খান, লে. জেনারেল মোহাম্মদ আযম
খান, লে'. 'জেনারেল মোহাম্মদ আযম (১৯০৯-?) সামরিক কর্মকর্তা, পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর। ১৯০৯ সালে পেশোয়ারের নিকটবর্তী মাথোরা গ্রামে তাঁর জন্ম। বিশ বছর বয়সে তিনি ব্রিটিশ ভারতীয় সৈন্যবাহিনীতে যোগ দেন। তিনি ভারতের দেরাদুন ও যুক্তরাজ্যের স্যান্ডহার্স্ট সামরিক কলেজে শিক্ষা শেষে ১৯২৯ সালে কমিশন লাভ করেন। আযম খান প্রায় একবছর রাইফেল ব্রিগেডে যুক্ত ছিলেন। অতঃপর তিনি ১৯ হায়দ্রাবাদ রেজিমেন্টের ৪র্থ ব্যাটালিয়নে প্রায় এগারো বছর বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি আরাকানে কম্বাইন্ড অপারেশনের স্টাফ অফিসার ছিলেন। ভেরোসোভা ও মাউদ দ্বীপে কম্বাইন্ড অপারেশনে সৈন্যদের প্রশিক্ষণের জন্য তাঁকে নিয়োগ করা হয়। তিনি স্টাফ কলেজে একটা কোর্সেও যোগদান করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় আযম খান অ্যাসিস্ট্যান্ট কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল ছিলেন এবং ১৯৪৮ সালে তিনি একটি ব্রিগেড কম্যান্ডের দায়িত্ব পান। তিনি ১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাসে মেজর জেনারেল এবং ১৯৫৪ সালের মে মাসে লে. জেনারেল পদে পদোন্নতি পান।
পাঞ্জাবে আহমদীয়া বিরোধী আন্দোলন দমনের লক্ষ্যে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ ১৯৫৩ সালে সামরিক আইন জারি করেন। লে. জেনারেল আজম খান তখন লাহোর গ্যারিসনে জেনারেল অফিসার কম্যান্ডিং (জিওসি) ছিলেন। এ সময় তাঁকে সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। তিনি অত্যন্তসাফল্যের সাথে পাঞ্জাবের রাজধানী শহর লাহোরে শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেন। পাঞ্জাবে ১৯৫৩ সালে বন্যার সময়ও তিনি জনগণের দুর্ভোগ লাঘবে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখেন। ১৯৫৮ সালে সামরিক বাহিনীকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার কাজে যে তিনজন সিনিয়র জেনারেল আইয়ুব খানকে সহায়তা করেন তাদের অন্যতম ছিলেন আযম খান। আইয়ুব খান তাঁর মন্ত্রিসভায় আযম খানকে সিনিয়র মন্ত্রী করেন (২৮ অক্টোবর ১৯৫৮) এবং তাঁকে উদ্বাস্ত্ত পুনর্বাসন বিভাগের দায়িত্ব দেয়া হয়। ১৯৬০ সালের ১৪ এপ্রিল আযম খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত হন এবং ১৫ এপ্রিল গভর্নর হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।
আযম খান তাঁর ব্যক্তিগত আচরণ ও সব শ্রেণির মানুষের সাথে মেলামেশার মাধ্যমে তাদের ভালোবাসা ও সম্মান অর্জন করেন। ১৯৬০ সালের ১০ এবং ৩১ অক্টোবর পরপর দু’বার চট্টগ্রাম ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় প্রবল ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের দুর্দশা লাঘবে এবং তাদের পুনর্বাসনে তিনি কঠোর পরিশ্রম করেন। এ জন্য ১৯৬০ সালের ১৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে তাঁকে এক সংবর্ধনা দেওয়া হয়। জনগণকে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে উৎসাহ দেওয়ার এবং কৃষি ও শিল্প সামগ্রী প্রদর্শনীর লক্ষ্যে তিনি ‘পূর্ব পাকিস্তান সপ্তাহ’ চালু করেন। মৌলিক গণতন্ত্র পদ্ধতি এবং অন্যান্য রাজনৈতিকে ইস্যুতে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সাথে মতবিরোধ হওয়ায় আযম খান গভর্নর পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং ১৯৬২ সালের ১০ মে ঢাকা ত্যাগ করেন। ঢাকা স্টেডিয়ামে তাঁকে ৯ মে (১৯৬২) এক বিদায় সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এতে হাজার হাজার লোক সমবেত হয়।
১৯৬৫ সালের ২ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য ১৯৬৪ সালের ২০ জুলাই সম্মিলিত বিরোধী দল নামে একটি নির্বাচনী ফ্রন্ট গঠন করা হয়। এ ফ্রন্টে মুসলিম লীগ (কাউন্সিল), আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, নেজামে ইসলাম ও জামাত-ই-ইসলামী যোগদান করে। সম্মিলিত বিরোধী দল নেতৃবৃন্দ আইয়ুব খানের বিপরীতে আযম খানকে প্রেসিডেন্ট পদের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেয়ার প্রস্তাব করে। আযম খান তাতে আপত্তি জানালে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেয়া হয় মিস ফাতেমা জিন্নাহকে। আযম খান নির্বাচনে ফাতেমা জিন্নাহর সমর্থনে নির্বাচনী প্রচারণা চালান এবং সম্মিলিত বিরোধী দলকে পূর্ণ সমর্থন দেন। মিস ফাতেমা জিন্নাহর পরাজয়ের পর আযম খান রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণের ঘোষণা দেন।
অবসর জীবন তিনি লাহোরে অতিবাহিত করেন এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। [আবু জাফর]