জব্বার, আব্দুল২
জব্বার, আব্দুল২ (১৯৩৮-২০১৭) বাংলাদেশের একজন জননন্দিত কন্ঠশিল্পী। চলচ্চিত্র, আধুনিক বাংলা গান, গণসংগীত ইত্যাদি বিভিন্ন ধারায় তাঁর ছিল সফল পদচারনা। এসব ক্ষেত্রে চূড়ান্ত খ্যাতি অর্জন তাঁকে জীবন্ত কিংবদন্তীতে পরিণত করেছিল। বাংলাদেশের সংগীত যে সমস্ত গুণী শিল্পীদের হাত ধরে সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁদের মধ্যে অন্যতম শিল্পী হলেন আব্দুল জব্বার।
আব্দুল জব্বার ১৯৩৮ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়া শহরের আওড়াপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম দখিল উদ্দিন প্রামাণিক এবং মাতার নাম বেগম ফুলজান। পাঁচ ভাই এবং তিন বোনের মধ্যে আব্দুল জব্বার ছিলেন কনিষ্ঠতম। ছেলেবেলায় তিনি খুব ক্রীড়ামোদী ছিলেন। সুকন্ঠের অধিকারী আব্দুল জব্বার গানের জন্য ছেলেবেলাতেই তাঁর বন্ধুমহলে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। কিশোর জব্বার বন্ধুদের আড্ডায় সুযোগ পেলেই গেয়ে উঠতেন সে সময়ের জনপ্রিয় সব সিনেমার গান। যে কোন খেলায় জয়ের আনন্দ উদ্যাপনের বিশেষ অনুষঙ্গ ছিল তাঁর গান। ছেলের এই সুন্দর কন্ঠ তাঁর মা ফুলজান খুব পছন্দ করতেন এবং তাঁকে গান গাইতে উৎসাহিত করতেন।
আব্দুল জব্বারের শিক্ষাজীবন শুরু হয় কুষ্টিয়ার মুসলিম হাইস্কুলে। পরে তিনি বাড়ির কাছাকাছি মোহিনীমোহন বিদ্যাপীঠে ভর্তি হন। আব্দুল জব্বার ১৯৫৬ সালে মোহিনীমোহন বিদ্যাপীঠ থেকে মেট্রিক পাস করেন। মেট্রিক পাস করার পর তিনি প্রথাগতভাবে সংগীত শিক্ষা শুরু করেন। তাঁর সংগীতশিক্ষার হাতেখড়ি ওস্তাদ ওসমান গণির কাছে। পরে তিনি ওস্তাদ লুৎফল হকের কাছে সংগীতে উচ্চতর তালিম গ্রহণ করেন। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তান রেডিও এবং ১৯৬৪ সালে পাকিস্তান টেলিভিশনে নিয়মিত শিল্পী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন আব্দুল জব্বার। চলচ্চিত্রে তিনি প্রথম গান করেন ১৯৬২ সালে। ১৯৬৮ সালে ‘এতটুকু আশা’ ছবিতে সত্য সাহার সুরে তাঁর গাওয়া ‘তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়’ গানটি ভীষণ জনপ্রিয়তা লাভ করে। একই বছর ‘পীচ ঢালা পথ’ ছবিতে রবিন ঘোষের সুরে ‘পীচঢালা এই পথটারে ভালোবেসেছি’ এবং ’ঢেউয়ের পরে ঢেউ’ ছবিতে রাজা হোসেন খানের সুরে গাওয়া ‘সুচরিতা যেয়োনাকো, আর কিছুক্ষণ থাকো’ এই দুটি গানে তিনি জনপ্রিয়তার শীর্ষে আরোহণ করেন। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তাঁর গাওয়া আর একটি কালজয়ী গান ১৯৭৮ সালে ‘সারেংবৌ’ ছবিতে আলম খানের সুরে ‘ওরে নীল দরিয়া আমায় দে রে দে ছাড়িয়া’।
ষাটের দশকের শেষে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী সাংস্কৃতিক আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন আব্দুল জব্বার। আটষট্টি-ঊনসত্তরের উত্তাল গণ-আন্দোলনের সময় পল্টন ময়দান, রেসকোর্স মাঠ (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান), বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর ইত্যাদি ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদী জনসভা লেগেই থাকত। এসব জনসভায় বক্তৃতার পরেই শুরু হতো গণসংগীতের আসর। এসব গণসংগীতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতেন আব্দুল জব্বার। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ভাষণের পর তিনি ট্রাকে করে ‘সালাম সালাম হাজার সালাম সকল শহীদ স্মরণে’ গানটি গেয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন সারা ঢাকা শহর। মার্চের শেষের দিকে আব্দুল জব্বারের উপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হুলিয়া জারি হলে কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো নৌকা যোগে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে তিনি আগরতলা চলে যান। সেখান থেকে আগরতলাস্থ বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠীর সহযোগিতায় কলকাতা যান এবং যোগ দেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। আব্দুল জব্বার ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের এবং কাঁধে হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে ক্যাম্পে ঘুরে ঘুরে গণসংগীত গেয়ে প্রেরণা যুগিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সাথে ভারতের বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত সৃষ্টি করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের জন্য বিপুল পরিমাণ তহবিল সংগ্রহ করেন।
২০০৬ সালে বিবিসি বাংলার শ্রুতিম-লীর জরিপে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ২০টি বাংলা গানের তালিকায় স্থান করে নেয় আব্দুল জব্বারের গাওয়া ‘তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়’, ‘সালাম সালাম হাজার সালাম সকল শহীদ স্মরণে’, এবং ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গান তিনটি। সংগীতে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পেয়েছেন অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- একুশে পদক (১৯৮০), স্বাধীনতা পদক (১৯৯৬), বঙ্গবন্ধু পদক, জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কার, বাচসাস আজীবন সম্মাননা পুরস্কার, সিটিসেল চ্যানেল আই আজীবন সম্মাননা পুরস্কার।
আব্দুল জব্বার ২০১৭ সালের ৩০শে আগস্ট ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। [আজিজুর রহমান]