বশীর, মুর্তজা
বশীর, মুর্তজা (১৯৩২-২০২০) বাংলাদেশী চিত্রশিল্পী, মুদ্রাতত্ত্ববিশারদ ও সংগ্রাহক এবং ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। ১৯৩২ সালের ১৭ই আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রমনা এলাকায় এক মুসলিম পরিবারে মুর্তজা বশীরের জন্ম। তাঁর পিতা উপমহাদেশের প্রখ্যাত ভাষাবিদ, জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং মা মরগুবা খাতুন। তিনি ছিলেন পিতামাতার কনিষ্ঠ সন্তান। পিতা তাঁর নাম রেখেছিলেন আবুল খায়র মুর্তজা বশীরুল্লাহ।
১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউশনে মর্তুজা বশীর শিক্ষাগ্রহণ করেন। ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত বগুড়ার করোনেশন ইনস্টিটিউশনে শিক্ষাগ্রহণের পর মেট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৪৯ সালে ঢাকা গর্ভনমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টস (বর্তমানে চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)-এর দ্বিতীয় ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসেবে মুর্তজা বশীর চারুকলা শিক্ষা শুরু করেন। মুর্তজা বশীর, রশিদ চৌধুরী, কাইয়ুম চৌধুরী ও আবদুর রাজ্জাকের মতো শিল্পীরা সেখানে ভর্তি হয়েছিলেন তখনকার পারিবারিক, সামাজিক বিরূপ অবস্থার মধ্যেই। ১৯৫৪ সালে পাঁচ বছর মেয়াদী শিল্পকলা শিক্ষা শেষ করে তিনি প্রথম বিভাগে পাস করেন। এরপর তিনি কলকাতা আশুতোষ মিউজিয়াম থেকে টিচার্স ট্রেনিং সার্টিফিকেট (আর্ট অ্যাপ্রিসিয়েশন) লাভ করেন। ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত ইতালির ফ্লোরেন্স একাদেমি দেল্লে বেল্লে আরতিতে পিতার অর্থায়নে এক বছর চিত্রকলা ও ফ্রেস্কো বিষয়ে শিক্ষাগ্রহণ করেন। তাঁর কাজে ফিগারের সরলীকরণ ও ন্যূনতম রঙ ব্যবহারের শৈলী তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল। ফ্লোরেন্সে তিনি পথে প্রান্তরে দেখা সাধারণ মানুষের ছবি এঁকেছেন। অ্যাকার্ডিয়ান বাদক, জিপসির খেলা দেখানো, মা ও মেয়ের বাজার করে ফেরার দৃশ্য এঁকেছেন তিনি। ইতালিতে দু’বছর কাটিয়ে ১৯৫৮ সালের শেষদিকে তিনি লন্ডন হয়ে দেশে ফেরেন। ফ্লোরেন্স ছেড়ে আসার আগে একই বছর মুর্তজা বশীরের প্রথম একক প্রদশর্নী ২৯শে মার্চ থেকে ১১ই এপ্রিল ‘লা পার্মানেন্ট’ গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হয়। ফ্লোরেন্সে অবস্থানকালীন সময়ে আঁকা চৌদ্দটি তৈলচিত্র এতে স্থান পায়। ১৯৫৮ সালে বশীর ইতালির চিত্রকর রাপিসার্ঙ্গি ও ভাস্কর ম্যাডোনিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে ‘মুভিমেন্টো প্রিমোরডিও’ (আদিমতার আন্দোলন) নামে একটি শিল্পীগোষ্ঠী গড়ে তোলেন এবং ১৯৫৮ সালের ১৩ থেকে ২৫ এপ্রিল ফ্লোরেন্সের অদূরে এম্পোলি শহরে গ্রুপ প্রদর্শনী করেন। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত প্যারিসে ইকোলে ন্যাশিওনাল সুপিরিয়র দ্য বোজার্ট এবং আকাদেমি গোয়েৎস-এ মোজাইক ও ছাপচিত্রে অধ্যয়ন করেন।
১৯৫৫ সালে ঢাকার নবাবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ড্রইং-এর শিক্ষক হিসেবে তিনি তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৭৩ সালে মর্তুজা বশীর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক পদে যোগ দেন এবং ১৯৯৮ সালে অধ্যাপক হিসেবে সেখান থেকে অবসরগ্রহণ করেন।
মর্তুজা বশীর ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি মহান ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন এবং রক্তাক্ত আবুল বরকতকে অন্যদের সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যান। ২২শে ফেব্রুয়ারি কলা ভবনের ছাদে কালো পতাকা উত্তোলনকারীদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। ২১শে ফেব্রুয়ারির ঘটনার ওপর ‘রক্তাক্ত ২১শে’ শিরোনামে ১৯৫২ সালে তিনি লিনোকাটে চিত্রটি আঁকেন, যা হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রয়ারী’ শীর্ষক সংকলনে ১৯৫৩ সালে প্রথম মুদ্রিত হয়। ‘রক্তাক্ত ২১শে’-এটিকে ভাষা আন্দোলনের ওপর আঁকা প্রথম ছবি হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। ১৯৫২ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত সুভাস মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘পরিচয়’ পত্রিকায় ভাষা আন্দোলনের ওপর ‘পারবে না’ শিরোনামে তাঁর কবিতা ছাপা হয় এবং কলকাতা থেকে প্রকাশিত একুশের স্মরণিকায় ‘ওরা প্রাণ দিল’ কবিতাটি পুনর্মুদ্রিত হয়।
১৯৭১ সালের ১৬ই মার্চ শহীদ মিনার থেকে বাহাদুর শাহ পার্ক পর্যন্ত বাংলাদেশ চারু ও কারুশিল্পী পরিষদের উদ্যোগে ‘স্বা-ধী-ন-তা’ মিছিলে নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। এর আগে ১৯৭১ সালের ১১ই মার্চ তৎকালীন পাকিস্তানের ‘মিনিস্ট্রি অব ইনফরমেশন অ্যান্ড সায়েন্টিফিক অ্যাফেয়ার্স’ কর্তৃক আয়োজিত রিজিওনাল কো-অপারেশন কাউন্সিল (আরসিসি) ভুক্ত দেশের শিল্পীদের প্রদর্শনী তিনিসহ অন্যান্যরা বর্জন করেন। এ সময় তিনি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর পাকিস্তান সেনাদের হামলা এবং বিভিন্ন স্থানে অনেককে হত্যার প্রতিবাদে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক খেতাবপ্রাপ্তদের প্রতি খেতাব বর্জনের আহ্বান জানান। ১৯৫০ সালে কমিউনিস্ট পার্টি আহুত ময়মনসিংহের হাজং, ভারতের তেলেঙ্গানা ও পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগণার কাকাদ্বীপকে মুক্ত এলাকা দিবস প্রচারাভিযানকালে তিনি গ্রেফতার হন এবং ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বিচারাধীন আসামিরূপে পাঁচ মাস কারারুদ্ধ ছিলেন। ১৯৮২ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সমিতির সভাপতি হিসেবে স্বৈরাচারী এরশাদ সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে ডাকা ধর্মঘটে তিনি নেতৃত্ব দেন।
তাঁর উপন্যাস ‘আলট্রামেরীন’ এ দেশের ভাষা আন্দোলন থেকে নানা সংগ্রাম, রাজনীতি, বাংলার সংকট, সাহিত্য, সংস্কৃতি ভিন্নভাবে উঠে এসেছে। যেখানে পাকিস্তানিরা দাবি করছে বাঙালিদের সব ঐতিহ্য ভারতীয়দের থেকে ধারণ করা, সেখানে তিনি দেখিয়েছেন এর সবই এ ব-দ্বীপ থেকে আহরিত। ছোটগল্প লেখায় তিনি ছিলেন অনবদ্য। ‘কয়েকটি রজনীগন্ধা’ তাঁর লেখা ছোটগল্পের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
তিনি ১৯৯২ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত জাপানের ফুকুওকা এশিয়ান কালচারাল প্রাইজ কমিটির নমিনেটর ছিলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরের বোর্ড অব ট্রাস্টি, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কলা ও মানবিক গবেষণা মূল্যায়ন কমিটি এবং কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নির্বাচন কমিটির সদস্য। তিনি বাংলা একাডেমি ও বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির আজীবন সদস্য ছিলেন। ১৯৭৫ সালে তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮০ সালে তিনি ‘একুশে পদক’ এবং ২০১৯ সালে ‘স্বাধীনতা পদকে’ ভূষিত হন।
‘ট্রান্সপারেন্সিজম’, ‘দেয়াল’, ‘শহীদ শিরোনাম’, ‘জ্যোতি’, ‘কালেমা তাইয়েবা’ ‘ক্যানটোস’ ও ‘পাখা’ শিল্পী মুর্তজা বশীরের আঁকা উল্লেখযোগ্য সিরিজ। তিনি ‘বিমূর্ত বাস্তবতা’ নামে একটি শিল্পধারার প্রবর্তক। এছাড়া, ফিগারেটিভ কাজে পূর্ব-পশ্চিমের শিল্প ঐতিহ্যের মেলবন্ধনে তিনি স্বকীয়তার স্বাক্ষর রেখেছেন। বিশেষ করে, গত শতকের নব্বই দশক থেকে তাঁর আঁকা নারী চিত্রমালায় সেই মেলবন্ধনের চিহ্ন পাওয়া যায়। এছাড়া, ১৯৬৮ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল ভবনে ‘টাকার ক্রমবিকাশ’ শীর্ষক ম্যুরালটি তৈরি তিনি করেন। ১৯৭৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ মিনার সংলগ্ন মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের ওপর ইঁট কেটে ‘অক্ষয় বট’ শীর্ষক ম্যুরাল রচনা করেন। ১৯৯৬ সালে সিলেটে বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনে টাইলসে রচনা করেন ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি’ শীর্ষক ম্যুরাল। পেইন্টিং ছাড়াও, তিনি ম্যুরাল, রেখাচিত্র, ছাপচিত্রসহ চিত্রকলার বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করেছেন।
তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছেÑ গল্পগ্রন্থ ‘কাচের পাখির গান’ (১৯৬৯), ‘গল্পসমগ্র’ (২০০৮); কাব্যগ্রন্থ ‘এসরেণু’ (১৯৭৬), ‘তোমাকেই শুধু’ (১৯৭৯), ‘এসো ফিরে অনসূয়া’ (১৯৮৫), ‘সাদায় এলিজি’ (২০১৭) ও বাংলা থেকে ইংরেজিতে স্বঅনুদিত ‘Fresh Blood, Faint Line’ (২০০৮); উপন্যাস ‘আল্ট্রামেরীন’ (১৯৭৯); ‘মিতার সঙ্গে চার সন্ধ্যে’/‘অমিত্রাক্ষর’ (২০০৮); নির্বাচিত রচনা ‘মুর্তজা বশীর: মূর্ত ও বিমূর্ত’ (২০০১), ‘আমার জীবন ও অন্যান্য’ (২০১৪) ও ‘চিত্রচর্চা’ (২০২০) এবং গবেষণাগ্রন্থ ‘মুদ্রা ও শিলালিপির আলোকে বাংলার হাবশী সুলতান ও তৎকালীন সমাজ’ (২০০৪) ইত্যাদি। এছাড়া, ভারতে বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জার্নাল অব দ্য নিউম্যাসমেটিক সোসাইটি অব ইন্ডিয়া’য় প্রাক্্-মুঘল যুগের মুদ্রার ওপর তাঁর বেশ কয়েকটি গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। তিনি ১৯৬৩ সালে উর্দু চলচ্চিত্রে ‘কারোয়াঁ’র কাহিনী ও চিত্রনাট্য রচনা করেন। ১৯৬৪ সালে হুমায়ূন কবীর রচিত ‘নদী ও নারী’র তিনি চিত্রনাট্যকার, শিল্প-নির্দেশক এবং প্রধান সহকারী পরিচালক ছিলেন। ১৯৬৪ সালে উর্দু চলচ্চিত্র ‘ক্যায়সে কাহু’র শিল্প-নিদের্শক হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন।
মুর্তজা বশীর ১৯৬২ সালে আমিনা বশীরকে বিয়ে করেন। তার দুই কন্যা এবং এক পুত্র সন্তান রয়েছে। মুর্তজা বশীর দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন জটিল রোগে ভুগছিলেন। চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ১৫ই আগস্ট ২০২০ তিনি মৃত্যুবরণ করেন। [সাব্বীর আহমেদ]