আহমেদ, জিয়াউদ্দিন
আহমেদ, জিয়াউদ্দিন (১৯৫২-২০১৭) বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধে ৯ নং সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার, সেনাবাহিনীর মেজর, বঙ্গবন্ধু হত্যা মালার অন্যতম সাক্ষী। জিয়াউদ্দিন আহমেদ ১৯৫২ সালের ১লা জানুয়ারি পিরোজপুর জেলার সদর উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম এডভোকেট আফতাবউদ্দিন আহমেদ এবং মাতার নাম সাহিদা বেগম। তাঁর প্রকৃত নাম আলী হায়দার জিয়াউদ্দিন, তবে মেজর জিয়াউদ্দিন নামেই তিনি অধিক পরিচিত। পিরোজপুর সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ১৯৬৯ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং ১৯৭০ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর কমিশনপ্রাপ্ত হন। সেনাবাহিনীতে যোগদানের পরই তিনি পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বৈষম্য সম্পর্কে অবহিত হন এবং স্বাধীনতা অর্জন ছাড়া বাঙালির মুক্তি নেই - এ বিষয়টি তিনি যথার্থভাবেই উপলব্ধি করতে পারেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি লেফটেন্যান্ট পদে কর্মরত ছিলেন।
১৯৭১ সালের ২১শে মার্চ জিয়াউদ্দিন আহমেদ ছুটি নিয়ে পাকিস্তান থেকে পিরোজপুরের নিজ বাড়িতে আসেন। ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি সামরিক জান্তা অপারেশন সার্চলাইট-এর নামে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে ঐ দিন রাত থেকেই মুক্তিযুদ্ধে তাঁর তৎপরতা শুরু হয়। ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য তিনি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। দুর্ধর্ষ পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাস্ত করার জন্য তিনি গেরিলা বাহিনী গঠনের ওপর জোর দেন। এজন্য গেরিলা যুদ্ধের উপযুক্ত স্থান হিসেবে তিনি সুন্দরবনকে বেছে নেন। সেক্টরভিত্তিক যুদ্ধ শুরু হলে তিনি নবম সেক্টরের অধীনে সুন্দরবন সাব-সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন।
২৬শে মার্চ পিরোজপুরে আওয়ামী লীগের জনসভার পরই জনতা ট্রেজারি দখল করে সমস্ত অস্ত্র লুট করে নেয়। এর কয়েকটি জিয়াউদ্দিন আহমেদের হস্তগত হয়। সেগুলো দিয়ে তিনি সেদিন রাতেই নিজ বাড়ির পার্শ্ববর্তী বৈরাগী বাড়িতে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ প্রদান শুরু করেন। ২৭শে মার্চ ২০ জনের মতো সিপাহি, ল্যান্সনায়েক, হাবিলদার, সুবেদার ও ছাত্র-যুবককে নিয়ে সরকারি স্কুল ময়দানে তিনি মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ শুরু করেন। দু/একদিনের মধ্যে হাজার-হাজার জনতা এখানে সমবেত হলে তাদের মধ্য থেকে ১৪০০ জনকে প্রশিক্ষণের জন্য বাছাই করা হয়। এ সময় জিয়াউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে ছিলেন সেনা, নৌ, বিমান ও আনসার বাহিনীর দু’শতাধিক সদস্য। এদের নিয়ে জিয়াউদ্দিন আহমেদ মুক্তিফৌজ গঠন করেন। তাঁদের সঙ্গে ছিল ট্রেজারি থেকে লুট করে আনা ২৪০টি রাইফেল। মুক্তিফৌজ এনায়েত হোসেন খান এমএনএ-কে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করে। একই সময়ে পিরোজপুরে এনায়েত হোসেন খান এমএনএ-কে প্রধান করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা পরিষদ গঠন করা হয়। এ পরিষদের অধীনে মুক্তিফৌজ কাজ করে।
এপ্রিল মাসের প্রথমদিকে জিয়াউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে কাউখালী, কাঠালিয়া, ভান্ডারিয়া, মঠবাড়িয়া ও শরণখোলা থানার পুলিশকে নিরস্ত্র করে তাদের অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দেয়া হয়। পরবর্তীতে জিয়াউদ্দিন আহমেদ সুন্দরবনে শতাধিক ঘাঁটি স্থাপন করে প্রায় ১৪ হাজার মুক্তিযোদ্ধার এক বিশাল বাহিনী গড়ে তোলেন। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস তিনি ও তাঁর বাহিনী অত্র অঞ্চলে বীরত্বপূর্ণ লড়াই করে পাকিস্তানি বাহিনীকে পর্যুদস্ত করেন। একজন অকুতোভয় যোদ্ধা ও দক্ষ সংগঠক হিসেবে চতুর্দিকে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধকালে বিভিন্ন অপারেশনে সংগৃহীত একবস্তা স্বর্ণ-অলঙ্কার জেনারেল ওসমানীর মাধ্যমে কলকাতায় বাংলাদেশ সরকারের কোষাগারে জমা দিয়ে জিয়াউদ্দিন আহমেদ প্রশংসিত হন।
স্বাধীনতার পর জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চাকরিতে অন্তর্ভুক্ত হন। তিনি প্রথমে ক্যাপ্টেন এবং ১৯৭৪ সালের শেষদিকে মেজর হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭৫ সালে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থায় কর্মরত ছিলেন জিয়াউদ্দিন আহমেদ। পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ নৃশংস হত্যাকা-ের পর মেজর জিয়াউদ্দিন আহমেদ চাকরিচ্যুত হন এবং তাঁকে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়। বিচারে মেজর জিয়াউদ্দিন আহমেদকে দোষী সাব্যস্ত করে ১৪ বছর কারাদ-ে দ-িত করা হয়। পরে তিনি বিচারিক প্রক্রিয়ায় দ- থেকে অব্যাহতি লাভ করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলায় মেজর জিয়াউদ্দিন আহমেদ অন্যতম সাক্ষী ছিলেন। ১৯৮৯ সালে তিনি পিরোজপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। পরবর্তী সময়ে তিনি সুন্দরবনকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে তোলেন। ব্যবসার পাশাপাশি তিনি সুন্দরবনে দুবলার চরে জেলেদের আর্থিক নিরাপত্তা, জলদস্যু দমন, দুর্যোগ মোকাবেলায় সাইক্লোন সেন্টার নির্মাণসহ বিভিন্ন সেবা কর্মে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর লেখা গ্রন্থগুলোর মধ্যে ‘মুক্তিযুদ্ধে সুন্দরবনের সেই উন্মাতাল দিনগুলি’ এবং ‘সুন্দরবন সমরে ও সুষমায়’ গ্রন্থদ্বয় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি স্মারক হিসেবে উল্লেখযোগ্য।
জিয়াউদ্দিন আহমেদ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে ৬৭ বছর বয়সে ২০১৭ সালের ২৭শে জুলাই সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সিঙ্গাপুর থেকে তাঁর মরদেহ ঢাকায় আনা হলে ৩০শে জুলাই সর্বস্তরের জনগণের শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য তা জাতীয় শহীদ মিনারে নেয়া হয়। ১লা আগস্ট তাঁকে পিরোজপুরে নিজ বাড়িতে বাবা-মায়ের কবরের পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়। তাঁর মৃত্যুতে মন্ত্রিসভার বৈঠকে একটি শোকপ্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। তাঁর স্ত্রীর নাম কানিজ মাহমুদা পাপড়ি। তিনি দুই পুত্র এবং দুই কন্যা সন্তানের জনক। [মনিরুজ্জামান শাহীন]