আলী, শেখ রাজ্জাক
আলী, শেখ রাজ্জাক (১৯২৮-২০১৫) আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, সংসদ সদস্য এবং বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের স্পিকার। তিনি ১৯২৮ সালে খুলনা জেলার পাইনগাছা উপজেলার হিতামপুর ইউনিয়নে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শেখ এন্তাজ আলী ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। তিনি তার পুত্রের উচ্চশিক্ষার ব্যাপারে অত্যন্ত সংবেদনশীল ছিলেন। রাজ্জাক আলী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন দৌলতপুরে অবস্থিত ব্রজলাল কলেজ থেকে ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫২ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এম.এ ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে, তিনি ‘দ্য ডেইলি পাকিস্তান পোস্ট’ (১৯৫৩)-এ রিপোর্টার এবং ‘দ্য ডেইলি পাকিস্তান অবজারভার’-এ প্রধান রিপোর্টার হিসেবে চাকুরিরত অবস্থায় আইন বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। আইন বিষয়ে ডিগ্রি সমাপ্তের পর তিনি খুলনায় গিয়ে খুলনা বার-এ আইনজীবী হিসেবে যোগদান করেন। অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মধ্যে শ্রম ব্যাংকিং এবং শিপিং সংক্রান্ত সিভিল মামলা পরিচালনায় তাঁর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। আইন পেশায় ব্যস্ত জীবন-যাপনের মধ্যেই ১৯৭৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় দ্বিতীয় এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন।
তিনি ১৯৬৪ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত খুলনা বার অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচিত সেক্রেটারি এবং সভাপতি ছিলেন। একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে রাজ্জাক আলী খুলনা সিটি ল’ কলেজ (১৯৬৫) প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন এবং সেখানে পাঠদানের সাথেও জড়িত ছিলেন। প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি কলেজটির ভাইস প্রিন্সিপাল ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ১৯৭০ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত এই কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি বহু কলেজ এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার সাথেও তিনি জড়িত ছিলেন। খুলনা শহরে প্রতিষ্ঠিত সুন্দরবন কলেজ (১৯৬৯)-এর প্রতিষ্ঠার সাথে তিনি সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্বকালীন ইকবাল হল (পরবর্তীতে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল)-এ অবস্থানকালীন সময়ে ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তার সক্রিয় রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। খুলনায় তিনি মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)-তে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালের জুন মাসে মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বাড়ি পাকিস্তান আর্মির দ্বারা আক্রান্ত এবং লুট হলে, তিনি কলকাতা চলে যান। কলকাতায় আন্তর্জাতিক রেডক্রসের হয়ে তিনি হাসনাবাদ এবং বসিরহাট ক্যাম্পে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত শেখ রাজ্জাক আলী খুলনা জেলা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নির্বাচিত সভাপতি হিসেবে কাজ করেন। তিনি বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে ১৯৭৯, ১৯৯১ এবং ১৯৯৬-এ তিন বার নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন। তিনি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য আইন বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৯১ পঞ্চম জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন। একই বছরে সংসদের বাকি মেয়াদ অর্থাৎ ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তিনি স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৯৬ সালে ষষ্ঠ সংসদেও স্পিকার নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৯১ সালের ৬ই আগস্ট সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী গ্রহণে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনরায় চালু হয়। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীটি তিনি প্রণয়ন করেছিলেন, যেটি ১৯৯৬ সালের ২৬শে মার্চ সংসদে গৃহীত হয়। এই সংশোধনীর মাধ্যমে ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। ডেপুটি স্পিকার হিসেবে দায়িত্বরত অবস্থায় প্রায়শই অস্থির সংসদীয় কর্মকা- চলাকালীন তিনি দক্ষতা এবং মার্জিত হাস্যরসের মাধ্যমে সংসদ নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করেন। ২০০২-২০০৩ সালে তিনি যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৬ সালে তিনি লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টিতে যোগদান করেন। কিন্তু অচিরেই তিনি রাজনীতিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। তিনি লায়ন্স ক্লাব চক্ষু হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে সক্রিয় ছিলেন। মৃত্যুর পূর্ব-পর্যন্ত তিনি খুলনার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন।
রাজ্জাক আলী স্বল্পোন্নত দেশের সংবিধান প্রণয়ন সংক্রান্ত একটি গ্রুপের নেতা হিসেবে জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। পরবর্তীতে, ১৯৯৫ সালে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার স্বর্ণজয়ন্তী পালন উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশ টিমের নেতৃত্ব দেন এবং এ উপলক্ষ্যে তিনি জাতিসংঘ সনদের ওপর বক্তৃতা প্রদান করেন। তিনি কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারী অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী কমিটির একজন সদস্য এবং সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ইন্টার পার্লামেন্টারী ইউনিয়নের পার্লামেন্টারী ডেলিগেসনের প্রধান হিসেবে তিনি বিভিন্ন দেশ সফর করেন। তিনি সার্ক দেশসমূহের স্পিকারদের নিয়ে স্পিকার কনফারেন্সের আয়োজক ছিলেন।
তিনি সমাজ সংস্কারক এবং শিক্ষাবিদ বেগম মাজেদা আলীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পত্তির পাঁচ কন্যাসন্তান রয়েছে। ২০১৫ সালের ৭ জুন শেখ রাজ্জাক আলী মৃত্যুবরণ করেন [রাণা রাজ্জাক]