আহমেদ, বশির
আহমেদ, বশির (১৯৩৮-২০১৪) বাংলাদেশের একজন প্রথিতযশা সংগীতশিল্পী। তিনি একাধারে সংগীতশিল্পী, সুরকার, গীতিকার ও সংগীত পরিচালক ছিলেন। তিনি বাংলা চলচ্চিত্র সংগীতের অন্যতম পথপ্রদর্শক।
বশির আহমেদ ১৯৩৮ সালের ১৮ নভেম্বর কলকাতার (পশ্চিমবঙ্গ, ভারত) খিদিরপুরে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম নাসির আহমেদ এবং মায়ের নাম মোমেনা খাতুন। চার ভাইয়ের মধ্যে কনিষ্ঠতম বশির আহমেদ ছেলেবেলা থেকেই গানপাগল ছিলেন। সেই সময়ে রমজান মাসে খিদিরপুরে সেহরীর সময় রোজাদার মুসলমানদের ঘুম ভাঙানোর জন্য পাড়ার তরুণরা সমবেত কন্ঠে বিশেষ ধরনের ইসলামী গান গাইত। এই ধরনের গানকে বলা হতো 'কাফেলা' গান। বছরে একবার এই কাফেলা গানের প্রতিযোগিতা হতো খিদিরপুরে। এই কাফেলা গানের প্রতিযোগিতায় প্রত্যেক বছর প্রথম স্থান অধিকারী বশির আহমেদ কিশোর বয়সেই খিদিরপুরে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন।
বশির আহমেদের শিক্ষাজীবন শুরু হয় কলকাতার সেইন্ট বারনাবাস হাইস্কুলে। এই স্কুল থেকেই তিনি মেট্রিক পাশ করেন। পরে তিনি আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে উর্দু সাহিত্যে পড়াশুনা করেন।
বশির আহমেদের সংগীতে হাতে খড়ি ওস্তাদ বিলায়েত হোসেন বাঁকা’র কাছে। সুরপাগল বশির আহমেদ মাত্র ১৫ বছর বয়সে গৃহত্যাগ করেন সুরের সন্ধানে। তিনি বোম্বে চলে যান এবং সেখানে গীতিকার রাজা মেহেদির বাসায় ওঠেন। বোম্বে চলচ্চিত্র জগতের সুরকার নওশাদের সহকারী ছিলেন মোহাম্মদ শফি। মোহাম্মদ শফির সাথে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে বশির আহমেদের। তাঁর সহযোগিতায় বোম্বে সংগীত ইন্ডাস্ট্রিতে গান গাওয়ার সুযোগ পান তিনি। ১৯৫৪-৫৫ সালে গীতা দত্ত এবং আশা ভোঁসলের সাথে দ্বৈত কন্ঠে গান করেন বশির আহমেদ। বোম্বেতে তিনি ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খানের সান্নিধ্যে আসেন এবং তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে উচ্চাঙ্গ সংগীতের তালিম নেন।
বোম্বে থাকার সময়ই শিল্পী তালাত মাহমুদের সাথে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে বশির আহমেদের। ১৯৬০ সালে চলচ্চিত্র প্রযোজক এবং গুলিস্তান সিনেমা হলের মালিক দোসানী’র আমন্ত্রণে তালাত মাহমুদের সাথে ঢাকা আসেন বশির আহমেদ। ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং ময়মনসিংহ শহরে একই মঞ্চে উভয়ে সংগীত পরিবেশন করেন। এরপর মাঝে মাঝেই তিনি ঢাকা আসতেন। ১৯৬৩ সালে ঢাকায় নির্মিত উর্দু চলচ্চিত্র ‘তালাশ’ এ গান করেন বশির আহমেদ। চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবে ব্যস্ততা বাড়তে থাকলে ১৯৬৪ সালে তিনি স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে আসেন। ষাটের দশকে ঢাকায় নির্মিত উর্দু-বাংলা দ্বিভাষিক চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক গায়ক হিসেবে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল বশির আহমেদের। ১৯৬৯ সালে ‘ময়নামতি’ ছায়াছবিতে সৈয়দ শামসুল হকের লেখা ‘ডেকোনা আমারে তুমি কাছে ডেকোনা’ এবং গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা ‘অনেক সাধের ময়না আমার বাঁধন কেটে যায়’ গান দুটির সুরকার ও গায়ক ছিলেন বশির আহমেদ। এই গান দুটির আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা তাঁকে বাংলা চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালক ও গায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা এনে দেয়। ষাটের দশকে এ দেশের সংগীত বিনোদনের প্রধান মাধ্যম ছিল রেডিও। এ সময়ে রেডিওতে তিনি ‘যা রে যাবি যদি যা’ এবং ‘আমাকে পোড়াতে যদি এত লাগে ভালো’ গান দুটি করেন। এই গানের মাধ্যমে বাংলাদেশের সংগীতপ্রিয় সাধারণ মানুষের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করেন বশির আহমেদ। শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম নেয়া বশির আহমেদের গায়নে নিজস্ব একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। রাগপ্রধান, অলংকারধর্মী বাংলা গান তিনি অত্যন্ত সহজে, মাধুর্যমণ্ডিত করে গাইতে পারতেন। বাংলা চলচ্চিত্র এবং আধুনিক ধারার বাংলা সংগীতের অনেক জনপ্রিয় গানের সুরকার ও গায়ক বশির আহমেদ।
বশির আহমেদের স্ত্রী মীনা বশিরও একজন জনপ্রিয় শিল্পী। একক কন্ঠে এবং বশির আহমেদের সাথে দ্বৈত কন্ঠে অনেক জনপ্রিয় গান করেছেন তিনি। তাঁদের কন্যা সন্তান হোমায়রা বশির এবং পুত্র রাজা বশির দুজনেই শিল্পী। বশির আহমেদ ছিলেন একজন আপাদমস্তক সংগীতময় মানুষ। গান গাওয়া, সুর রচনা, সংগীত পরিচালনা ছাড়াও তিনি গান শিখিয়েছেন অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রীদের। তাঁর শিষ্যরা অনেকেই আজ প্রথিতযশা সংগীতশিল্পী।
সংগীতক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বশির আহমেদ ২০০৫ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন। এর পূর্বে ২০০৩ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন শ্রেষ্ঠ গায়ক হিসেবে। '
প্রথিতযশা এই শিল্পী ২০১৪ সালের ১৯ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন। [আজিজুর রহমান]
তথ্যসূত্র কথপোকথন, 'সংগীতের বশির আহমেদ একজন বিদগ্ধ পথিকৃৎ' News24.Com ১৯ নভেম্বর ২০১৯; হোমায়রা বশির-এর সঙ্গে সাক্ষাৎকার।