাংগঠনিক সম্পাদক, সহসাধারণ সম্পাদক, সাধারণ সম্পাদক এবং ২০০৮ সাল থেকে সভাপতি হিসেবে শেষ দিন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
আয়েশা খানম ১৯৯৩-এর ভিয়েনা মানবাধিকার সম্মেলন, চতুর্থ আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন, UNIFEM, UNESCAP, CSW, UNCEDAW, UNWOME সহ অসংখ্য আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দেন এবং সেই সকল সম্মেলনে অর্জিত অভিজ্ঞতা সংগঠনের কার্যক্রমে যুক্ত করার প্রয়াস নেন। নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আইন সংস্কারের আন্দোলন, UFC বাস্তবায়ন, সিডও সনদ বাস্তবায়ন আন্দোলন, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের আন্দোলন জোরদার করা ও জাতীয় এজেন্ডায় পরিণত করার ক্ষেত্রে তাঁর পথনির্দেশনা ও একনিষ্ঠতা অনুসরণীয়। তিনি বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় নারী উন্নয়ন পরিষদের সদস্য ছিলেন। তিনি UNWOMEN এবং UNDP-র অ্যাডভাইজরি কমিটির সদস্য ছিলেন। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন সভায় তিনি যুক্ত হন। পরবর্তীতে জেন্ডার বাজেট প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে প্রতিটি বাজেট সভায় অংশগ্রহণ করেন, প্রস্তাবনা ও পরামর্শ প্রদান করেন। ২০০২ সাল থেকে ৬৮টি সংগঠনের প্লাটফর্ম সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির সেক্রেটারিয়েটের দায়িত্ব পালন করেন।
২০১৯ সালে দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার পরেও শক্তি, সাহস ও দৃঢ়তা দেখিয়ে রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। স্বাধীনতা-পূর্ব ও স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশের সকল গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, মানবাধিকারের আন্দোলনে তিনি সমভাবে সক্রিয় ছিলেন। আয়শা খানমের লিখিত গ্রন্থের মধ্যে ‘নারীর মানবাধিকার ও ক্ষমতায়নের পথে’ (২০১৫); ‘মুক্তিযুদ্ধদিনের স্মৃতি’ (২০০১) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
মহিয়সী এই নারী ২রা জানুয়ারি ২০২১ সালে ৭৪ বছর বয়সে রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। নেত্রকোণার নিজ গ্রামে তাঁকে সমাহিত করা হয়। [জেবউননেছা]