আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ
আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইসকন) একটি বৈষ্ণব সাধক সম্প্রদায়। এর প্রতিষ্ঠাতা আচার্য কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ (১৮৯৬-১৯৭৭)। সংক্ষেপে তিনি শ্রীল প্রভুপাদ নামে পরিচিত। তাঁর প্রকৃত নাম অভয়চরণ দে। তিনি ১৯৬৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যান এবং ১৯৬৬ সালের জুলাই মাসে নিউইয়র্কে এ সংঘ (International Society for Krishna Consciousness ISKCON) প্রতিষ্ঠা করেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এ সংস্থাটি পরিচালনা করেন এবং শতাধিক মন্দির, আশ্রম, স্কুল ও কৃষ্ণকেন্দ্রের সমন্বয়ে এটিকে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইসকনের ৩৫০টিরও বেশি মন্দির রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মায়াপুরে এর প্রধান মন্দির অবস্থিত। বাংলাদেশে ১৯৭৮ সাল থেকে ইসকনের কর্মকান্ড শুরু হয় এবং বর্তমানে এ দেশে এর মোট ১২টি মন্দির রয়েছে। ঢাকার মন্দিরটি বনগ্রামে অবস্থিত; অন্যগুলি চট্টগ্রাম, সিলেট, যশোর, কুমিল্লা শহরে অবস্থিত। ঢাকার মন্দিরের প্রধান হচ্ছেন শ্রীমৎ চারুচন্দ্র দাস ব্রহ্মচারী এবং বাংলাদেশে ইসকনের প্রধান হচ্ছেন শ্রীমৎ কৃষ্ণকীর্তন দাস ব্রহ্মচারী।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের হাজার হাজার মানুষ প্রভুপাদ প্রবর্তিত এ মতাদর্শে আকৃষ্ট হয়ে কৃষ্ণনামে দীক্ষিত হচ্ছেন এবং একটি বৃহৎ কৃষ্ণ-পরিবার তৈরি করে তারা চৈতন্যদেব প্রবর্তিত বৈষ্ণবীয় জীবনাচার পালন করছেন। ঢাকার মন্দিরে অনেক মার্কিনি রয়েছেন, যাঁরা গেরুয়া পরে ও তিলক কেটে কৃষ্ণসাধনায় নিবেদিত। চৈতন্যদেব প্রবর্তিত ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম’ কীর্তন ইসকন অনুসারীদের মূল মন্ত্র।
ইসকনের প্রধান উদ্দেশ্যসমূহ হলো: ক. সুশৃঙ্খলভাবে মানবসমাজে ভগবৎতত্ত্ব প্রচার করা, যাতে মানুষ পারমার্থিক জীবনযাপনে আগ্রহী হয় এবং জীবনের সত্য উপলব্ধি করে পৃথিবীতে সাম্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে; খ. ভগবদ্গীতা ও শ্রীমদ্ভাগবতের দর্শন অনুসারে কৃষ্ণভাবনার তত্ত্ব বিশ্বে প্রচার করা; গ. শ্রীচৈতন্য প্রবর্তিত ভগবানের নামকীর্তন আন্দোলন সম্পর্কে সকলকে শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা দেওয়া; ঘ. সকল মানুষকে সরল ও স্বাভাবিক জীবন যাপনের একটি পদ্ধতি সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া এবং ঙ. এ সকল উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে বিভিন্ন গ্রন্থ ও সাময়িক পত্রাদি বিতরণ করা।
ইসকন মন্দিরের প্রাত্যহিক কর্মসূচি হচ্ছে মঙ্গলারতি, জপতপ, গুরুপূজা, প্রার্থনা, ভাগবত পাঠ, প্রসাদ বিতরণ, ভজন-কীর্তন ইত্যাদি। প্রতি শুক্রবার বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান পালিত হয়। এ ছাড়া মানুষের আধ্যাত্মিক ও জাগতিক কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে ইসকন বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে, যেমন আধ্যাত্মিক আলোচনার মাধ্যমে তারা স্রষ্টার মহিমা প্রচার করে। এ জন্য রয়েছে শ্রীহরেকৃষ্ণ সংঘ ইত্যাদি প্রচার দল। এরা শাস্ত্রের যথার্থ ব্যাখ্যা ও আধ্যাত্মিকতা প্রচারের মাধ্যমে মানুষের অজ্ঞানতা ও কুসংস্কার দূর করার চেষ্টা করে। তাছাড়া ডাকযোগে সর্বস্তরের লোকদের গীতা শিক্ষা দেওয়ারও ব্যবস্থা রয়েছে। ইসকনের এ প্রচেষ্টাকে বাস্তবায়িত করার জন্য ঢাকা থেকে হরেকৃষ্ণ সমাচার (মাসিক) ও অমৃতের সন্ধানে (ত্রৈমাসিক) এবং চট্টগ্রাম থেকে চৈতন্য সন্দেশ নামক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। গীতার দর্শন ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যমে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে আনাও তাদের অন্যতম উদ্দেশ্য। প্রতি শুক্রবার সমাজের সর্বস্তরের ৫০০-৬০০ লোককে খাদ্য প্রদান করা তাদের একটি উল্লেখযোগ্য সমাজসেবামূলক কাজ। এ ছাড়া শিশুদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা আছে এবং দরিদ্রদের মধ্যে দাতব্য চিকিৎসা প্রদানের একটি পরিকল্পনাও হাতে নেওয়া হয়েছে।
[মনোরঞ্জন ঘোষ]