ওরাওঁ তানা ভগৎ আন্দোলন
ওরাওঁ তানা ভগৎ আন্দোলন (১৯১৪-১৯১৯) ঔপনিবেশিক শাসনামলের শেষদিকে ছোট নাগপুর অঞ্চলে ও রাওঁদের একটি অংশ কর্তৃক সংঘটিত উপজাতীয় বিদ্রোহ। এর নেতৃত্বে ছিলেন রাঁচির গুমলা নিবাসী যাত্রা ওরাওঁ নামে ওরাওঁ সম্প্রদায়ভুক্ত পঁচিশ বছর বয়সী এক তরুণ। ১৯১৪ সালের এপ্রিল মাসে তিনি ঘোষণা করেন যে, ওরাওঁ রাজ পুনরুজ্জীবিত করার জন্য ওরাওঁদের সর্বোচ্চ দেবতা ধরমেশ-এর কাছ থেকে তিনি বাণী পেয়েছেন। যাত্রা প্রচার করতেন যে, ভূত-প্রেতে বিশ্বাস, পশু-বলি, মদ্যপান ইত্যাদির মতো অশুভ বিষয় থেকে ওরাওঁ ধর্মকে মুক্ত করা উচিত এবং এসবের জায়গায় নিরামিষাহার, কৃচ্ছসাধন ও সংযমের চর্চা করা উচিত। এ প্রচারণা যত বিস্তৃত হতে থাকে, ভূমিবিষয়ক প্রশ্নাদি ততই সামনে আসতে থাকে।
জমিদার ও ইল্লাকাদার (সেবা প্রদানের বিনিময়ে ছোটনাগপুরের মহারাজা যাদের জমিদান করেছিলেন), হিন্দু ব্যবসায়ী তথা মুসলমান, খ্রিস্টান ও ব্রিটিশ রাজের প্রতি ওরাওঁদের বশ্যতা প্রায় রীতিসিদ্ধ হয়ে উঠেছিল। এ বশ্যতাকে যাত্রা ওরাওঁ অস্বীকার করেন। ফলে সূচনায় যা ছিল নিতান্তই ধর্মীয় প্রচারণা বা আন্দোলন তা-ই এক পর্যায়ে খাজনা না-দেওয়ার আন্দোলনে পরিণত হয়। যাত্রা তাঁর অনুসারীদেরকে ভূ-স্বামীদের জমি চাষ না করার নির্দেশ দেন। তিনি ঘোষণা করেন, ওরাওঁরা ভিন্ন সম্প্রদায় বা ব্রিটিশ সরকারের কুলি কিংবা মজুরের কাজ আর করবে না। ধীরে ধীরে আন্দোলনে রাজনৈতিক উপাদানের অনুপ্রবেশ ঘটে এবং তা ব্রিটিশ ও মিশনারি বিরোধী রূপ নেয়। যাত্রার অনুসারীগণ (তানা) পাহান বা পুরোহিত এবং মাহতো অর্থাৎ গ্রামসর্দারের চিরাচরিত ভূমিকা সম্পর্কেও প্রশ্ন তোলে। তানাদের প্রতি লাল মরিচ ও লাল চালসহ লাল রং-এর সবকিছু পরিহার করার নির্দেশ ছিল। কারণ লাল রং ওরাওঁদের ঘৃণার পাত্র ব্রিটিশের পরিচয় বহন করত। তানারা বিশ্বাস করত, যথার্থ শিক্ষা একমাত্র ঈশ্বরের কাছ থেকেই আসতে পারে, অতএব তারা শিশুদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। একই সংগে মিশনারি স্কুলগুলিকেও জোর করে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
ঔপনিবেশিক শাসনের চাপে ছোটনাগপুরের অন্যান্য উপজাতির মতো ওরাওঁদের সামাজিক সংগঠন ভেঙে পড়ে। তাছাড়া জমি হারাবার ফলে তাদের মধ্যে ভূমির স্বত্বাধিকার সম্বন্ধীয় প্রচন্ড অসন্তোষও দেখা দেয়। এ দুটি বিষয় তানা ভগৎ আন্দোলনের পটভূমি হিসেবে কাজ করে। এ সময়কার জমি জরিপ সংক্রান্ত সরকারি রিপোর্টে দেখা যায়, পশ্চিম ছোটনাগপুরে বসবাসকারী ওরাওরা পূর্বনাগপুরে বসবাসকারী মুন্ডাদের চাইতে অনেক উঁচু হারে খাজনা দিত। এর ফলে তারা প্রতিবেশীদের অপেক্ষা অনেক বেশি পরিমাণে পৈতৃক জমি হারাতে থাকে। এ ছাড়া তাদেরকে দিকু (অথবা অ-উপজাতীয় শোষক) ভূ-স্বামীদের অতিরিক্ত চাহিদা মাফিক বিনা পারিশ্রমিকে মজুরের কাজ করতে হতো। এ ছাড়াও তাদেরকে অতি সামান্য পারিশ্রমিকে শিকারের সময় জঙ্গল-পেটানো আর পুলিশের তল্পিবাহকের কাজ করতে বাধ্য করা হতো। এ সব কারণে ওরাওঁদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ দানা বাধে।
জমি ঈশ্বরের দান এবং উপজাতীয় মানুষের জমির অধিকারে কারও হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই এ বিশ্বাস তানা ভগৎ আন্দোলনের চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে। ওরাওঁদের দৃষ্টিতে দিকু ভূ-স্বামীরাই ছিল তাদের অধিকারে হস্তক্ষেপকারী অপশক্তি। সঙ্গত কারণে যাত্রার খাজনা না-দেওয়ার আন্দোলন প্রথমত দিকু ভূ-স্বামীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছিল। ওরাওঁদের ওপর দিকুদের ক্রমবর্ধমান আধিপত্য এ বিশ্বাসের জন্ম দেয় যে, শত্রুর হাত থেকে তাদেরকে রক্ষা করার শক্তি ঔপনিবেশিক সরকারের নেই। এমতাবস্থায় বিকল্প রাজনৈতিক কর্তৃত্বের সন্ধানে তারা নিজেদের দিকেই দৃষ্টি দেয়। এভাবে অর্থনৈতিক দুঃখ দুর্দশার সূত্র ধরে একটি স্বাধীন উপজাতি রাষ্ট্রের স্বপ্ন জন্ম নেয়।
আন্দোলনকালে প্রায় ২৬ হাজার ওরাওঁ অনুসারীরা যাত্রা ওরাওঁর চারপাশে সংঘবদ্ধ হয়। রাঁচি, পালামৌ ও হাজারীবাগের ওরাওঁ সম্প্রদায়ের মধ্যে এ আন্দোলন দাবানলের মতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। মুন্ডা ও খারিয়া সম্প্রদায়ের অনেকে এ আন্দোলনে যোগ দেয়। কিছু তরুণকে তানা মন্ত্র বা ঐশী বাণী শেখানো হতো। এ যুবকেরা তাদের নিজ নিজ গ্রামে গিয়ে শিখে-আসা মন্ত্র বা বাণী অন্যদের শিখিয়ে দিত। এভাবেই ওরাওঁদের নতুন ধর্ম প্রচারলাভ করে। তানাদের শত্রু-তালিকায় ছিল বাভান (বিহারের একটি উচ্চ বর্ণ গ্রুপ), মুসলমান ও ইংরেজ। তারা বিশ্বাস করত, ১৯১৪ সালের নভেম্বর মাসে নব চন্দ্রোদয়ের পর সমস্ত ‘ঘৃণ্য’ মানুষের হাত থেকে তারা নিষ্কৃতি পাবে। এ ঘৃণ্যদের তালিকায় ছিল হিন্দু, মুসলমান, মিশনারি, পুলিশ ও সরকারি কর্মকর্তা। একই সময়ে গুজব ছড়ায় যে, খুব শিঘ্রি তাদের মাঝে একজন ত্রাণকর্তার আবির্ভাব ঘটবে। কেউ কেউ এ ত্রানকর্তাকে জার্মান বাবা বা কাইজার নামে অভিহিত করেছিল। জার্মান বাবা আকাশ থেকে বোমা ছুঁড়ে অবিশ্বাসী শত্রুপক্ষকে আক্রমণ করবেন এমনই বিশ্বাস ছিল তাদের। ‘আংরেজ কি ক্ষয়, জার্মান কি জয়’- এ ধ্বনি তানাদের মুখে মুখে ফিরতো। তারা ভবিষ্যৎবাণী করেছিল যে, জার্মান ও ইংরেজদের মধ্যে যুদ্ধ হবে, সে যুদ্ধে জার্মানরা জয়ী হবে এবং তারপর তারা ভারতবর্ষে এসে ওরাওঁ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে ঘৃণ্য ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটাবে।
ওরাওঁ সহিংসতার কারণে স্থানীয় জমিদার ও অ-উপজাতীয়দের মধ্যে তীব্র আতঙ্কের সৃষ্টি হত। বিশেষ করে যখন জমিদার ও তাদের ভৃত্য জঙ্গলে কাঠ সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রহূত হতো। ওরাওঁরা রাতের বেলা সভায় মিলিত হতো; সেখানে ধর্মীয় গান ও মন্ত্র গীতও উচ্চারিত হতো। সেখানে সবাইকে ভক্ত বা ভগৎ হতে বলা হতো। শুরু থেকেই তানা আন্দোলন ছিল একটি সমষ্টিগত উদ্যোগ; এর আদর্শ মৌখিকভাবে শেখা ও প্রচার করা হতো। একজন ‘আলোকিত পুরুষ’ বা গুরু অনুসারীদেরকে নবধর্মে দীক্ষা দিতেন। তানাদের প্রধান দেবতা ছিল ধরমেশ বাবা বা ভগবান বাবা। তাঁরই উদ্দেশ্যে তানাদের প্রার্থনা উচ্চারিত হতো। হিন্দু দেবতাকুল থেকে নেওয়া আরও কিছু দেবতাও তানাদের প্রার্থনায় স্থান পেয়েছিল; এদের মধ্যে ছিল সূর্য বাবা, ইন্দ্রবাবা, ব্রহ্মা বাবা, হিন্দু বাবা, জগন্নাথ বাবা, ভারত বাবা। জার্মান বাবাও তানা মন্ত্রে অনুপস্থিত ছিল না।
জমিদার ও সরকারের কাজ করতে অস্বীকার করার জন্য এবং শান্তি বিঘ্নিত করার জন্য ১৯১৪ সালের ২৩ এপ্রিল যাত্রা ও তাঁর প্রধান শিষ্যদের বন্দি করা হয়। মহকুমা আদালতে তাদের বিচার হয় ও কারাদন্ড দেওয়া হয়। ১৯১৫ সালের ২ জুন কারামুক্ত হওয়ার পর যাত্রা এ আন্দোলনের নেতৃত্ব ছেড়ে দেন। পরবর্তীকালে গান্ধীর সংস্পর্শে এসে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে তিনি অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। গুরু হিসেবে যাত্রার উত্তরসূরিদের মধ্যে সবার আগে ছিলেন লিথো ওরাওঁ। লিথো নিজেকে দেবী হিসেবে ঘোষণা করেন। ধর্ম প্রচারে তিনি যাত্রার পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিলেন। তাঁকেও গ্রেফতার করা হয় এবং মুক্তির পর তিনি ধীরে ধীরে বিস্মৃতির অন্তরালে চলে যান। ১৯১৫ সালের নভেম্বর মাসে মাংগোর ওরাওঁ তানা ভগৎ আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তাঁকেও একই পরিণতি বরণ করতে হয়।
১৯১৬ সাল নাগাদ এ আন্দোলন জলপাইগুড়ির চা বাগানে নিয়োজিত অভিবাসী ওরাওঁ কুলিদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯১৯ সালে শিবু ওরাওঁ ও মায়া ওরাওঁ-এর নেতৃত্বে তানা কর্মকান্ডে নতুন গতি সঞ্চারিত হয়। শিবু খাদ্য, পানীয় ও আচরণের ওপর যাত্রা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে দেন এবং তানারা হিন্দু ও মুসলমানের সমকক্ষ বলে দাবি করেন। ১৯২১ সাল থেকে তানা ভগৎ আন্দোলন নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করে। তানা মতবাদে নতুন নতুন ধারা সংযোজিত হয়। অনুসারিবৃন্দকে কংগ্রেস পতাকা বহন করতে, খদ্দর পরতে ও ‘গান্ধী মহারাজার’ নামে শপথ নিতে বলা হয়। গান্ধী, তাঁর চরকা ও তাঁর স্বরাজ ঘিরে কিংবদন্তি গড়ে ওঠে। ১৯২০-এর দশক থেকে গান্ধীবাদী জাতীয়তার সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি হওয়ার ফলে তানা ভগৎ আন্দোলন পূর্বেকার বৈপ্লবিক চরিত্র হারিয়ে ফেলে। কংগ্রেস প্রচার করে যে, গান্ধী রাজ উপজাতীয়দের জন্য স্বর্ণযুগ এনে দেবে। তানারা এ-প্রচারে বিশ্বাস স্থাপন করে। তারা মনে করে গান্ধী একজন দেবতা, তিনি বন্দুক ছাড়াই ইংরেজদের এদেশ থেকে বিতাড়িত করবেন এবং ধর্মরাজ্য স্থাপন করবেন। এভাবে তানা আন্দোলন রাজনীতির মূলস্রোত ও কংগ্রেসের ভাবাদর্শে মিশে যায়। [সংযুক্তা দাশগুপ্ত]
গ্রন্থপঞ্জি BB Chaudhuri, ‘The Story of a Tribal Revolt in the Bengal Presidency: the Religion and Politics of the Oraons, 1900-1926’, in Adhir Chakrabarti (ed) Aspects of socio-economic Changes and Political Awakening in Bengal, Calcutta, 1989; Sarat Chandra Roy, The Oraons of Chota Nagpur: Their History, Economic Life and Social Organisation, Ranchi, 1915; reprint, Calcutta, 1972; KS Singh, ‘Tribal Peasantry, Millenarianism, Anarchism and Nationalism: A Case Study of the Tana Bhagats in Chotanagpur, 1914-1925’, Social Scientist, 16, 1988.