হক, সৈয়দ শামসুল
হক, সৈয়দ শামসুল (১৯৩৫-২০১৬) প্রখ্যাত কবি, কথা-সাহিত্যিক, ও নাট্যকার। কবিতা, উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প, অনুবাদ তথা সাহিত্যের সকল শাখায় অনলস পদচারণার কারণে তিনি সর্বমহলে ‘সব্যসাচী’ লেখক হিসেবে পরিচিত। সৈয়দ শামসুল হক ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর কুড়িগ্রাম জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন ও মাতা হালিমা খাতুন। সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন পেশায় ছিলেন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার।
সৈয়দ হক তাঁর বাবা-মায়ের আট সন্তানের মধ্যে ছিলেন জ্যেষ্ঠতম। সৈয়দ হকের শিক্ষাজীবন শুরু হয় কুড়িগ্রাম মাইনর স্কুলে। এরপর তিনি ভর্তি হন কুড়িগ্রাম হাই ইংলিশ স্কুলে। তার পিতার ইচ্ছায় তিনি ঢাকায় চলে আসেন এবং ভর্তি হন পুরানো ঢাকার কলেজিয়েট স্কুলে। ১৯৫০ সালে তিনি গণিতে লেটার নিয়ে ম্যাট্রিক (এস.এস.সি সমমান) পাশ করেন। প্রথমে পিতার ইচ্ছায় বিজ্ঞান নিয়ে লেখাপড়া করলেও পরবর্তীতে তিনি জগন্নাথ কলেজে মানবিক শাখায় ভর্তি হন এবং লজিকে লেটারসহ আই.এ পাশ করেন। অতঃপর তিনি ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে তৃতীয় বর্ষ পর্যন্ত লেখাপড়া করে আর পরীক্ষা দেন নি।
আইএ পরীক্ষা পাশ করার আগেই তাঁর পিতার মৃত্যু হয় এবং মা-সহ সাত ভাইবোনের দায়িত্ব তাঁর ওপর এসে পড়ে। তিনি অর্থ উপার্জনের জন্য ছদ্মনামে স্কুল ও কলেজের নোটবই, সিনেমার চিত্রনাট্য, কাহিনী ও গান লিখতে শুরু করেন। পাশাপাশি কবিতা, গল্প, উপন্যাস লিখতে থাকেন। তাঁর রচিত চিত্রনাট্য ও কাহিনী ‘শীত বিকেল’, ‘মাটির পাহাড়’, ‘তোমার আমার’, ‘কখগঘঙ’, ‘ছদ্মবেশী’, ‘অধিকার’, ‘বড় ভাল লোক ছিল’, ‘ময়নামতি’-র জন্য প্রাপ্ত পুরস্কার চলচ্চিত্র জগতে সুনাম অর্জন করে। গীতিকার হিসেবেও তিনি সিনেমা জগতে নন্দিত হন। তাঁর লেখা গান ‘হায়রে মানুষ রঙীন ফানুস’ এক সময় মানুষের মুখে-মুখে ছিল।
মুক্তিযুদ্ধের সময় সেপ্টেম্বরের ২২ তারিখে তিনি লন্ডন চলে যান। এবং সেখানে মহান মুক্তিযুদ্ধের নানা কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি লন্ডনের বিবিসিতে খণ্ড-কালীন চাকরি লাভ করেন। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের খবরটি তিনিই দৃপ্তকন্ঠে বিবিসি রেডিওতে পাঠ করে শুনিয়ে সমগ্র বাঙালি জাতিকে আনন্দে আত্মহারা করে তোলেন। লন্ডনে অবস্থানকালে তিনি বিবিসির বাংলা বিভাগে নিয়মিত নাটকের অনুষ্ঠান শুরু করেন। এর পূর্বে কোনোদিন এই বিভাগে নাটকের অনুষ্ঠান ছিল না।
তাঁর জীবনের প্রথম মঞ্চনাটক- ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, যা এই পর্যন্ত ২০০তম রজনী সফল মঞ্চ অভিনয় সমাপ্ত করেছে। এটি এখনও মুক্তিযুদ্ধের ওপরে রচিত সর্বপ্রধান নাটক হিসেবে বিবেচিত। ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ তাঁর মঞ্চসফল অপর একটি নাটক। তিনি শেকসপিয়রের বেশ কয়েকটি নাটক বাংলায় রূপান্তরিত করেন। কর্কট ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার পর চিকিৎসারত অবস্থায় তিনি মাত্র তেরো দিনে শেকসপিয়রের ‘হ্যামলেট’ নাটকটি অনুবাদ করেছিলেন।
বাংলাদেশের উপন্যাসে তিনিই প্রথম নাগরিক মধ্যবিত্তের জীবনের রূপকার। তাঁর রচিত ‘অনুপম দিন’, ‘দেয়ালের দেশ’, ‘এক মহিলার ছবি’, ‘সীমানা পেরিয়ে’, ‘জেসমিন রোড’, ‘বারো দিনের শিশু’, ‘কয়েকটি মানুষের সোনালি যৌবন’, ‘জনক ও কালো কফি’, ‘খেলারাম খেলে যা’ প্রতিটি উপন্যাসে তিনি মধ্যবিত্তের আশা নিরাশা হতাশা, বিকার ও অবক্ষয়ের চিত্র তুলে এনেছেন। তাঁর রচিত ‘রক্ত গোলাপ’ উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে প্রথম জাদুবাস্তবতা নিয়ে আসে পাঠকের কাছে, যে জাদুবাস্তবতা বিশ্বখ্যাত লেখক মার্কোয়েস তাঁর উপন্যাসে অনেক পরে নিয়ে আসেন।
মুক্তিযুদ্ধের অনুপম রূপকার হিসেবেও সৈয়দ শামসুল হক উপন্যাসে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রয়াস পেয়েছেন। তাঁর রচিত ‘একমুঠো জন্মভূমি’, ‘নিষিদ্ধ লোবান’, ‘তুমি সেই তরবারি’, ‘নীল দংশন’, ‘আমি বাসি তুমি বাসো তো’, ‘বালিকার চন্দ্রযান’, ‘স্মৃতিমেধ’, ‘দুধের গেলাশে নীল মাছি’, ‘অন্য এক আলিঙ্গন’, ‘বিনি পয়সার নীল গল্প’, ‘মহাশূন্যে পরান মাস্টার’, ‘ইহা মানুষ’, ‘এক যুবকের ছায়াপথ’, ‘দূরত্ব’, ‘স্বপ্নসংক্রান্ত’, ‘বাস্তবতার দাঁত ও করাত’, ‘প্রান্ত পর্যন্ত’, ‘ত্রাহি’, ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’, ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনী’ এবং আরও প্রচুর সংখ্যক উপন্যাসে তিনি চিত্রিত করেছেন তাঁর জন্মভূমির সংগ্রামের কাহিনী এবং মুক্তিযুদ্ধের জয়গাথা।
ছোটগল্পের প্রায় প্রতিটিতে তাঁর নিজস্ব ভাষা এবং স্বকীয়তা বিশেষভাবে পাঠকের মনোযোগ কাড়ে। আঠারো বছর বয়সে তাঁর প্রথম ছোট গল্পের বই ‘তাস’ প্রকাশিত হয়। কল্পিত জনপদ জলেশ্বরীকে নিয়ে তিনি রচনা করেন, ‘জলেশ্বরীর গল্পগুলো’। জলেশ্বরী মূলত তাঁরই জন্মস্থান কুড়িগ্রাম।
তাঁর রচিত ‘পূর্ণিমায় বেচাকেনা’, ‘স্বপ্নের ভেতরে বসবাস’, ‘প্রাচীন বংশের নিঃস্ব সন্তান’, ‘কবি’, ‘বুকের মধ্যে আশাবৃক্ষ’, ‘পরাজয়ের পর’ ইত্যাদি বিশ্বসাহিত্যের ছোটগল্পের ভাণ্ডারে এক অপূর্ব সংযোজন। তিনি প্রবন্ধ, নিবন্ধ, কলাম ও অসংখ্য শিশুতোষের রচয়িতা। ‘হডসনের বন্দুক’, ‘সীমান্তের সিংহাসন’, ‘আনু বড় হয়’, ‘আমার স্কুল’, ‘বঙ্গবন্ধুর বীরগাথা’ বাংলাদেশের শিশু ও কিশোর সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে।
কবিতায় তিনি নিজস্ব ঘরানা সৃষ্টি করতে পারঙ্গম ছিলেন। সাহিত্য রচনার জন্য তিনি নিজস্ব ভাষাশৈলী তৈরি করতে পেরেছিলেন। তাঁর রচিত, ‘আমি জন্মেছি বাংলায়, আমি বাংলায় কথা বলি, বাংলার আলপথ দিয়ে আমি হাজার বছর চলি’ আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার মুখে-মুখে আবৃত্ত। বাংলার মানুষের আঞ্চলিক ভাষাকে তিনি সগৌরবে বিশ্ব সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। ‘যে তার রুমাল নাড়ে পরাণের গহিন ভিতর’ বা ‘জাগো বাহে কোন্ঠে সবাই’ তাঁর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
তরুণ কবি ও কথা সাহিত্যিকদের সামনে তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর অভিজ্ঞতালব্ধ সৃজনশীল রচনার গোপন উপলব্ধির চাবিকাঠি। ‘মার্জিনে মন্তব্য/গল্পের কলকব্জা: কবিতার কিমিয়া’ তারই একটি উদাহরণ।
ভাষার শব্দভাণ্ডারকে তিনি তুলে এনেছেন অচেনা অজানা শেকড়ের অভিজ্ঞতা থেকে। ‘কথা সামান্যই’ এরকম একটি রচনা, যা এর আগে বাংলা সাহিত্যে কেউ সেভাবে আলোচনা করেন নি। দেশে-বিদেশে তাঁর রচনা অনুদিত, পঠিত এবং মঞ্চস্থ হয়েছে। অবসরকালীন সময়ে তিনি কাঠের কাজ এবং চিত্রকর্মে নিজকে ব্যস্ত রাখতেন। কবি-সব্যসাচী সৈয়দ হক প্রয়াত হবার পর তাঁর আঁকা ৫৬টি চিত্রকর্ম এবং দুটি কাঠের কাজ নিয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়।
তিনি টিভি জগতের স্বনামধন্য উপস্থাপক ছিলেন। তাঁর অনন্য উপস্থাপনা এবং পরিশীলিত বাংলা দর্শকদের বিপুলভাবে অনুপ্রাণিত করে। দীর্ঘ সাহিত্যজীবনে অসাধারণ অবদানের জন্য তিনি ভূষিত হয়েছেন বিভিন্ন পুরস্কারে, যেগুলোর মধ্যে ‘বাংলা একাডেমি’ পুরস্কার, ‘আদমজী সাহিত্য’ পুরস্কার এবং বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত ‘একুশে পদক’ উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও তিনি শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার হিসেবে দুবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাপ্ত হন।
সৈয়দ শামসুল হকের স্ত্রী প্রথিতযশা লেখিকা ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আনোয়ারা সৈয়দ হক। তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে সৈয়দ শামসুল হক ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। [সাব্বীর আহমেদ]
তথ্যসূত্র পরিবার কর্তৃক সরবরাহকৃত।