আহমদ, মোজাফ্ফর২
আহমদ, মোজাফ্ফর২ (১৯২২-২০১৯) রাজনীতিবিদ, ন্যাপ (মোজাফ্ফর)-এর সভাপতি, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য সাবেক জাতীয় সংসদ সদস্য। তিনি ১৯২২ সালের ১৪ এপ্রিল কুমিল্লা জেলার দেবীদ্বার উপজেলার এলাহাবাদ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম কেয়াম উদ্দিন ভূঁইয়া। মাতার নাম আফজর নেসা। মোজাফ্ফর আহমদ দেবীদ্বারের হোসেনতলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। এরপর কিছুদিন জাফরগঞ্জ রাজা ইনস্টিটিউশনে পড়ালেখা শেষে দেবীদ্বার রিয়াজ উদ্দিন পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখান থেকে তিনি ১৯৩৯ সালে মেট্রিক পাস করেন। হাইস্কুলে অধ্যয়নকালে তিনি ছাত্ররাজনীতির সাথে যুক্ত হন। তিনি ১৯৪১ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ইন্টামিডিয়েট পাস করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতক (সন্মান) ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। অতঃপর তিনি চট্টগ্রাম এবং ঢাকা কলেজে কয়েক বছর অধ্যাপনা করেন। তিনি ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা পেশায় যোগ দেন। ভাষা আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৫৪ সালে অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে তিনি সম্পূর্ণভাবে নিজেকে রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত করেন। অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ যুক্তফ্রন্টের মনোনয়নে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে কুমিল্লার দেবীদ্বার আসন থেকে অংশ নেন এবং মুসলিম লীগের প্রভাবশালী প্রার্থী মফিজ উদ্দিন আহমদকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৫৭ সালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক দল পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠিত হলে অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ ন্যাপের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন। আইয়ুব শাসনবিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় ১৯৫৮ সালে তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয় এবং তাঁকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। এসময় তিনি আত্মগোপনে থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যান। ১৯৬৬ সালে পাকিস্তানের সামরিক সরকার হুলিয়া তুলে নিলে অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ আবার প্রকাশ্য রাজনীতিতে ফিরে আসেন। এসময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাঙালির মুক্তির সনদ ৬-দফা ঘোষিত হলে তিনি তাতে সমর্থন দেন।
ষাটের দশকে বিশ্বসমাজতান্ত্রিক শিবিরে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের মধ্যকার নীতিগত বিরোধ চূড়ান্ত রূপ নিলে ১৯৬৭ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) পিকিং ও মস্কো এই দুই ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। পিকিংপন্থী ন্যাপের সভাপতি হন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং মস্কোপন্থী ন্যাপের সভাপতি হন সীমান্ত প্রদেশের খান আবদুল ওয়ালী খান। মস্কোপন্থী পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি হন অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ। এসময় তিনি অবিভক্ত পাকিস্তান ন্যাপের যুগ্ম-সম্পাদক ছিলেন। আইয়ুব সরকার বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ায় তিনি ১৯৬৯ সালের ২৯শে জানুয়ারি গ্রেফতার হন এবং কয়েকদিন পরেই মুক্তি লাভ করেন।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়। ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ ইয়াহিয়া খান ষড়যন্ত্র করে ৩রা মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন। ঐ রাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে বঙ্গবন্ধু এবং অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে চলমান পরিস্থতির বিভিন্ন দিক ও ভবিষ্যত নিয়ে আলোচনা করেন। গণআন্দোলনে নৈতিক সহযোগিতা বিষয়ে বঙ্গবন্ধু পশ্চিম পাকিস্তান ন্যাপ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার জন্য অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের প্রতি আহবান জানান। ২৫শে মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর নিবিড় যোগাযোগ ছিল। ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার শপথ নেওয়ার পর তিনি সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানান।
অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর আহবানে ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের অনেক নেতা-কর্মী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। তাঁর জন্মস্থান এলাহাবাদ গ্রামের বাড়িটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে ৮ সদস্যবিশিষ্ট যে উপদেষ্টা পরিষদ (Consultative Committee) গঠন করে, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ তার অন্যতম সদস্য ছিলেন। তাঁর দলের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা ও ধ্বংসলীলার কথা তুলে ধরে এর বিরুদ্ধে আশু হস্তক্ষেপ কামনা করে তিনি বিশে^র সমাজতান্ত্রিক দেশের সমমনা রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের নিকট পত্র প্রেরণ করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় ও জনমত গঠনে বিশে^র বিভিন্ন দেশ সফর করেন। জাতিসংঘে তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন। অধ্যাপক মোজফ্ফর আহমদের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ১৯শে জুলাই থেকে ‘নতুন বাংলা’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করা হতো। পত্রিকাটিতে রণাঙ্গনের সংবাদের পাশাপাশি ন্যাপের রাজনৈতিক দৃষ্টিকোন থেকে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যায়ন থাকত। এভাবে জাতীয় মুক্তি বা স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
১৯৭৯ সালে অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮১ সালে তিনি ‘কুঁড়েঘর’ প্রতীকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ নিয়ে পরাজিত হন। পরবর্তীতে স্বৈরশাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তিনি কারাবরণ করেন। দেশ গড়া ও প্রগতিশীল রাজনীতিতে দলীয় কর্মীদের দীক্ষিত করার লক্ষে শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ সাইদুর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি ১৯৮৩ সালে ঢাকার মদনপুরে ‘সামাজিক বিজ্ঞান পরিষদ’ নামে একটি গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। অধ্যাপক মোজফ্ফর আহমদ একজন সুলেখক ছিলেন। তাঁর লেখা প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে ‘সমাজতন্ত্র সম্পর্কে জানার কথা’ প্রথম খণ্ড (১৯৭৮) ও দ্বিতীয় খণ্ড (১৯৮০), ‘কিছু কথা’ (১৯৯১), ‘মুক্তির পথ’ (২০০৭), ‘সময়ের কণ্ঠস্বর’ (২০১৭) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ‘স্বাধীনতা পদক’ প্রদানের ঘোষণা দেয়। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেন নি। প্রবীণ রাজনীতিবিদ অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ ২০১৯ সালের ২৩ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। এলাহাবাদ গ্রামের নিজ বাড়িতে তাঁকে সমাহিত করা হয়। তাঁর স্ত্রী আমিনা আহমদ একজন নারীনেত্রী, জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এবং বর্তমানে ন্যাপের সভাপতি। এ দম্পতির একমাত্র কন্যা আইভি আহমদ। [শফিউদ্দিন তালুকদার]।
তথ্যসূত্র হারুন-অর-রশিদ (সম্পা.), বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ, ১ম, ৭ম ও ৮ম খণ্ড, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা, ২০২০; এইচ টি ইমাম, বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০১২; সাক্ষাৎকার পরিতোষ দেবনাথ, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক, ন্যাপ।