কৃষি উৎপাদনশীলতা
কৃষি উৎপাদনশীলতা (Agricultural Productivity) কৃষিখাতে উৎপাদন এবং উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উপকরণাদির পারস্পরিক সম্পর্কের একটি পরিমাপ। একটি অঞ্চলের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যসহ কৃষি উৎপাদনশীলতা অনেকগুলি উপাদানের ওপর নির্ভরশীল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য জলবায়ু, পানি নিয়ন্ত্রণ, উৎপাদন প্রযুক্তি, কৃষকের শিক্ষা ও দক্ষতার মাত্রা এবং পরিবহণ ও অন্যান্য অবকাঠামোগত উপাদান, সম্প্রসারণ ও উপকরণাদি সরবরাহ প্রণালী, গবেষণা ও তার ফলাফল প্রচার ইত্যাদি। উন্নতমানের বীজ, সার, কীটনাশক ইত্যাদির অপর্যাপ্ত সরবরাহ, যথাযথ সেচব্যবস্থা ও কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকান্ডের অভাব এবং বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রকোপ দেশের কৃষির উৎপাদনশীলতাকে যথেষ্ট প্রভাবিত করে।
ভূসংস্থান, জমি ব্যবহারের ধরন, মাটির বৈশিষ্ট্য, জলবায়ু ও শস্যের বৈচিত্র্য ইত্যাদি বিবেচনার নিরিখে গোটা দেশকে ৩০টি কৃষি বাস্তসংস্থানিক অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে যেগুলিতে কৃষির উৎপাদনশীলতায় বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। বাংলাদেশের কৃষির উৎপাদনশীলতা পরিমাপের একটি উপায় হলো উৎপন্ন দ্রব্যগুলিকে বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভাজন এবং প্রতিটির উৎপাদনশীলতা বিশ্লেষণ। বাংলাদেশের কৃষিজাত সামগ্রী খাদ্যশস্য, ফল, পশুসম্পদ, বনজ সম্পদ ও মৎস্য সম্পদ শ্রেণি হিসেবে আর ফসলগুলি প্রধানত খাদ্যশস্য, ডালশস্য, তৈলবীজ, আাঁশ, মাদক, পানীয়, চিনি, মূল ও কন্দ, মসলা, শাকসবজি ইত্যাদি উপশ্রেণী হিসেবে বিভাজ্য হতে পারে। ধান দেশের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ন খাদ্যশস্য এবং দানাদার ফসলে ধানের অংশ প্রায় ৯৫%। ধানের চাষাধীন জমি প্রায় ১০.৫৩ মিঃ হেক্টর, দেশের সমগ্র আবাদি জমির প্রায় ৮০%। ১৯৯৫-৯৬ থেকে ২০০৫-০৬ দশকে দেশী জাতের ধান উৎপাদন কমেছে ২১%, উচ্চ ফলনশীল ও গড় ধানের ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে যথাক্রমে ৮০% ও ৫০%। এই সময়কালে বর্ধিত উপাদান ব্যবহারের তুলনায় উৎপাদন বৃদ্ধির নিরিখে উৎপাদনশীলতা প্রায় শূন্যের কোঠাতেই রয়ে গেছে এবং শস্য উৎপাদনের ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে জমির উর্বরতা হ্রাস এবং সার ও অন্যান্য রাসায়নিক উপাদানের অসম ব্যবহারের জন্যই প্রধানত তা ঘটেছে। উল্লিখিত দশকে ভূট্রার ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে ১৭,০০০% (৩,০০০ মে টন থেকে ৫২২,০০০ মে টনে বৃদ্ধি), গম, যব, জোয়ার, বাজরা, চীনা ইত্যাদি খাদ্যশস্যের উৎপাদনে নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা যায়। ১৯৮৫-১৯৮৬ এবং ২০০৫-০৬ এই দুই দশকের মধ্যে ডালের উৎপাদন ও জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে যথাক্রমে ৪৭% ও ৬২%, কিন্তু উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন প্রযুক্তি ও উচ্চফলনশীল জাতের অভাবে এবং সেইসঙ্গে নিম্নমানের কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকান্ডের দরুন উৎপাদনশীলতা ক্রমাগত হ্রাস পেয়েছে। ১৯৮৫-৮৬ ও ২০০৫-০৬ সময়কালে দেশে তৈলবীজ উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১২৫%, কিন্তু এই সময়ে আনুপাতিক হারে তৈল চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন এখন ও যথেষ্ট কম।
ইতোমধ্যে প্রধান অাঁশ-শস্য পাটের জমির পরিমাণ, উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা ক্রমাগত হ্রাস পেতে থাকে আর এই সময় তুলার উৎপাদনশীলতা কমলে ও তুলার জমির পরিমাণ ও মোট উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়।
একই সময়কালে পানীয়, মাদক, মূল ও কন্দ, মসলা ও সুগন্ধি জাতীয় ফসলের উৎপাদন যথাক্রমে ১২-২৭৬% বৃদ্ধি পায়। চিনি উৎপাদন ক্রমাগত কমতে থাকে এবং ফল ও শাকসবজি উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। ১৯৮৫-২০০৭, এই দুই দশকে গরুর খামার ও হাঁস-মুরগির খামার উন্নয়নের ফলে পশুসম্পদ ও হাঁস-মুরগি (ডিম, মাংস ও দুধ) যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়, এমনকি মৎস্যসম্পদের ও বার্ষিক উৎপাদন উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটে, আর খুব তাৎপর্যশীল না হলে ও এটা হলো চিরাচরিত গৃহপালন পদ্ধতির পরিবর্তে একটি সংগঠিত ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য সরকার, এনজি ও এবং দাতাদের পরামর্শে ব্যক্তিগত খাতের ইতিবাচক সাড়ার সুফল।
বিভিন্ন কৃষি উৎপাদনের মধ্যে উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা উভয় দিক থেকেই বনজ সম্পদ প্রকৃত পরিমাণে খুব বৃদ্ধি পায়নি। ১৯৮৫-৮৬ থেকে ২০০৫-০৬ সময়ে দেশে বনভূমি ২.২৬ মি. হেক্টর থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২.৬০ মি. হেক্টর হয়েছে এবং কাঠ উৎপাদন প্রায় ৩০% বৃদ্ধি পেয়েছে। অতিরিক্ত পরিমাণে ও অপরিকল্পিতভাবে গাছকাটা, কৃষিকাজের জন্য বনভুমি আগ্রাসন ও আবাদ এবং সর্বোপরি যথাযথ যত্ন ও ব্যবস্থাপনার অভাবে বনভুমির লক্ষনিয় পরিবর্তন হয়নি। উল্লিখিত সময়ে কৃষির সামগ্রিক উৎপাদনশীলতা খুব সন্তুষজনক নয় বিধায় অবস্থার উন্নতিকল্পে সরকার বর্তমানে নিজের ও দাতাদের সাহায্যপুষ্ট অনেকগুলি কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। এগুলির মধ্যে প্রধানত রয়েছে অধিক পরিমাণে উন্নতমানের বীজ, সার, কীটনাশক ইত্যাদি সরবরাহ, সেচ সুবিধা প্রদান এবং কৃষিকাজ ও ব্যবস্থাপনার ওপর গবেষণা, উন্নতমানের কৃষি সম্প্রসারণ কার্যক্রম এবং উৎপাদনের লক্ষমাত্রা অনুযায়ী ব্লকভিত্তিক প্রশিক্ষণ। অবশ্য অভ্যন্তরীণ ও প্রাতিষ্ঠানিক কিছু দুর্বলতা থাকার দরুন তৃণমূল পর্যায়ে এসব সেবাকর্ম খুব দ্রুত পৌছায় না। [মোঃ হযরত আলী]