বাংলালিপি

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৬:৫৩, ৩১ মার্চ ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

বাংলালিপি দূরের মানুষের কাছে ভাব প্রকাশের উপায় খুঁজতে গিয়েই শুরু হয় লিখন পদ্ধতি আবিষ্কারের প্রয়াস। প্রথমে চিত্র অঙ্কন করে ভাব প্রকাশের প্রচেষ্টা। কিন্তু চিত্র দিয়ে বস্ত্ত (concrete) প্রকাশ করা যায় মাত্র, সূক্ষ্ম অবচ্ছিন্ন (abstract) ভাবের প্রকাশ ঘটানো যায় না। তাই এবার শুরু হলো ভাব বা ব্যঞ্জনের প্রতিনিধি হিসেবে সাঙ্কেতিক চিহ্ন আবিষ্কারের প্রয়াস, যা চূড়ান্তরূপ লাভ করে বর্ণমালা আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে। পৃথিবীর প্রায় সকল লিপিই একটি মূল লিপি থেকে উদ্ভব হয়েছে। আর এ লিপির নাম হলো ফিনিশীয় লিপি। প্রাচীন ফিনিশীয়গণ প্রথম ব্যঞ্জনবর্ণের আবিষ্কার করেন। গ্রীকগণ এর সঙ্গে যোগ করেন স্বরবর্ণ (vowels), যা থেকে আধুনিক ইউরোপীয় বর্ণমালার উদ্ভব। কিন্তু ভারতবর্ষ তথা বাংলার লিপি ও সংখ্যাতত্ত্বের লিখন পদ্ধতির রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য।

বাংলালিপির বিবর্তনের রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। প্রাচীন ভারতে দু’টি লিপির ইতিহাস পাওয়া যায়। একটি হলো ব্রাহ্মী, অপরটির নাম খরোষ্টি। ব্রাহ্মী লেখা হতো বাম থেকে ডানদিকে, আর খরোষ্টি লেখা হতো ডান থেকে বামে। খরোষ্টি ভারতীয়দের নিজস্ব লিপি নয়। এ লিপি গৃহীত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের আরামিক লিপি থেকে। তবে এ লিপির ব্যবহার বিশেষ করে ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ। কুষাণযুগে খরোষ্টি ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলায় প্রাপ্ত কুষাণমুদ্রায়, পশ্চিমবঙ্গের বেড়াচাঁপা ও চন্দ্রকেতুগড়ে প্রাপ্ত পোড়ামাটির সীল ও মৃৎমাত্রের ভগ্নাবশেষে খরোষ্টি লিপি পাওয়া গিয়েছে। তবে বাংলার লিপিতে এর কোনো প্রভাব পড়েনি।

ব্রাহ্মীলিপি থেকেই বিকশিত হয়েছে বাংলালিপি। ব্রাহ্মী ভারতবর্ষের প্রাচীনতম ও বহুল প্রচলিত লিপি। কখন উদ্ভব হয়েছিল এ লিপির, তা সঠিক জানা যায়নি এখনো। অনেকে সিন্ধু লিপির সঙ্গে এ লিপির যোগসূত্র খোঁজার প্রয়াস পেয়েছেন। আবার কারো কারো মতে ভারতবর্ষের বাইরে থেকে এ লিপি এসেছে। এ লিপির নাম কেন ব্রাহ্মী হলো, তাও সঠিক বলা যায় না। কেউ কেউ বলে থাকেন, ব্রহ্মা হতে প্রাপ্ত বলে এ লিপির নাম হয়েছে ব্রাহ্মী। আবার কারও কারও ধারণা, ব্রাহ্মণদের লিপি বলেই এ লিপি ব্রাহ্মী সংজ্ঞা পেয়েছে। ব্রাহ্মীর প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে নেপালের তরাই অঞ্চলের প্রিপ্রাবা স্তূপ থেকে। প্রিপ্রাবা লিপিটি একটি কৌটার উপর খোদিত। এ পাত্রে বুদ্ধদেবের অস্থি রক্ষিত ছিল। এ থেকেই ধারণা করা হয় এ লিপিটি বুদ্ধের নির্বাণকাল খ্রি.পূ. ৪৮৭ এর কিছু পরেই উৎকীর্ণ। তবে ব্রাহ্মীর বহুল প্রচলন দেখা যায় মৌর্য সম্রাট অশোকের শিলালিপি ও স্তম্ভ লিপিতে। অশোকের লিপিতে ব্রাহ্মীর অনেক পরিণত ও পূর্ণাঙ্গরূপ দেখা যায়, যা থেকে ধারণা করা হয় বহুপূর্ব থেকে দীর্ঘ বিবর্তনের মাধ্যমে ব্রাহ্মী অক্ষরগুলি অশোক লিপির পর্যায়ে বিবর্তিত হয়েছিল। ১৮৩৭ খ্রি. জেমস প্রিন্সেপ নামে একজন ব্রিটিশ পন্ডিত ব্রাহ্মী পাঠোদ্ধারে সক্ষম হন। আর ব্রাহ্মীর সূত্র ধরেই ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রাচীন লিপিসমূহের পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়। উনিশ শতকের শেষদিকে কয়েকটি এবং বিশ শতকের প্রথমার্ধ জুড়ে একের পর এক বাংলা অঞ্চলের প্রাচীন লিপিমালা পাঠোদ্ধার হতে থাকে, এ থেকে বাংলার লিপি বিবর্তনের ধারাবাহিক ইতিহাস জানা সম্ভব হয়েছে।

ব্রাহ্মী থেকে ভারতবর্ষের বিভিন্ন আঞ্চলিক লিপির উদ্ভব হয়েছে। নাগরী, সারদা, টাকরী, গ্রন্থ, গুরুমুখী, গুজরাতী, তামিল, তেলেগু, উড়িয়া, মালয়, কানেড়ী, বাংলা, তিববতি, সিংহলী, বর্মী-এ সব আধুনিক লিপিই ব্রাহ্মী’র সুদীর্ঘ আঞ্চলিক বিবর্তনের চূড়ান্ত রূপ। হস্তলিখিত লিপিতে লেখকের রুচিভেদে কালক্রমে পরিবর্তন হয়ে থাকে। ব্রাহ্মীলিপি এভাবে বিবর্তিত হয়েছে। এ বিবর্তনের গতি ও ধারা এক এক অঞ্চলে এক এক ধরনের। এ কারণে ভারতে নানা অঞ্চলের লিপির মধ্যে রূপভেদ ঘটেছে।

বাংলা লিপির উদ্ভব ঘটেছে উত্তর ভারতীয় ব্রাহ্মী (Northern Class of Brahmi) থেকে। উত্তরভারতীয় ব্রাহ্মী কালক্রমে বিবর্তনের মাধ্যমে স্পষ্ট দু’টি ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে - একটি পশ্চিমীধারা, অপরটি পূর্বীধারা। এ পূর্বীধারা থেকেই বাংলা লিপির উদ্ভব হয়েছে। বাংলায় ব্রাহ্মীতে উৎকীর্ণ প্রধানত দু’টি নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে-একটি মহাস্থান লিপি, অপরটি নোয়াখালী জেলায় প্রাপ্ত শিলুয়া মূর্তিলেখ। মূর্তিলেখটি অত্যন্ত ক্ষয়ধরা (badly corroded) এবং পাঠোদ্ধারের অনুপযোগী। এছাড়াও বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত এবং মহাস্থানে প্রাপ্ত কয়েকটি পোড়ামাটির ফলক ও সীলে এবং পশ্চিমবঙ্গের বেড়াচাঁপা ও চন্দ্রকেতুগড়ে প্রাপ্ত কয়েকটি পোড়ামাটির সীল ও মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশে উৎকীর্ণ ব্রাহ্মীলিপি পাওয়া গিয়েছে। তবে মহাস্থান লিপিটি বাংলায় প্রাপ্ত ব্রাহ্মীর প্রাচীনতম নিদর্শন। সম্ভবত মৌর্যযুগের শেষদিকে এ অঞ্চলে ব্রাহ্মী লিপির প্রচলন ঘটেছিল। সেজন্য কেউ কেউ এসব লিপিকে মৌর্যোত্তর ব্রাহ্মী (Late Mauryian Brahmi) বলে অভিহিত করেছেন।

উত্তরভারতে ব্রাহ্মীলিপি বিবর্তনের প্রাথমিক রূপটি ধরা পড়ে শুঙ্গফলকে, ক্ষত্রপদের লিপি ও মুদ্রায় এবং কুষাণলিপিতে। কুষাণযুগের কয়েকটি বর্ণে ব্রাহ্মীর কৌণিক (angular) রূপের পরিবর্তে অক্ষরের বাঁক নেওয়া (cursive) রীতি প্রত্যক্ষ করা  গিয়েছে ব্রাহ্মী ‘অ’ বর্ণের বামদিকের কৌণিক রেখা দুটি স্পষ্ট বাঁক নিতে দেখা যায় (        )। আবার ‘ণ’ অক্ষরটির উল্লম্ব রেখাটির শীর্ষপ্রান্ত ডান ও বামদিকে বাঁক নিতে দেখা যায়      (        )। এ যুগে স্বরবর্ণের চিহ্ন ‘া’ কারের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধিত হয়। ব্রাহ্মীর আনুভূমিক (horizontal) ‘া’ কারের পরিবর্তে বর্ণের শিরোভাগে তির্যক (slanting) ‘া’ কারের ব্যবহার দেখা যায়। তবে কুষাণযুগে বেশি সংখ্যাক ব্রাহ্মী অক্ষরই অপরিবর্তিত থাকে।

পূর্বভারতে ব্রাহ্মীলিপির বৈপ্লবিক পরিবর্তন সংঘটিত হয় গুপ্তযুগে অর্থাৎ পঞ্চম শতকে। গুপ্ত সম্রাটদের অধীনে সমগ্র উত্তর পশ্চিম ও পূর্বভারত জুড়ে একক সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে। গুপ্ত সম্রাটগণ ছিলেন শিল্পসংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক। এ যুগে প্রাকৃত ভাষার পরিবর্তে সংস্কৃত ভাষা রাষ্ট্রীয় বা দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে লিপি লিখন পদ্ধতিরও ব্যাপক বিকাশ ঘটে। বিভিন্ন অঞ্চলে হাতে খোদিত লিপির আকৃতিরও পরিবর্তন ঘটে। লেখার উপকরণেও পরিবর্তন আসে এবং উপকরণের পরিবর্তন লিপি পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রস্তর লিপির পরিবর্তে এ যুগে তাম্রপাতে লিপি উৎকীর্ণ হওয়ার প্রচলন শুরু হয়। সাহিত্য লেখার উপকরণ হিসেবে ব্যবহূত হতে থাকে তালপত্র ও ভূর্জপত্র। কিন্তু এসব উপকরণ ছিল ক্ষণস্থায়ী। ভূমির দলিল দীর্ঘকাল সংরক্ষণ করার মানসে লিপি তাম্রপাতে উৎকীর্ণ করা হতো, যা তাম্রলিপি বা তাম্রশাসন নামে পরিচিত। রাজাদেশ সংবলিত ভূমিদান বা ভূমিক্রয়ের দলিল এসব তাম্রলিপিতেই পাওয়া গিয়েছে প্রাচীন বাংলার ঐতিহাসিক তথ্যের রত্নখনি। বাংলা লিপির বিবর্তনের ইতিহাস রচনার প্রধান উপাদানই হচ্ছে এসব তাম্রলিপি। গুপ্তযুগে উত্তর বঙ্গে ৮টি এবং দক্ষিণপূর্ব বঙ্গে ১টিসহ মোট ৯টি তাম্রলিপি আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব তাম্রলিপিতে পূর্বভারতীয় ব্রাহ্মীলিপির পরিবর্তনের রূপটি ধরা পড়ে। গুপ্তযুগে ব্রাহ্মীবর্ণ বিভিন্ন দিকে বাঁক নিতে দেখা যায়, যা থেকে বাংলা বর্ণের প্রাথমিক রূপটি লক্ষ করা যায়। গুপ্তযুগে ব্রাহ্মী স্বরবর্ণের ব্যাপক বিবর্তন ঘটে। ব্রাহ্মী ‘ই’ বর্ণটি লেখা হতো তিনটি ডট চিহ্ন (three dots) দিয়ে। গুপ্তযুগে একটি ডট চিহ্ন উঠে যায় এবং একটি উলম্ব রেখার বামদিকে দু’টি ডট চিহ্ন (two dots) দিয়ে ‘ই’ বর্ণ লেখার প্রচলন ঘটে। ‘উ’ বর্ণটি লেখায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধিত হয়। এ যুগে ব্রাহ্মী’র কৌণিক ‘উ’ বর্ণটির আনুভূমিক রেখাটি নিচে বাম দিকে বাঁক  (          ) নেয়, যা থেকে বাংলা ‘উ’ বর্ণটির উদ্ভব হয়। ‘া ’, ‘’’, ‘ী’, ‘’’, ‘’’ প্রভৃতি স্বরধ্বনির চিহ্নগুলিও এ যুগে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লাভ করে। এসময় কুষাণযুগের তির্যক (slant) রীতির পরিবর্তে বাঁক নেওয়া (cursive) স্বরবর্ণের চিহ্ন লেখার রীতি স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়।

ব্রাহ্মী’র ব্যঞ্জনবর্ণগুলি গুপ্তযুগে ব্যাপক পরিবর্তন লাভ করে। পাখির ঠোঁট আকৃতির ‘চ’ বর্ণটি এ যুগে আরও স্ফীত (bulge) ও বাঁকা হতে থাকে  (       )। ব্রাহ্মী ’জ’ বর্ণটি ছিল ইংরেজি ‘E’ বর্ণের মতো। কিন্তু গুপ্তযুগে ‘জ’ বর্ণটির মধ্যের বাহুটি ছোট হতে থাকে এবং নিচের বাহুটি বাম দিকে বাঁক নিতে দেখা  (       ) যায়, যা থেকে বাংলা ‘জ’ বর্ণটির প্রাথমিক রূপ ধরা পড়ে। এ সময় ‘ম’ বর্ণের বামদিকের উল্লম্ব রেখাটি বাঁকাভাবে লেখা শুরু হয়। গুপ্তযুগে ‘খ’ ‘গ’ এবং ‘শ’ বর্ণের বামদিকে ত্রিকোণাকার পদোচিহ্ন (footmark) রীতির প্রচলন ঘটে, যা কালক্রমে বাংলা ‘খ’ ‘গ’ ও ‘শ’ বর্ণের বামদিকে পুটুলিতে রূপ নেয়। এ যুগে ব্রাহ্মী ‘খ’ এর নিচের গোলাকার অংশটি ত্রিকোণাকার রূপ লাভ করে    (       ), যা বাংলা ‘খ’ বর্ণের প্রাথমিক রূপ ধারণ করেছে।

গুপ্তোত্তর যুগেও বাংলায় লিপি পরিবর্তনের ধারা অব্যাহত থাকে। মেদিনীপুরে প্রাপ্ত ষষ্ঠশতকে শশাঙ্কের তাম্রলিপিতে এবং ফরিদপুর অঞ্চলে প্রাপ্ত ধর্মাদিত্য, সমাচারদেব ও গোপচন্দ্রের তাম্রলিপিতে গুপ্তোত্তর যুগের লিপি পরিবর্তনের ধারা লক্ষ করা যায়। এসব তাম্রলিপিতে ক্রমশ পশ্চিমী ধারার অবসান ঘটতে শুরু করে এবং পূর্বীধারা স্বতন্ত্ররূপে দৃশ্যমান হয়। সমাচারদেবের ঘুঘ্রাহাটি তাম্রলিপিতে গুপ্তযুগের ‘অ’ লিপিটির পরবর্তন ঘটে।‘অ’বর্ণেরবামদিকের উল্লম্ব (Vertical) রেখার নীচের প্রান্তে কমা’র মতো বাঁক নিতে শুরু করে  (    ), যাকে আহ্মেদ হাসান দানী পূর্বী রূপভেদের বক্র ‘অ’ (curved ‘অ’ of the eastern variety) বলে অভিহিত করেছেন। এ পরিবর্তন বাংলা ‘অ’ বর্ণের উদ্ভবের ঊষালগ্নের ইঙ্গিতবহ। আবার গুপ্তযুগে ‘উ’ বর্ণের নিচের রেখা বাম দিকে বাঁক নেওয়ার যে প্রচলন হয়েছিল, তা আরও বড় হয়ে নিচে থেকে উপরে ওঠে  (   )। এ পরিবর্তন ধীরে ধীরে বাংলা ‘উ’ বর্ণে রূপ নিয়েছে। এ যুগে ‘খ’ বর্ণটি বামদিকের পদোচিহ্ন আরেকটু বড় হতে থাকে এবং শিরোভাগে ঢালুরেখার সৃষ্টি হয়। সঙ্গে সঙ্গে ‘খ’-এর নিচের ত্রিভুজ আকৃতির অংশটি আরও স্ফীত হয়ে বাংলা ‘খ’ বর্ণে রূপান্তরিত হয়। সমাচারদেবের লিপিতে ‘ল’ বর্ণটির বামদিকে বড়শির মতো বাঁকানো একটি রেখা তৈরি হচ্ছে। অনুরূপ ‘হ’-এর নিচে বড়শির মতো বাঁকানো একটি রেখার সৃষ্টি হয়। ‘ষ’ বর্ণটি এ যুগে আরও উন্নতরূপ নেয়। তবে এ যুগে ‘য’ বর্ণের আমূল পরিবর্তন দেখা যায়। গুপ্তযুগে ‘য’ বর্ণটি ছিল তিনবাহু (tripartite) বিশিষ্ট। কিন্তু গুপ্তোত্তর যুগে ‘য’ বর্ণটি দ্বি-বাহুতে (bipartite) রূপান্তর ঘটে  (           ), যা থেকে বাংলা ‘য’ বর্ণটির উদ্ভবের রূপরেখা ধরা পরে।

সপ্তম শতক বাংলালিপি বিবর্তনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এ যুগে বাংলা অঞ্চলের লিপিতে মধ্যগাঙ্গেয় অঞ্চলের কুটিল লিপির প্রভাব লক্ষ করা যায়। উত্তর ভারতে গুপ্তলিপি ক্রমশ পরিবর্তনের মাধ্যমে কুটিল লিপির উদ্ভব। বর্ণের বাঁক নেওয়া (bent) রীতি অথবা কুটিল আকৃতি অক্ষরের কারণে এ সময়ের লিপির এমন নামকরণ করা হয়েছে। দক্ষিণপূর্ব বাংলার নাথ, রাত ও খড়গ রাজাদের লিপিতে এবং ভাস্করবর্মার নিধানপুর তাম্রশাসনে কুটিল লিপির প্রচলন ঘটে। কোনো কোনো অক্ষরের সূক্ষ্ম কৌণিক রূপ (acute angle) এবং কোণের যুক্ত অংশটির নিচে লেজের মতো বৃদ্ধি পেয়েছে (tailed variety)।

খড়গ ও রাতদের লিপিতে ‘অ’ বর্ণের বামদিকে কমা’র মত অংশটি আরও বড়, যা বাংলা ‘অ’ বর্ণের খুব কাছাকাছি। ‘ই’ বর্ণের উপরের দুটি ডটচিহ্নের নীচে কমা’র মতো বাঁক নিতে দেখা যাচ্ছে। এছাড়া স্বরবর্ণের চিহ্নগুলি লেখার ক্ষেত্রেও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। এ সময়ের লিপিতে ব্যঞ্জনবর্ণের ডানদিকে স্বতন্ত্র উল্লম্ব রেখা দিয়ে ‘া’-কার এবং বামদিকে বাঁকানো ‘’’, এবং ‘’’ ও ‘ী’-কারের শিরোভাগে আংলকারিক (ornamental) উড়ি যুক্ত হয়, যা বাংলা স্বরবর্ণের চিহ্নগুলির খুব কাছকাছি।

সপ্তম শতকে ‘ক’ এবং ‘র’ বর্ণটি লিখন রীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর যুগের যোগ চিহ্নের মতো ‘ক’ বর্ণটি এ সময় ত্রিকোণাকার রূপ নেয় এবং ডানদিকে বক্ররেখা (loop) যুক্ত হয়  (          ), যা বাংলা ‘ক’ বর্ণের উদ্ভবের প্রাথমিক রূপ ধরা পড়ে। আবার ব্রাহ্মী ‘র’ বর্ণটি ছিল একটি উল্লম্ব (vertical) রেখার মতো। কিন্তু এ যুগে ‘র’ বর্ণটি ক্রিকোণাকার রূপ লাভ (       ) করে। তবে ‘র’ বর্ণের নিচে কোন বিন্দু দেখা যায় না। ‘থ’ এবং ‘ফ’ বর্ণটিরও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। ‘থ’-এর মধ্যভাগটি আরেকটু স্ফীত হয় এবং শিরোভাগে একটি পুটুলি দেখা যায়। ‘থ’ বর্ণের এই রূপান্তর (development) বাংলা ‘থ’ বর্ণে রূপ লাভ করতে সহায়ক হয়েছে। অনুরূপ ‘ফ’-এর ডানদিকে একটি পুটুলি যুক্ত হয়েছে, যা থেকে বাংলা ‘ফ’ বর্ণের উদ্ভব। সপ্তম শতকে লিপির এমন পরিবর্তন প্রোটো-বাংলা (Proto-Bangla) লিপির উদ্ভবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

বাংলা লিপির পাশাপাশি বাংলা সংখ্যা লিপির উদ্ভব ও বিবর্তন সম্পর্কে ধারণা দেওয়া আবশ্যক। সংখ্যাতত্ত্ব বা গনণাপদ্ধতি মানুষের দৈনন্দিন জীবনে অতি প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। কিন্তু কখন, কোথায় এবং কীভাবে পৃথিবীতে প্রথম গননা পদ্ধতির সূত্রপাত ঘটেছিল, তার সঠিক ইতিহাস পাওয়া যায় না। বলা হয়ে থাকে, ইউরোপীয়গণ আরবদের নিকট থেকে সংখ্যা তত্ত্ব ও গনিতশাস্ত্র সম্পর্কে ধারণা লাভ করেন, যা রেনেসাঁ যুগে গনিতশাস্ত্রের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ সময় থেকে ইউরোপীয়গণের মধ্যে এই ধারণা বন্ধমূল হয় যে, আরবগণই সংখ্যাতত্ত্বের উদ্ভাবক।

কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের আরামিক বা সেমেটিক সংখ্যালিখন পদ্ধতির সঙ্গে ভারতবর্ষের সংখ্যালিখন পদ্ধতির মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। সেমেটিক পদ্ধতিতে সংখ্যা লিখিত হয় ডান থেকে বামে। কিন্তু ভারতীয় সংখ্যা লিখন পদ্ধতি বাম থেকে ডানে। তাছাড়াও প্রখ্যাত আরব গণিত শাস্ত্রবিদ মুহম্মদ ইব্নে মুসা আল খাওয়া রিজমী ও আল কিন্দী (৮০০-৮৭০ খ্রি.) তাঁদের লেখা গ্রন্থে পাটি গণিত ও সংখ্যাতত্ত্বের উদ্ভাবনের কৃতিত্ব দিয়েছেন প্রাচীন ভারতীয়গণকে। তারা সংখ্যা তত্ত্বকে ‘ইলম হিন্দ’ (Indian science) বলে অভিহিত করেছেন। বস্ত্ততঃ প্রাচীন ভারতীয়গণের একটি বড় কৃতিত্ব স্বতন্ত্র সংখ্যা লিখন পদ্ধতি, শূন্য ও দশমিকের ব্যবহার পদ্ধতির উদ্ভাবন। ভারতে কখন সংখ্যাতত্ত্বের উদ্ভাবন ঘটেছিল, তা জানা যায়নি। ভাস্কর তার ‘বাসনা’ গ্রন্থে সংখ্যাতত্ত্ব ব্রহ্মা থেকে প্রাপ্ত বলে উল্লেখ করেছেন (originate from the beneficent creator of the Universe)। বলা হয়ে থাকে, সংখ্যাতত্ত্বের উদ্ভাবন লিখন পদ্ধতিরও আগে হয়েছিল। ঋক্বেদের যুগের লোকেরা গণনাপদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত ছিল। বেদে সপ্ত সিন্ধু, সহস্রপুরুষ, অষ্টপর্বত, তিনটি স্বর্গ প্রভৃতি সংখ্যার উল্লেখ রয়েছে। তবে ভারতীয় সংখ্যা লিখনের সবচেয়ে প্রাচীনরূপটি ধরা পড়ে অশোকের লেখমালায়, খ্রিঃ পূঃ তৃতীয় শতকের নানাঘাট লিপিতে, যেখানে ১, ২, ৩, ৪, ৬, ৭, ৯, ১০, ২০, ৬০, ৮০, ১০০, ২০০, ৪০০, ১০০০ প্রভৃতি সংখ্যা লিপির উল্লেখ দেখা যায়। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে নাসিক গুহা লিপি (Nasik Cave Inscription)-এ ১ থেকে ১০ পর্যন্ত সহ শতক, সহস্র সংখ্যা লিখনের নমূনা পাওয়া যায়। বাংলায় গুপ্তযুগের তাম্রলিপিতে প্রথম সংখ্যা লিপি পাওয়া যায়। বাংলায় প্রাপ্ত তাম্রলিপিগুলিতে সম্বত ও রাজ্যাঙ্ক উল্লেখ করতে গিয়ে সংখ্যা লিপি ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলায় সংখ্যা লিপি বিবর্তনের তিনটি পর্যায় চিহ্নিত করা যায়। গুপ্তযুগে সংখ্যা লিপির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। উত্তর ভারতে গুপ্ত সংখ্যা লিপির বিবর্তনের মাধ্যমে নাগরী সংখ্যা লিপির উদ্ভব হয়েছে। পালযুগে উত্তর ভারত ও মধ্যগাঙ্গেয় সংখ্যালিপির প্রভাবে বাংলা সংখ্যা লিপি নতুনরূপে দেখা যায়। সেন-বর্মন যুগে সংখ্যালিপির আরেকটি পরিবর্তন লক্ষ্য করা য়ায়, যাকে প্রোটো-বাংলা সংখ্যা লিপি বলা যেতে পারে। তবে বাংলা সংখ্যালিপির প্রথম ব্যবহার দেখা যায় পনেরো, ষোল, সতেরো ও আঠারো শতকের পান্ডুলিপিতে।

বাংলা লিপির বিবর্তনের ইতিহাসে আরেকটি উল্লেখযোগ্য পর্যায় চিহ্নিত করা যায় অষ্টম থেকে নবম শতকের মাঝামাঝি সময়কে। এ সময়কালে বাংলার লিপিতে উত্তরভারতীয় নাগরী লিপির প্রভাব পড়ে এবং পূর্বভারতীয় লিপি নতুন চরিত্র লাভ করে, যাকে লিপিবিদ্যাবিশারদগণ ‘‘প্রোটো-নাগরী’’ (Proto-Nagari) লিপি বলে অভিহিত করেছেন। এ সময়ে লিপি পরিবর্তনের মূলে ছিল পাল রাজবংশের উদ্ভব। বাংলা, বিহার ও উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল পাল রাজাদের শাসনাধীনে পরিচালিত হয়। উল্লিখিত বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ ও ভাবের আদান-প্রদান ঘটে। শিল্পকলা ও সাহিত্যের বিকাশ ঘটে। এই সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের ঢেউ বাংলা অঞ্চলের লিপির  চেহারা বদলে দেয়। ধর্মপালের খালিমপুর তাম্রলিপি, দেবপালের মুঙ্গের তাম্রশাসন এবং প্রথম মহীপালের সারনাথ লিপিতে ‘‘প্রোটো-নাগরী’’ (Proto-Nagari) লিপির প্রচলন দেখা যায়। ময়নামতির আদি দেব (Early Deva) রাজাদের লিপিতে ও চন্দ্রলিপিতে প্রোটো-নাগরী লিপির প্রভাব প্রতিফলিত হয়।

বাংলায় ‘প্রোটো-নাগরী’ লিপি খুব বেশি কাল স্থায়ী হয়নি। স্থানীয় লিপিকরদের কুটিল লিপির প্রভাবে ক্রমশ ‘প্রোটো-নাগরী’ লিপি পরিবর্তিত হতে থাকে। প্রোটো-নাগরী ও কুটিল লিপির সম্মিলিত প্রভাবে বাংলা অঞ্চলের লিপি নতুন রূপ লাভ করে, যাকে রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় ‘‘প্রোটো-বাংলা’’ (Proto-Bangla) এবং ননীগোপাল মজুমদার ও প্রমোদলাল পাল বাংলা লিপির অব্যবহিত পূর্বসূরী (imidiate precursor of the modern Bangla alphabet) বলে সংজ্ঞায়িত করেছেন। নবম শতকের মাঝামাঝি থেকে সমগ্র দশম শতক জুড়ে বাংলায় প্রোটো-বাংলা লিপির ব্যাপক প্রচলন প্রত্যক্ষ করা যায়। ‘প্রোটো’ অর্থ প্রায়। ‘প্রোটো-বাংলা’ বলতে প্রায় বাংলা বা বাংলালিপির খুব কাছাকাছি অবস্থান করছে এমন লিপিকে বুঝায়। মহীপালের বানগড় লিপি, নারায়ণপালের গরুড় স্তম্ভলিপি এবং বিগ্রহপালের আমগাছি লিপিতে প্রোটো-বাংলা লিপির প্রাথমিক রূপ লক্ষ করা যায়। পালযুগের পান্ডুলিপি ‘অষ্টসহস্রিকাপ্রজ্ঞাপারমিতা’ এবং সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিতম্’ গ্রন্থেও প্রোটো-বাংলা লিপির বহুল ব্যবহার দেখা যায়। চন্দ্ররাজাদের লিপিতে, পরবর্তী  দেব (later Deva) রাজাগণের লিপিতে, সেনযুগের প্রথম দিকে অর্থাৎ বিজয় সেন, বল্লাল সেনের সময়ের পান্ডুলিপি ও তাম্রলিপিতে প্রোটো-বাংলা লিপির বহুল প্রচলন ছিলো। এ সময়ে বহু বর্ণ অবিকল বাংলার মতোই লেখা হতে থাকে। ‘ই’, ‘ঈ’, ‘উ’, ‘ঊ’, ‘ট’ প্রভৃতি বর্ণগুলির আলংকারিক উড়ি ছাড়া অবিকল বাংলা বর্ণমালার মতোই লেখা হতো। এ যুগের লিপিমালায় স্বতন্ত্র ‘ঈ’ বর্ণের ব্যবহার দেখা যায়। ‘ঈ’ বর্ণটি প্রথম দেখা যায় উত্তর ভারতীয় ক্ষত্রপদের মুদ্রায়। গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর যুগে স্বতন্ত্র ‘ঈ’ বর্ণের সন্ধান পাওয়া যায় না। ওই সময় ব্যঞ্জনবর্ণের সঙ্গে ‘ী’-কার হিসেবে ‘ঈ’-এর ব্যবহার দেখা গিয়েছে। কিন্তু সেন ও চন্দ্র লিপিতে পৃথক ‘ঈ’ বর্ণের ব্যবহার দেখা যায়। ‘চ’-বর্ণটি প্রোটো-বাংলায় নতুন রূপে পরিবর্তিত হয়। ইতিপূর্বে  ‘চ’-এর নিচের বক্রাকার (           ) রেখাটি ছিল বামদিকে। কিন্তু প্রোটো-বাংলায় সেটা ডানদিকে চলে আসে। এছাড়া প্রোটো-বাংলা লিপিতে ‘ক্ষ’, ‘ঙ্গ’, ‘ঞ্জ’, ‘চ্ছ’, ‘ঞ্চ’ প্রভৃতি যুক্তাক্ষরগুলি বাংলা অক্ষরের খুব কাছাকাছি অবস্থান করতে থাকে।

বাংলালিপির বিবর্তনের চূড়ান্ত ধাপটি লক্ষ করা যায় এগারো ও বারো শতকে, যে সময়ে লিপি প্রোটো-বাংলা থেকে বাংলায় রূপান্তর ঘটেছে। সেন যুগের শেষ দিকে লিপি পরিবর্তনের এই রূপরেখা ধরা পড়ে। লক্ষ্মণসেনের আনুলিয়া তাম্রশাসনে বাংলা লিপির ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়। বিশ্বরূপসেনের সাহিত্য পরিষৎ লিপিতে বাংলালিপির ব্যবহার আরও বৃদ্ধি পায়। ডোম্মনপালের সুন্দরবন তাম্রলিপিটি (১১৯৬ খ্রি.) প্রায় পূর্ণাঙ্গ বাংলা হরফে উৎকীর্ণ। বারো শতকের পরে বাংলায় আর কোনোও তাম্রলিপি পাওয়া যায়নি। তের শতকের মাঝামাঝি থেকে সতেরো শতক পর্যন্ত পান্ডুলিপি পাওয়া যায়। এসব পান্ডুলিপি থেকে বাংলা লিপির পূর্ণাঙ্গ রূপ ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত তের শতকের পান্ডুলিপি ‘বজ্রায়নেসাধনাঙ্গানি, রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির সংগ্রহে রক্ষিত ‘পঞ্চরক্ষা’ ও ‘গূহ্যাবলীবিবৃতি’ প্রভৃতি পান্ডুলিপিতে বাংলা লিপির প্রচলন লক্ষ করা যায়। চৌদ্দ শতকে রচিত বড়ুচন্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’, পনেরো শতকে রচিত ‘বোধিচর্যাবতার’ প্রভৃতি পান্ডুলিপিতে বাংলা লিপির আরও পরিণত রূপ ধরা পড়ে। বর্ধমান জেলার বেগুনিয়ায় গণেশ মন্দিরের দরজায় উৎকীর্ণ পনেরো শতকের লিপিতে বাংলালিপির পূর্ণাঙ্গরূপ পরিলক্ষিত হয়। ষোল, সতেরো ও আঠারো শতকের পান্ডুলিপিতে বাংলালিপির তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যায় না।

১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে চার্লস উইলকিন্স ও পঞ্চানন কর্মকার তৎকালে প্রচলিত প্রাচীন পুঁথির বাংলা অক্ষরের আদলে বাংলা বর্ণমালা তৈরি করে হুগলীতে প্রথম বাংলা মুদ্রণযন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। এ বছরই ঐ মুদ্রণযন্ত্র থেকে হ্যালহেডের A Grammar of the Bengali Language শীর্ষক গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থে বাংলা অংশের মুদ্রণে হাতে খোদিত বাংলা টাইপ প্রথম ব্যবহূত হয়। নির্মিত বাংলা বর্ণমালা মুদ্রিত হয়। উনিশ শতকে প্রায় সর্বত্রই বাংলা মুদ্রণ পদ্ধতি প্রচলিত হয়। ফলে হস্তলিখিত পুঁথির ব্যবহার হ্রাস পায়। ইতোপূর্বে যুগে যুগে ব্যক্তিভেদে হস্তাক্ষরের পরিবর্তন ঘটলেও মুদ্রণযন্ত্রে বাংলা গ্রন্থ মুদ্রিত হওয়ায় পর থেকে বাংলা বর্ণ সার্বজনিক নির্দিষ্ট আদল লাভ করে। উনিশ শতকের ধাতু ঢালাইয়ের মাধ্যমে লেটারফ্রেমে মুদ্রণের জন্য বিভিন্ন ধরনের টাইপ-ফন্ট তৈরি হয়। বিশ শতকে এর সঙ্গে যুক্ত হয় আরো উন্নত মুদ্রণ প্রযু&&ক্ত। বাংলা টাইপের ক্ষেত্রে তার স্তরগুলি হচ্ছে যথাক্রমে মনো-টাইপ সেটিং, লাইনো-টাইপ সেটিং, ফটো-টাইপ সেটিং ও কম্পিউটার টাইপ সেটিং। পাশাপাশি বাংলা টাইপ রাইটারের প্রবর্তন ঘটে রেমিংটন ও মুনির অপটিমাসহ বিভিন্ন টাইপ রাইটারের মাধ্যমে। মুদ্রণের ক্ষেত্র প্রযুক্তিগত এই অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বাংলা হরফে নানা ধরণের রূপবৈচিত্র্য ঘটে চলেছে।

পরিশেষে বলা যেতে পারে বাংলা লিপি পূর্ব-ভারতীয় ব্রাহ্মীলিপির সূদীর্ঘ আঞ্চলিক বিবর্তন ধারার চূড়ান্তরূপ। ব্রাহ্মী থেকে উদ্ভব হলেও বর্তমানে ব্রাহ্মী হরফের সঙ্গে বাংলা লিপির তেমন কোন সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় না। আঞ্চলিক লিপিকারদের হাতে ক্রমশ পরিবর্তনের মাধ্যমে বাংলা লিপি স্বতন্ত্র সত্ত্বা লাভ করেছে। স্বরবর্ণের চিহ্নগুলির আলংকারিক বাক নেওয়া রূপ (cursive ornamental medials) বাংলার লিপিকারগণের নিজস্ব উদ্ভাবন। বাংলা লিপি থেকেই উদ্ভব হয়েছে নেপালী ও অসমীয়া বা অহম লিপির। বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামের কাছাড় জেলায় বাংলা ভাষাভাষী জনগণের নিকট ভাব প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে বাংলা লিপি বহুল প্রচলিত। বাংলা লিপি বাঙালীর গৌরবময় ঐতিহ্য। মায়ের ভাষার মত বাঙালীর আবেগ ও ভালবাসা জড়িয়ে আছে এ লিপির সঙ্গে। [মোঃ শরিফুল ইসলাম]

গ্রন্থপঞ্জি  রাখালদাস বন্দপাধ্যায়, দি অরিজিন অব দি বেঙ্গলি স্ক্রিপ্ট, নব ভারত প্রকাশনী, কলকাতা, ১৯১৯; গোরীশঙ্কর হীরাদাঁদ ওঝা, প্রাচীন ভারতীয় লিপিমালা, অনুবাদ মণীন্দ্রনাথ সমাজদার, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮৯; প্রমোদ লাল পাল, দি ডেভেলপমেন্ট অব দি বেঙ্গলি স্ক্রিপ্ট, ইন্ডিয়ান হিস্ট্রিক্যাল কার্টারলি, ১৯৩৬, ৩০৮-৩৩৪; এস.এন. চক্রবর্তী, দি অরিজিন এন্ড ডেভেলপমেন্ট অব দি বেঙ্গলি স্ক্রিপ্ট, জার্ণাল অব দি রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল, লেটারস, ভল্যুম IV, ১৯৩৮, ৩৫১-৩৯১; সুকুমার রঞ্জন দাস, দি অরিজিন এন্ড ডেভেলপমেন্ট অব নিউমেরালস, ইন্ডিয়ান হিস্ট্রিক্যাল কার্টারলি, ভল্যুম III, ১৯২৭, ৯৭-১২০; রবীন্দ্রনাথ ঘোষ ঠাকুর, সংস্কৃত বর্ণমালার ইতিহাস।