জামান, বেবী
জামান, বেবী (১৯৩৩-২০১৩) একজন মেধাবী-শক্তিমান অভিনেতা ও চলচ্চিত্র প্রযোজক হিসেবে বাংলাদেশের দর্শকনন্দিত জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। ২৮শে ফেব্রুয়ারি ১৯৩৩ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার অন্তর্গত হালদি নওপাড়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পারিবারিক নাম চৌধুরী বদরুজ্জামান। পিতা চৌধুরী আজফার হোসেন কলকাতা বিশ^বিদ্যালয় থেকে প্রথমে ১৯২৪ সালে বি.এস.সি ও ১৯২৭ সালে এম.এস.সি পাশ করেন। তিনি ১৯২৮ সালে এল.এল.বি পাশ করে বর্ধমানে ওকালতি শুরু করেন। বেবী জামানের মাতার নাম মোসলেমা খাতুন। চার ভাই, তিন বোনের মধ্যে বেবী জামান ছিলেন দ্বিতীয় সন্তান।
বর্ধমান টাউন স্কুলে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বেবী জামান শিক্ষা গ্রহণ করনে। বাবা পরিবারের ভরণ-পোষণ চালাতে হিমশিম খেতেন। পরিবারে আর্থিক অনটন লেগেই থাকতো। বেবী জামান অষ্টম শ্রেণিতে পাঠরত অবস্থায় (১০-১২ বছর বয়স) কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হন। তাই তিনি বাবার অগোচরে বিভিন্ন ধরনের কাজ করে উপার্জিত অর্থ মায়ের হাতে তুলে দিতেন। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ পরবর্তী ভারত ভাগের পর ১৯৫০ সালে ১৮ বছর বয়সে তিনি একক সিদ্ধান্তে বর্ধমান থেকে ঢাকায় চলে আসেন। যদিও তাঁর বড় ভাই এক বছর আগে ঢাকায় আসেন কিন্ত তার সাথে বেবী জামানের কোন যোগাযোগ ছিল না। নতুন দেশ, সম্পূর্ণ অপরিচিত পরিবেশ বেবী জামান জীবিকার জন্য কাজ খুঁজতে থাকেন। সীমিত লেখাপড়ার জন্য তেমন ভালো কোন কাজ তিনি পাচ্ছিলেন না। অবশেষে সুরকার মালিক মনসুরের সহযোগিতায় ই.পি.আরÑএর বেজ ড্রাম বাদক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। কিছুদিন পর ১৯৫৪ সালে এই চাকরি ছেড়ে গেন্ডারিয়ায় একটি কেমিক্যাল ও ঔষধ ফ্যাক্টরিতে শিশি বোতল ক্লিনিংয়ের ব্যবসা শুরু করেন এবং আর্থিক সাফল্য লাভ করেন। এ সময় বেবী জামান পুরান ঢাকার গে-ারিয়ার ১৬নং শাখারী নগরলেনে দুইতলা বিশিষ্ট একটি বাসা ভাড়া করে সেখানে বসবাস শুরু করেন। তখন থেকেই এই বাড়িটি তাঁর এবং তাঁর পরিচিত সকল সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গের শিল্পচর্চার কেন্দ্র হয়ে ওঠে। তিনি ছিলেন অতিথি বৎসল একজন মানুষ। তাঁর এই বাড়িটি অতিথিশালা বলে পরিচিত ছিল। এবাড়িতে থাকতেই বেবী জামানের সংস্কৃতি চর্চা শুরু। অনেক গুণী শিল্পী বিশেষ করে অভিনয় শিল্পী তাঁর এই বাড়িতে আসা-যাওয়া করতেন। পরবর্তীতে এই গেন্ডারিয়ায় থাকাতেই তিনি তাঁর মা, বাবা, ভাই, বোনদের বর্ধমান থেকে ঢাকায় নিয়ে আসেন।
সফলভাবে ব্যবসার পাশাপাশি ১৯৫৮ সাল থেকে তিনি অভিনয়কে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে মনস্থির করেন। লালকুঠি মঞ্চে (নর্থব্রুক হল) এবং ঢাকার অন্যান্য মঞ্চে তিনি নিয়মিত অভিনয় শুরু করেন। এ সময়ে অভিনয়ের মাধ্যেমে পরিচিত হন সৈয়দ হাসান ইমাম, কাজী খালেক, আকতার হোসেন, এটিএম সামসুজ্জামান, শওকত আকবর, সুভাষ দত্ত, বুলবুল আহমেদসহ আরো অনেকের সাথে। বেবী জামান ১৯৬৩ সালে কাজী খালেকের পরিচালনায় মেঘ ভাঙ্গা রোদ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে প্রথম অভিনয় শুরু করেন। তাঁর অভিনীত পরবর্তী মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র সুভাষ দত্ত পরিচালিত সুতরাং ছবি। এটি মুক্তি পায় ১৯৬৪ সালে। সুতরাং চলচ্চিত্রে তিনি নায়িকা কবরী’র স্বামীর চরিত্রে অভিনয় করেন। তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্রের মধ্যেÑ মেঘ ভাঙ্গা রোদ, নতুন নামে ডাকো, কাগজের নৌকা, ১৩নং ফেকু ওস্তাগার লেন, সুয়োরাণী দুয়োরাণী, দুই ভাই, জুলেখা, আনোয়ারা, নিশি হলো ভোর, আগুন নিয়ে খেলা, হীরামন, আয়না ও অবশিষ্ট, কুঁচবরণ কন্যা, টাকা আনা পাই, তানসেন, যোগ বিয়োগ, সংসার, জীবন থেকে নেয়া, জাল থেকে জালা, বেদের মেয়ে, সমাপ্তি, রহিম বাদশা ও রূপবান, মনের মত বউ, আগন্তুক, শেষ পর্যন্ত, পীচ ঢালা পথ, বড় বউ, রংবাজ, প্রতিশোধ, অপবাদ, যাহা বলিব সত্য বলিব, জীবন নিয়ে জুয়া, রাজার হলো সাজা, অচেনা অতিথি, যৌতুক, দুটি মন দুটি আশা, বাদী থেকে বেগম, আল্লাহ মেহেরবান, দেনা-পাওনা, অপমান, বাসর ঘর, দুই নয়ন, অসাধারণ, শিরি-ফরহাদ, বাল্যশিক্ষা, জামানা, রাজলক্ষ্মী-শ্রীকান্ত, নতিজা ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বেবী জামান মঞ্চ, টিভি ও চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি তিনটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেছেন। সেগুলো হলো রাজার হলো সাজা, যাহা বলিব সত্য বলিব এবং অপবাদ। তাঁর প্রযোজনা সংস্থার নাম ‘আলো-ছায়া চলচ্চিত্র’। আলো ও ছায়া তাঁর ছোট দুই বোন।
১৯৬২ সালে বেবী জামান মামাতো বোন রওশন আরা মীনার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের দুই পুত্র চৌধুরী সাইদুজ্জামান রোজেন ও চৌধুরী মাহমুদুজ্জামান রোমেন এবং একমাত্র কন্যা শারমিন জামান তিথি। বহুমাত্রিক অভিনয় প্রতিভার অধিকারী বেবী জামান কখনো নায়ক, কখনো সহনায়ক, কখনো বাবা, কখনো ভাই, কখনো বন্ধু চরিত্রে অভিনেতা হিসেবে নিজেকে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি যখন যে চরিত্রে অভিনয় করেছেন সকল চরিত্রেই অভিনয় নৈপূণ্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। একজন মেধাবী শক্তিমান অভিনেতা হিসেবে তিনি ছিলেন দর্শকনন্দিত। ১৯৬৭ সালে বেবী জামান তাঁর পরিবারসহ পুরান ঢাকা গেন্ডারিয়া থেকে প্রথমে নতুন ঢাকার মনিপুরি পাড়ায় এবং কিছুদিন পরে লালমাটিয়াতে বসবাস করতে থাকেন। নতুন ঢাকায় আসার পর তিনি তাঁর পূর্বের ব্যবসা বন্ধ করে অভিনয়ের পাশাপাশি জাামান ব্রাদার্স নামে কনস্ট্রাকশন ব্যবসা শুরু করেন এবং সফলতা লাভ করেন। ১৯৭৫ সাল থেকে আমৃত্যু লালমাটিয়ায় নিজ বাসায় বসবাস করেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি ঢাকায় অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন সংবাদ ও খাদ্য সরবরাহ করতেন। মাঝে মধ্যে রাত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের তাঁর বাড়িতে আশ্রয়ও দিতেন। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে লালমাটিয়ার বাসায় পাকিস্তানি সেনা ও তাঁদের দোসরদের আক্রমণ থেকে পরিবারকে রক্ষা করতে গিয়ে শারীরিকভাবে আহত হন। হানাদাররা তাঁর বাড়ির সকল মালামাল লুট করে নিয়ে যায়।
২৫শে ফেব্রুয়ারি ২০১৩ সালের বাংলাদেশ মেডিকেল হাসপাতালে বেবী জামান মৃত্যুবরণ করেন। বেবী জামানকে তাজমহল রোড (মোহম্মদপুর) কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। [রহমত আলী]