অক্সফাম
অক্সফাম অক্সফোর্ডভিত্তিক যুক্তরাজ্যের বৃহত্তম স্বেচ্ছাসেবী সাহায্য সংস্থা বা চ্যারিটি অর্গানাইজেশন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪২ সালের ২৯ মে এর প্রতিষ্ঠা। তখন নাম ছিল Famine Relief Committee। একই বছর ৫ই অক্টোবর অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি চার্চে খ্রিস্টান মিশনারি, চার্চের কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সভায় রেভারেন্ড টি আর মিলফোর্ড-কে চেয়ারম্যান করে Oxford Committee for Famine Relief নামে পুনর্গঠিত করা হয়। প্রতিষ্ঠার পেছনে তখন এর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বেসামরিক জনগোষ্ঠীর খাদ্যাভাব, দুর্ভিক্ষ অবস্থাসহ বিপন্ন জীবন সম্বন্ধে গণসচেতনতা বৃদ্ধি, যাতে মানুষ নানাভাবে তাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসে। শুধু গ্রীসের এথেন্সে খাদ্যের অভাবে সে সময়ে গড়ে দৈনিক ২ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিল।
অক্সফাম ট্রাস্ট্রের আইন বা নিয়ম অনুযায়ী পরিচালিত। এর সদস্যদের মধ্যে থেকে নির্দিষ্ট সংখ্যক নিয়ে গঠিত হয় কাউন্সিল যেটি এই সংস্থার নীতিনির্ধারণী বডি। এছাড়া রয়েছে একটি কার্যনির্বাহী কমিটি। এর নেতৃত্বে থাকেন সংস্থার চেয়ারম্যান ও পরিচালক।
এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে অক্সফামের ফিল্ড অফিস রয়েছে। একজন পরিচালক ও কিছুসংখ্যক সদস্য দ্বারা ফিল্ড অফিস পরিচালিত। প্রথম দিকে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে শরণার্থী এবং দুর্ভিক্ষ কবলিত মানুষের মাঝে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানের মধ্যে প্রধানত এর কর্মতৎপরতা সীমাবদ্ধ ছিল। এভাবে প্রতিষ্ঠার পর থেকে নাইজেরিয়ার বায়াফ্রা, প্যালেস্টাইন, কেনিয়া, হংকং, দক্ষিণ আফ্রিকা, আলজেরিয়া, কঙ্গো, ভারতের বিহার ও অন্যান্য অঞ্চল, ব্রাজিল, গুয়েতেমালা, লেবানন, ইথোপিয়া, কম্বোডিয়া, সুদান, মোজাম্বিক, এ্যাঙ্গোলা, ইরাক, বাংলাদেশ প্রভৃতি দেশে যুদ্ধ-সংঘর্ষের কারণে সৃষ্টি হওয়া উদ্বাস্তু, দুর্ভিক্ষপীড়িত বা ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের মাঝে অক্সফাম ত্রাণকার্য পরিচালনা করে আসছে।
অক্সফামের তহবিলের সিংহভাগ আসে মানুষের স্বপ্রণোদিত অর্থদান থেকে। ব্রিটেনসহ বিভিন্ন দেশে এর চ্যারিটি শপ রয়েছে। এগুলিও এর অর্থের একটি উৎস। বেশ কয়েক বছর হয় ব্রিটিশ সরকারও অর্থায়ন করে আসছে। প্রতিষ্ঠার পর প্রথম দিকে বেশ কয়েক বছর ত্রাণকার্য পরিচালনা মুখ্য বিষয় হিসেবে গণ্য হলেও সময়ের পরিসরে এর কর্মপরিধি অনেক বিস্তৃত হয়েছে। বর্তমানে অক্সফাম শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, কুটির শিল্প, ট্রেনিং সংশ্লিষ্ট কর্মকা- এবং বিভিন্ন দেশের বেসরকারি সাহায্য সংস্থা (এনজিও)-র উন্নয়ন প্রকল্পে সহযোগীর ভূমিকা পালন, কারিগরি সহায়তা প্রদান ইত্যাদি করে আসছে।
১৯৭১ সালে বাংদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ-এর সময় পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর হাতে জীবন-বিপন্ন, ভীত-সন্ত্রস্ত ১ কোটি বাঙালি শরণার্থী সীমান্তবর্তী ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করে। অক্সফাম তাদের মাঝে ব্যাপক ত্রাণকার্য পরিচালনা করে। অন্যান্য বৈদেশিক সাহায্য সংস্থার ত্রাণতৎপরতা যেখানে কলকাতার শরণার্থী শিবিরে সীমাবদ্ধ ছিল, অক্সফাম তখন কলকাতার বাইরে বিভিন্ন ত্রাণ শিবির, বনগাঁও, বালুরঘাট, পশ্চিম দিনাজপুর, বারাসত, জলপাইগুড়ি, ত্রিপুরা, মেঘালয়, আসাম, কুচবিহার প্রভৃতি স্থানে বাঙালি শরণার্থীদের মাঝে ব্যাপক ত্রাণকার্য পরিচালনা করে। ত্রাণসামগ্রীর মধ্যে ছিল খাদ্য, ঔষধ, বিশুদ্ধ পানি, কম্বল, ওরস্যালাইন, ‘সুপার ল্যাট্রিন’ ইত্যাদি।
ত্রাণতৎপরতা পরিচালনার পাশাপাশি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতা, শরণার্থীদের দুর্বিষহ জীবন-যাপন, বন্যা, শরণার্থী শিবিরে কলেরার ব্যাপক প্রাদুর্ভাব ইত্যাদি বিষয় তুলে ধরে অক্সফামের কেন্দ্রীয় পরিচালক এইচ এল কার্কলে-র সম্পাদনায় ব্রিটিশ হাউস অব কমন্স ও আমেরিকার সিনেট সদস্য, বিশিষ্ট সাংবাদিক, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রধান কর্মকর্তা এরূপ ৬০ জন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনাভিত্তিক ‘দ্য টেস্টিমনি অব সিক্সটি’ শিরোনামে ২১শে অক্টোবর ১৯৭১ একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করে এবং তা রাষ্ট্র/সরকার প্রধানসহ বিভিন্ন দেশের নীতি-নির্ধারকদের মাঝে বিতরণের ব্যবস্থা করে, যা বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বজনমত গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখে (দ্রষ্টব্য, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ, খণ্ড ৫, পৃ. ১৫)।
মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয় অর্জনের পর শরণার্থীদের দেশে প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন কার্যেও অক্সফাম প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে। বর্তমানেও অক্সফাম মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের মাঝে ত্রাণকার্য পরিচালনা করছে। উল্লেখ্য, ১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বর বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রলয়ংকরী সাইক্লোনের সময়ও অক্সফাম ত্রাণসামগ্রী নিয়ে এগিয়ে আসে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতে বাঙালি শরণার্থীদের মাঝে ত্রাণতৎপরতা পরিচালনার প্রধান সমন্বয়ক ছিলেন ব্রিটিশ নাগরিক জুলিয়ান ফ্রান্সিস (বয়স তখন মাত্র ২৬ বছর; দ্রষ্টব্য বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ, খণ্ড ৪, পৃ. ১০০)। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১২ সালে তাঁকে 'Friends of Bangladesh War of Liberation' সম্মাননা এবং ২০১৮ সালে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়া হয়। এছাড়া সংগঠন হিসেবেও অক্সফাম-কে ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু’ সম্মাননায় ভূষিত করা হয়। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র Maggie Black, Oxfam: The First 50 Years, (Oxfam and Oxford University Press 1992), Passim; হারুন-অর-রশিদ (সম্পাদিত), বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ, খণ্ড ৪, ৫, ও ৭, (বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি ২০২০)।