আহমেদ, মহিউদ্দীন২
আহমেদ, মহিউদ্দিন২ (১৯৪৪-২০২১) সাংবাদিক, লেখক, সম্পাদক, প্রকাশক এবং বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল)-এর প্রতিষ্ঠাতা। গ্রন্থ বাছাই ও উপস্থাপনে তিনি যে দৃষ্টিভঙ্গি ও মননশীলতার পরিচয় দিয়েছেন তা কেবল প্রকাশনা শিল্পে জাতীয় পর্যায়েই অনন্য নয়, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডেও পরিমাপযোগ্য।
মহিউদ্দিন আহমেদ-এর জন্ম ১৯৪৪ সালের ২রা ডিসেম্বর ফেনী জেলার পরশুরামে। তাঁর বাবা ছিলেন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান পোস্টাল সার্ভিসের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তাঁর কৈশোর কাটে পিতার কর্মস্থল সারগোদায়। সেখানকার পিএএফ পাবলিক স্কুলে (১৯৫৬-৬০) মাধ্যমিক শিক্ষা লাভ করেন। মহিউদ্দিন আহমেদ উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন ঢাকার নটরডেম কলেজে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে ডিপ্লোমা ডিগ্রি লাভের পর পাকিস্তান কাউন্সিল স্কলারশিপ নিয়ে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। সেখান থেকে তিনি সাংবাদিকতা বিষয়ে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতিতে তিনি সক্রিয় ছিলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক এবং পরে সভাপতি নির্বাচিত হন। মহিউদ্দিন আহমেদই ছিলেন বাঙালিদের মধ্যে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-সংসদের নির্বাচিত প্রথম এবং একমাত্র সাধারণ সম্পাদক।
পড়াশুনা শেষে মহিউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকতার মাধ্যমে তাঁর পেশাগত জীবন শুরু করেন। উল্লেখ্য যে, লেখালেখির সাথে তাঁর সম্পৃতক্তা গড়ে ওঠেছিল নটরডেম কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থাতেই। তিনি ‘ব্লু অ্যান্ড গোল্ড’ নামক কলেজ ম্যাগাজিনের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ সম্পন্ন করার পর তিনি পাকিস্তান টাইমস-এর একজন শিক্ষানবিশ রিপোর্টার হিসেবে যোগ দেন। পাকিস্তান টাইমস-এর তৎকালীন সম্পাদক এ.ডি চৌধুরী পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। পত্রিকার রিপোর্টার হিসেবে মহিউদ্দিন আহমেদের কর্মনিষ্ঠা ও সাফল্য লক্ষ্য করে তিনি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হন এবং তাঁকে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের প্রস্তাব দেন। মহিউদ্দিন আহমেদ সানন্দে এ প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং তিনি প্রায় ৪ বছর পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিষয়ে শিক্ষকতা করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে স্কলারশিপসহ পিএইচ.ডি করার সুযোগ লাভ করেন। তবে, একই সময়ে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস (OUP) পাকিস্তান-এ সম্পাদক পদের নিয়োগ লাভ করায় তিনি স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে পিএইচ.ডি প্রোগ্রামে ভর্তি হননি। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত মহিউদ্দিন আহমেদ অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস পাকিস্তান-এর সম্পাদক হিসেব দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তিনি প্রকাশনার নানাবিধ বিষয়ে ব্যাপক পেশাগত প্রশিক্ষণ লাভের সুযোগ পেয়েছিলেন।
১৯৭২ সালে মহিউদ্দিন আহমেদে বাংলাদেশে ফিরে এসে দুই বছর অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ঢাকা শাখার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৪ সালে এ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানটির ঢাকা কার্যালয় বন্ধ হয়ে গেলে মহিউদ্দিন আহমেদকে করাচি শাখায় ‘এডিটর-অ্যাট-লার্জ’ বা রোভিং এডিটর হিসেবে যোগ দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়। কিন্তু তিনি এ প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। বরং তাঁর অর্জিত জ্ঞান ও লব্ধ অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ১৯৭৪ সালে তিনি নিজের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘দ্যা ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড’ প্রতিষ্ঠা করেন।
ইউপিএল প্রধানত বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় একাডেমিক এবং পাণ্ডিত্যপূর্ণ গবেষণাধর্মী গ্রন্থ প্রকাশ করে। প্রায় অর্ধ শতকের পথপরিক্রমায় ইউপিএল দেশি-বিদেশি পণ্ডিতদের প্রণীত আট শতাধিক গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। কেবল সংখ্যা নয়, গ্রন্থের বিষয় ও বৈচিত্র্যতা এক্ষেত্রে লক্ষণীয়। বাংলাদেশ বিষয়ক অসংখ্য গবেষণা কাজকে গ্রন্থরূপ দেয়া হয়েছে ইউপিএল থেকে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, প্রশাসন, রাজনীতি, অর্থনীতি, ভাষা-সাহিত্য, সমাজ-সংস্কৃতি, সমকালীন বিশ্ব ইতিহাস, বিজ্ঞান, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং বিশ্বসাহিত্যসহ জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অসাধারণ সব গ্রন্থ ইউপিএল-এর প্রকাশনা তালিকায় রয়েছে। শুধু মৌলিক গ্রন্থ প্রকাশ নয়, ইংরেজি ভাষায় রচিত অনেক মূল্যবান গ্রন্থের বাংলা অনুবাদও প্রকাশ করেছে ইউপিএল। গ্রন্থের বিষয় নির্বাচন, সম্পাদনা, প্রকাশনার মানদ- বজায় রেখে মহিউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতকে অনন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠা করেছেন। ইউপিএল-এর মাধ্যমে মহিউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশে বিভিন্ন বিষয়ে যেসব মৌলিক কাজ হচ্ছে, তার সাথে বিশ্বকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন এবং একই সাথে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ বিষয়ে যেসব গবেষণা হচ্ছে, সেগুলোকে বাংলাদেশের পাঠকসমাজের কাছে উপস্থাপন করেছেন। এক্ষেত্রে বৈষয়িক সাফল্য বা স্বীকৃতির প্রত্যাশা নয়, বরং ভালোবাসা ও কর্তব্যবোধই ছিল তাঁর মূল চালিকাশক্তি।
ইউপিএল-এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসমাপ্ত আত্মজীবনী। ২০১২ সালে মহিউদ্দিন আহমেদ এই গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। বাংলা ভাষার পাশাপাশি বইটি ইংরেজি ও উর্দুসহ একাধিক ভাষায় প্রকাশ করার ব্যবস্থাও করেন তিনি। তাঁর উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় ভারতের পেঙ্গুইন প্রকাশনী গ্রন্থটির ইংরেজি ও অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস পাকিস্তান উর্দু অনুবাদ প্রকাশ করে।
মহিউদ্দিন আহমেদ কেবলমাত্র একজন প্রকাশক ছিলেন না, তিনি একজন লেখকও ছিলেন। ইউপিএল থেকে প্রকাশিত সমকালীন গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধের সংকলন সম্পাদনা করেছেন তিনি। ১৯৯০-এর দশকের শুরুর দিকে বাংলাদেশে ইতিহাস সঠিক ও পর্যাপ্তরূপে সংরক্ষণের অভাব অনুধাবন করে ‘রোড টু বাংলাদেশ’ নামে একটি ধারাবাহিক প্রকাশনা করেন। মহিউদ্দিন আহমেদ রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, বাংলাদেশে পুস্তক প্রকাশনা; ইউপিএল নির্বাচিত বাংলাদেশের কবিতা (২ খণ্ড, ১৯৯৯ ও ২০০১); ইউপিএল সাহিত্য সংগ্রহ (২ খণ্ড, ২০০২ ও ২০০৩); ইউপিএল নির্বাচিত বাংলাদেশের প্রবন্ধ (৩ খণ্ড ১৯৯৯, ২০০১, ২০০২); ইউপিএল নির্বাচিত বাংলাদেশের ছোটগল্প ২০০০; ইউপিএল নির্বাচিত বাংলাদেশের কবিতা ২০০০, ইত্যাদি। এসব গ্রন্থের মাধ্যমে মহিউদ্দিন আহমেদ লেখক হিসেবে সৃজনশীল ভাবনায় পাঠকদের সমৃদ্ধ করেছেন। মহিউদ্দিন আহমেদ ১৯৭৭-৭৮ সালে সাপ্তাহিক সানডে স্টার নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি নিজে এ পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন। অবশ্য পত্রিকাটি বেশি দিন প্রকাশিত হয়নি।
মহিউদ্দিন আহমেদ ছিলেন বাংলাদেশের একজন আদর্শ ও অনুসরণীয় প্রকাশক। আধুনিক ও মানসম্মত প্রকাশনা বলতে যা বোঝায়, তাঁর একটি রূপ তিনি দেখিয়ে গেছেন তাঁর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ইউপিএল-এর মাধ্যমে। তিনি প্রকাশনাকে কেবল সাহিত্য, সংস্কৃতি ও বিনোদনের নিমিত্ত হিসেবে নয়, বরং জ্ঞানভিত্তিক, বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ বিনির্মাণের উপায় হিসেবে রূপ দিয়েছেন। এখানেই অন্যদের তুলনায় তাঁর ব্যতিক্রমী অবস্থান।
সৃজনশীল প্রকাশক হিসেবে বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পকে একটি বৈশি^ক মানদণ্ডে উন্নীত করার স্বীকৃতি হিসেবে মহিউদ্দিন আহমেদ বিভিন্ন সম্মাননা ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি ২০১৪ সালে মহিউদ্দিন আহমেদকে ‘ইমেরিটাস প্রকাশক’ সম্মাননা দেয়। অ্যারিজোনার বেনসনে অবস্থিত ‘ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি’র আন্তর্জাতিক কার্যালয় থেকে ১৯৮৮ সালে মহিউদ্দিন আহমেদকে ‘পাবলিশিং ম্যানেজমেন্ট’ বিষয়ে ‘কালচারাল ডক্টরেট’ ডিগ্রি দেয়া হয়। মহিউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে পরিচালিত ইউপিএল ১৯৮১ সাল থেকে মোট ১৬ বার ‘জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র’ পুরস্কার লাভ করে। ১৯৯১ সালে প্রকাশনা শিল্পে অনন্য অবদানের জন্য মহিউদ্দিন আহমেদকে স্বর্ণপদকে ভূষিত করা হয়। পরিবেশ উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মোট ১৭ জন প্রকাশককে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য আমন্ত্রণ জানান, মহিউদ্দিন আহমেদ ছিলেন তাঁদের একজন। বাংলা একাডেমিও তাঁকে সম্মানিত ফেলো নির্বাচিত করে।
তিনি ২২শে জুন ২০২১ সালে ৭৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। [মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান]