আনোয়ার খান
আনোয়ার খান বানিয়াচঙের জমিদার। যে অঞ্চল জুড়ে তাঁর জমিদারি বিস্তৃত ছিল তা বর্তমানে হবিগঞ্জ জেলার অন্তর্ভুক্ত। বাহারিস্তান-ই-গায়েবী গ্রন্থে আনোয়ার খানকে চিহ্নিত করা হয়েছে জমিদারদের শিরোমণিরূপে এবং বলা হয়েছে যে, কোনোভাবেই তিনি মুসা খান মসনদ-ই-আলার চেয়ে কম ক্ষমতাবান ছিলেন না।
আনোয়ার খান মুসা খানের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে মুগল আগ্রাসন প্রতিহত করেন। ১৬১১ খ্রিস্টাব্দে মুসা খানের যাত্রাপুর ও ডাকছড়া দুর্গ থেকে মুগল আক্রমণ প্রতিহত করার ক্ষেত্রে আনোয়ার খানের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। মুগল সুবাহদার ইসলাম খানের হাতে এ দুটি দুর্গের পতন এবং মুসা খানের সোনারগাঁ অভিমুখে পশ্চাদপসরণ ও নতুন প্রতিরোধের প্রস্ত্ততিকালে আনোয়ার খান তাঁর রণ-নৌবহর নিয়ে বানিয়াচঙে ফিরে যান। সেখানে তিনি নতুনভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
মুসা খানের চূড়ান্ত পরাজয় এবং অপরাপর জমিদারসহ মুগলদের নিকট আত্মসমর্পণের পর পরই আনোয়ার খান তাঁর ভাইদের নিয়ে স্বেচ্ছায় জাহাঙ্গীরনগরে ইসলাম খানের নিকট আত্মসমর্পণ করেন (১৬১১)। আনোয়ার খান খাজা উসমানের বিরুদ্ধে সুবাদারকে তাঁর সক্রিয় সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন। বাংলায় আফগান আধিপত্য সংরক্ষণের প্রাণপুরুষ খাজা উসমানের পতন ঘটানো তখন ছিল ইসলাম খানের মূল লক্ষ্য। আনোয়ার খান সুবাহদারের নিকট প্রস্তাব দেন যে, তিনি তাঁর জায়গিরে ফিরে গিয়ে সিলেটে উসমানের সমর্থকদের বিরুদ্ধে বিশেষভাবে উসমানের ভাই ও পুত্রদের অধিকৃত তরফ অঞ্চলে আক্রমণ পরিচালনা করতে চান যাতে তারা উসমানের সাহায্যে এগিয়ে আসতে না পারে। ইসলাম খান তাঁর জমিদারি স্বত্ব বহাল রাখেন এবং উসমান পক্ষীয়দের বিরুদ্ধে প্রস্তাবিত আক্রমণ পরিচালনার অনুমতি দেন।
আনোয়ার খানের বিশ্বস্ততায় ইসলাম খান তেমন আস্থা রাখতে পারেন নি। তাই তিনি খাজা উসমানের বিরুদ্ধে প্রেরিত সম্মিলিত বাহিনীর অধিনায়কের দায়িত্ব আনোয়ার খানের পরিবর্তে ইসলাম কুলি খানের উপর ন্যস্ত করেন। এতে আনোয়ার খান খুবই ক্ষুব্ধ হন। এগারসিন্দুর পৌঁছেই তিনি হাসানপুরে মুগল সেনাঘাঁটিতে অবস্থানরত মুসা খানের ভ্রাতা মাহমুদ খান এবং ভাওয়ালের বাহাদুর গাজীর সঙ্গে এক গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। এরূপ সিদ্ধান্ত হয় যে, খাজা উসমানের সঙ্গে মিলে তারা হাসানপুর ঘাঁটির উপর সম্মিলিত আক্রমণ চালিয়ে মুগল সৈন্যদের হত্যা বা বন্দী করবেন, আর আনোয়ার খান যুগপৎ নেতৃস্থানীয় মনসবদারদের আটক করার চেষ্টা করবেন, মুসা খানকে মুক্ত করবেন, অতঃপর ঢাকায় বন্দী করবেন ইসলাম খানকে।
এ ষড়যন্ত্রের সাফল্য ছিল নেহাতই নগণ্য। সান্ধ্যভোজ অনুষ্ঠানে আনোয়ার খান বেশসংখ্যক শাহী সামরিক কর্মকর্তাদের আমন্ত্রণ জানালেও তাদের মধ্যে মাত্র দু’জন সেনাপতিকে তিনি আটক করতে পেরেছিলেন। এরা হলেন বজবাহাদুর কালমাকের রণতরীর দায়িত্বপ্রাপ্ত ইসলাম কুলি খান এবং শাহজাদপুরের জমিদার রাজা রায়। এদের নিয়ে তিনি বানিয়াচঙে পালিয়ে যান। ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনার মূল লক্ষ্যই অসমাপ্ত থেকে যায়। অচিরেই মাহমুদ খান ও বাহাদুর গাজীর গোপন কার্যক্রম প্রকাশ পায় এবং গোটা ষড়যন্ত্রই ফাঁস হয়ে যায়। তাদের শৃঙ্খলিত করে কড়া পাহাড়ায় আটক রাখা হয়।
ইসলাম খান প্রথমে ভূষণার সামন্ত জমিদার রাজা ছত্রজিৎ এবং পরে কিছুসংখ্যক জমিদারসহ মুবারিজ খানকে আনোয়ার খানের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। আনোয়ার খান তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইসলাম খানের নিকট আত্মসমর্পণে বাধ্য হন। আনোয়ার খানকে শৃঙ্খলিত ও কারারুদ্ধ করা হয়। পরে তাঁকে অন্ধ করে বন্দী অবস্থায় রোটাস দুর্গে প্রেরণ করা হয়। [মুয়ায্যম হুসায়ন খান]