জগন্নাথ কলেজ
জগন্নাথ কলেজ বাংলাদেশের একটি অন্যতম পুরনো ও নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। মানিকগঞ্জ জেলার বালিয়াটির জমিদার কিশোরীলাল চৌধুরী ১৮৬৮ সালে তাঁর পিতার নামে ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করেন জগন্নাথ স্কুল। ১৮৮৪ সালের ৪ জুলাই জগন্নাথ স্কুলটি জগন্নাথ কলেজে উন্নীত হয়।
১৯০৭ সালের ১ মার্চ একটি দলিলের মাধ্যমে ট্রাস্টি বোর্ডের হাতে কলেজের ভার অর্পণ করা হয়। কিশোরীলাল রায় চৌধুরী, রায়চন্দ্র কুমার দত্ত বাহাদুর ও আনন্দচন্দ্র রায় ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য নির্বাচিত হন। কিশোরীলাল রায় চৌধুরীর মৃত্যুর পর ১৯০৯ সালের ২৪ আগস্ট সম্পাদিত নতুন দলিল অনুযায়ী পুনরায় ট্রাস্টি বোর্ড গঠিত হয়। ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ছিলেন রায় চন্দ্রকুমার দত্ত বাহাদুর, আনন্দচন্দ্র রায়, যশোদালাল চৌধুরী, কুমার রমেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী ও দীনেশচন্দ্র রায়। এ সময় ঢাকার কমিশনার স্যার রবার্ট নাথানের প্রচেষ্টায় আশি হাজার টাকার অনুদান পাওয়া যায়। এই অর্থে কলেজের দোতলা ভবন তৈরি হয়। জগন্নাথ কলেজের শুরুতে ছাত্রসংখ্যা ছিল ৪৮। ১৯১০ সালের পূর্বেই ছাত্রের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫০০। সেই সময়েই এই কলেজে আই.এ, আই.এস.সি ও বি.এ (পাস) ছাড়াও ইংরেজি, দর্শন ও সংস্কৃত বিষয়ে অনার্স এবং ইংরেজিতে এম.এ পড়ানো হতো। ১৯১৭-১৮ সালে ছাত্রের সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৪৩। এর মধ্যে আই.এ ক্লাসে ৫৪০ এবং ৩য়-৪র্থ বর্ষে ৩০৩। সন্তোষের জমিদার রাজা মন্মথ রায় চৌধুরী ১৯১০ সালে কলেজ কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের অনুমতিক্রমে টাঙ্গাইলস্থ প্রমথ-মন্মথ কলেজটিকে জগন্নাথ কলেজের সঙ্গে যুক্ত করেন। তিনি কলেজের গেটের পাশে প্রিন্সিপালের বাসগৃহ নির্মাণ করে দেন।
১৯১৯ সালের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সম্ভাব্যতা স্বীকার করে। কেননা সেই সময়ের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে জগন্নাথ কলেজ ও ঢাকা কলেজ থেকে স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চালু করার সুযোগ ছিল। ঢাকা কলেজ যেহেতু সরকারি কলেজ এ থেকে শিক্ষার্থী নিয়ে আসার কোনো অসুবিধা ছিল না। কিন্তু জগন্নাথ কলেজ যেহেতু ব্যক্তিবিশেষের দানে গড়ে উঠা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কাজেই এর অঙ্গচ্ছেদের ক্ষেত্রে আইনগত জটিলতা দেখা দেয়। ফলে ভারতীয় লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে Jagannath College Act (Act. No. xvi of 1920) পাস হয়। এ আইনে জগন্নাথ কলেজ ট্রাস্ট ভেঙ্গে দিয়ে কলেজ ও এর সম্পত্তি বাংলার গভর্নরের হাতে ন্যস্ত করা হয়।
১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। মূলত জগন্নাথ কলেজ ও ঢাকা কলেজের ডিগ্রি ক্লাসের ছাত্রদের নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ক্লাস শুরু হয়। তখন জগন্নাথ কলেজের ৩য় ও ৪র্থ বর্ষে ছাত্রসংখ্যা ছিল ৩০৩। জগন্নাথ কলেজের এসব ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তরিত হলে জগন্নাথ কলেজ ইন্টারমিডিয়েট কলেজে পরিণত হয়। কলেজের নতুন নাম হয় ‘জগন্নাথ ইন্টারমিডিয়েট কলেজ’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সহযোগিতা দানের সম্মানে বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’টি হলের নামকরণ করা হয়: জগন্নাথ হল ও ঢাকা হল (বর্তমানে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল)। ১৯৪৭ সালের পূর্ব পর্যন্ত দু’টি হলের পুনর্মিলনী উৎসব পালিত হতো জগন্নাথ কলেজ ও ঢাকা কলেজের ছাত্র সহযোগে। এই দুই কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নে কেবল ছাত্র নয়, এমনকি শিক্ষক এবং লাইব্রেরির বই দিয়েও সহযোগিতা করেছিল। উল্লেখ্য, প্রাথমিক স্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার গঠিত হয়েছিল এই দুই কলেজের গ্রন্থাদি দিয়ে।
জগন্নাথ কলেজ অ্যাক্ট পাস হওয়ার পর কলেজের ট্রাস্টি বোর্ডের বিলুপ্তি ঘটিয়ে গঠিত হয় একটি কলেজ গভর্নিং বডি। গভর্নিং বডির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় ১৯২১ সালের ২০ আগস্ট।
জগন্নাথ কলেজের প্রথম গভর্নিং বডির সদস্য ছিলেন:
টি. এমারসন, আই.সি.এস, আই.ই (কমিশনার, ঢাকা ডিভিশন) পদাধিকার বলে সভাপতি
খান বাহাদুর খাজা মোহাম্মদ আজম খান
নওয়াব খাজা মোহাম্মদ ইউসুফ খান বাহাদুর
পি.কে বোস, বার-এট-ল
শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী
রেবতীমোহন দাস
ধীরেন্দ্র চন্দ্র রায়
রাসবিহারী বোস (ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ)।
জগন্নাথ কলেজের সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠিত হয় ১৯৩৫ সালের ২০ মার্চ। সন্তোষের মহারাজা মন্মথ রায় চৌধুরী এতে সভাপতিত্ব করেন। জগন্নাথ কলেজে ছাত্র সংখ্যা দাঁড়ায় জুলাই ১৯৩৬ সালে ৭৩৭ জন, সেপ্টেম্বর ১৯৩৬ সালে ৮৩২ জন এবং জুলাই ১৯৪৭ সালে ১৭০০ জন। ১৯৪৮-১৯৪৯ সালে বি.কম ও বি.এ কোর্স পুনরায় চালু হয়। রাতে ডিগ্রি ক্লাস খোলা হয় অর্থাৎ নৈশ কোর্স চালু হয়। এ সময় কলেজ থেকে কো-এডুকেশন ব্যবস্থা রহিত হয়। ১৯৫৯ সালে বি.এস.সি ক্লাস চালু হয়। ১৯৬৪ সালে ছাত্রের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৫০০। এই সময় এই ছাত্রসংখ্যার সঙ্গে বি.এস.সি ক্লাসের ছাত্রসংখ্যা যুক্ত হয়। কলেজটি পুরোপুরি সরকারি কলেজে রূপান্তরিত হয় ১৯৬৮ সালের ১ আগস্ট। এবার সরকার জগন্নাথ কলেজের কিছু কাঠামোগত পরিবর্তন সাধনে এগিয়ে আসেন এবং কলেজকে ইন্টারমিডিয়েট কলেজে রূপান্তরিত করে মহাখালীতে জিন্নাহ কলেজ (বর্তমানে তিতুমীর কলেজ) নামে নতুন একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু ছাত্রশিক্ষক এবং জনগণের চাপে এক বছরের মধ্যে জগন্নাথ কলেজকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়। এর ডিগ্রি ক্লাসগুলি পুনঃস্থাপিত হয়। এ সময় সরকার জগন্নাথ কলেজের সকল অধ্যাপককে দুটো স্তরে ভাগ করে তাঁদের বহাল রেখে চিঠি প্রদান করেন। তখন সরকারি বিধানে প্রফেসর ও লেকচারার এই দুটো স্তর ছিল। সরকার শিক্ষকদের মধ্য থেকে মাত্র ২৬ জনকে প্রফেসর হিসেবে এবং ৪৪ জনকে লেকচারার হিসেবে চাকরিতে বহাল রাখেন। কোনো শিক্ষককেই চাকরিচ্যুত করেন নি বা বদলির আদেশও দেন নি।
১৯৭২ সালে কলেজে অনার্স কোর্স ও পরে মাস্টার্স কোর্স খোলা হলে ছাত্রসংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। ১৯৮২ সালে কলেজের ইন্টারমিডিয়েট ক্লাস তুলে দেওয়া হয়। তখন কেবল নৈশ শাখায় বি.এ, বি.এসসি, বি.কম কোর্স রাখা হয়। ১৯৯২ সালে নৈশ ১ম পর্ব ও শেষ পর্ব মাস্টার্স কোর্স চালু হয়। তখন ডিগ্রি পাস কোর্স বিলুপ্ত করা হয়। এ সময় ছাত্রছা্ত্রীর সংখ্যা দাঁড়ায় ২৫ হাজারে। কলেজে দিবা শাখায় ১৬০ জন এবং নৈশ শাখায় ১৪১ জন নিয়ে মোট শিক্ষকশিক্ষিকার সংখ্যা ছিল ৩০১ জন। নতুন পদ সৃষ্টি হওয়ার ফলে এক বছরের মধ্যে ১৯৯২ সালে ২৫০ জন শিক্ষকের সংখ্যা বেড়ে গিয়ে ৩৮০ জনে দাঁড়ায়। এর মধ্যে ১২ জন ডেমনস্ট্রেটরও ছিলেন। ২০০২ সালে কলেজের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল ৩৫ হাজারের মতো।
জগন্নাথ কলেজ প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন: শ্রীকুঞ্জ লাল নাগ (১৮৮৪-১৮৯৫), বৈকুণ্ঠ কিশোর চক্রবর্তী (১৮৯৫-১৯০২), হেরম্ব চন্দ্র মৈত্রেয় (১৯০২-১৯০৪), রায় বাহাদুর ললিত মোহন চ্যাটার্জি (১৯০৪-১৯২১), রায় বাহাদুর সত্যেন্দ্রনাথ ভদ্র (১৯২১-১৯৪১), শৈলেন্দ্র নাথ ঘোষ (১৯৪১-১৯৪৭), যোগেশচন্দ্র ঘোষ (১৯৪৭-১৯৪৮), খান বাহাদুর আব্দুর রহমান খান (১৯৪৮-১৯৫৩), ড. এনামুল হক (১৯৫৩-১৯৫৪), ড. সুরত আলী খান (১৯৫৪-৫৫), খান বাহাদুর আব্দুর রহমান খান (১৯৫৫-৫৬), শেখ শারাফুদ্দিন (১৯৫৬-১৯৬৩), সাইদুর রহমান (১৯৬৩-১৯৬৭), মোঃ ইরশাদুল্লাহ (১৯৬৭-১৯৭০), আ.ন.ম বজলুর রহমান (১৯৭২-১৯৮২), ড আশরাফ সিদ্দিকী (১৯৮২-১৯৮৪), ড কিউ.এ.টি.এম হাবিবুর রহমান (১৯৯০-১৯৯৪)।
২০০৫ সালে জাতীয় সংসদে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হয়। ফলে জগন্নাথ কলেজ বাংলাদেশের অন্যতম বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়। ২০০৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজির প্রফেসর ড সিরাজুল ইসলাম খান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে যোগদান করেন।
ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফা ও ১১ দফা আন্দোলনসহ বিভিন্ন আন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এ কলেজের প্রসংশনীয় অবদান রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালে কলেজে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্প ছিল। স্বাধীনতার পর কলেজ ক্যাম্পাস থেকে একাধিক গণকবর আবিষ্কৃত হয়।
[মির্জা হারুন-অর-রশিদ]