সূত্রধর
সূত্রধর বাংলাদেশে কাঠমিস্ত্রি হিসেবে পরিচিত। এদের সুতারও বলা হয়। তারা কাঠের কাজ করার জন্য নিয়োজিত, বিশেষত, করাত দিয়ে কাঠ কেটে ফেঁড়ে টিম্বার তৈরি করে। তারা কাঠ দ্বারা নির্মিত বাড়ি তৈরি, দালান বা বাড়িসমূহের প্রয়োজনীয় স্থানে কাঠ স্থাপন, কাঠের আসবাবপত্র তৈরি, নৌকা এবং বিভিন্ন ধরনের কৃষিকাজে ব্যবহূত কাঠের যন্ত্রপাতি তৈরি করে। কাঠমিস্ত্রিরা কাঠকে শ্রেণিবদ্ধভাবে সাজানোর জন্য বংশানুক্রমে সূত্র বা সুতা ব্যবহার করে আসছে। যে ব্যক্তি এ সুতা ধরে কাজ করেন তিনি সূত্রধর উপাধি পেয়ে থাকেন। ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত যে সূত্রধররা উদ্ভাবনী ক্ষমতাসম্পন্ন এবং তারা মনের দিক থেকে শৈল্পিক চেতনাসম্পন্ন। তাদের শিল্পিত কাঠের কাজ বিদেশিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। শৌখিন ব্যক্তিরা কারুকার্যমন্ডিত খোদাই কাঠ তাদের সাজঘরে সংরক্ষণের জন্য সংগ্রহ করে নিয়ে যান। বাংলাদেশের কাঠমিস্ত্রিদের তৈরি কারুকার্যমন্ডিত পাল্কি, দরজা, জানালা, ঘরের বেড়া, বাসাবাড়ির আসবাবপত্র, মন্দিরের দেয়াল এবং নৌকার কাঠখোদাই উল্লেখযোগ্য।
সূত্রধররা মূলত হিন্দু ধর্মের নিম্নবর্ণের অন্তর্ভুক্ত। অন্যান্য অনেক নীচু জাতের হিন্দুদের মতো সূত্রধরদের একটা বিরাট অংশ বৈষ্ণব ধর্মের অনুসারী, কিন্তু তাদের অনেকেই শক্তিদেবতারও উপাসনা করে। বিশ্বকর্মা তাদের একজন রক্ষক দেবতা। তাঁর উদ্দেশে ভাদ্র এবং মাঘী পঞ্চমীর শেষ দিনে বলি উৎসর্গ করা হয়। হিন্দু প্রথানুযায়ী ব্রাহ্মণরা শূদ্রদের স্পর্শ করতে পারে না এবং তারা নীচু জাতের বিধায় তাদের হাতে ছোঁয়া পানি পর্যন্ত স্পর্শ করে না। ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে এ পেশার একটা বড় অংশ মুসলমানদের হাতে চলে আসে এবং এ পেশা তার মূল চরিত্র হারাতে বসে। মুসলিম সুতাররা কাঠমিস্ত্রি নামে সুপরিচিত। তারা কাজের সন্ধানে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ায় এবং মৌসুমি কাজের সুযোগে বিভিন্ন সময় দেশের বিভিন্ন এলাকায় গমন করে। সন্নিহিত বনাঞ্চলের কারণে পার্বত্য জেলাগুলি তাদেরকে অধিকমাত্রায় আকৃষ্ট করে।
কাঠের আসবাবপত্র নির্মাণ কারখানার উন্নয়ন ঘটার সাথে সাথে সুতারের জীবনযাত্রায় একটা আমূল পরিবর্তন ঘটেছে এবং তাদের কাজের গতিপ্রকৃতি বদলে গেছে। অনেক সুতার আধুনিক যন্ত্রপাতি দ্বারা সজ্জিত হয়ে বর্তমানে শহরের আসবাবপত্র নির্মাণাগারে ও ব্যবসা-বাণিজ্যে নিজেদের নিয়োজিত করছে। কিছু কিছু সুতার দারুণ অভিজ্ঞ এবং দক্ষতাসম্পন্ন। তারা আকর্ষণীয় অঙ্কের অর্থ উপার্জন করছে, কিন্তু অধিকাংশ সুতার এই পেশায় শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করছে এবং কষ্টকর শহুরে জীবনযাপন করছে
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের বহু দেশের বাজারে বাংলাদেশের কাঠমিস্ত্রিদের দক্ষতা সুবিদিত এবং এ কারণে অনেক সূত্রধর সেসব দেশে চাকরির সুবিধা ভোগ করছে। [গোফরান ফারুকী]
আরও দেখুন করাতি।