সুপ্রিম কোর্ট
সুপ্রিম কোর্ট শুধু কলকাতা শহর ও কোম্পানি কর্তুক পরিচালিত কুঠিগুলির জন্য প্রতিষ্ঠিত একটি বিচারিক আদালত। রেগুলেটিং অ্যাক্ট-এর অধীনে প্রতিষ্ঠিত হয় ১৭৭৩ সালে। বিচার প্রশাসন সম্পর্কিত সুপ্রিম কোর্ট যা সাধারণভাবে সুপ্রিম কোর্ট বা কলকাতা সুপ্রিম কোর্ট হিসেবে পরিচিত হয়। আরো অতিরিক্তকিছু ব্যবস্থাসহ সুপ্রিম কোর্ট প্রাক্তন মেয়র’স্ কোর্টের স্থলাভিষিক্ত হয়। একজন প্রধান বিচারক ও অন্ততঃপক্ষে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যারিস্টারদের মধ্য থেকে রাজা কর্তৃক নিয়োগ প্রাপ্ত তিনজন সহযোগী বিচারক নিয়ে কোর্টটি গঠিত ছিল। ইংল্যান্ডের কিংস বেঞ্চের মতোই এ বিচারকদের কর্তৃত্ব ছিল। সুপ্রিম কোর্টে অ্যাটর্নি এবং অ্যাডভোকেটদের অন্তর্ভুক্তি তাদের হাতে ন্যস্ত ছিল। প্রধান বিচারকদের বার্ষিক বেতন ৮০০০ পাউন্ড স্টার্লিং নির্ধারিত ছিল এবং প্রত্যেক সহযোগী বিচারকের বার্ষিক বেতন ছিল ৬০০০ পাউন্ড স্টার্লিং। সে সময়ের কোম্পানি কর্মচারীদের মতো বাণিজ্যিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ এবং উপঢৌকন গ্রহণ করা তাদের জন্য সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। ইংরেজ কোর্ট অব চ্যান্সরির মতো সুপ্রিম কোর্টের দায়িত্ব ছিল কোর্ট অব ইক্যুয়িটি বা ন্যায় বিচারের নিরপেক্ষ কোর্ট হিসেবে কাজ করা।
সুপ্রিম কোর্ট কলকাতা এবং অধীনস্থ ফ্যাক্টরির জন্য ওয়ের (Oyer) ও টারমিনার (Terminer) ছিল। এছাড়া সুপ্রিম কোর্টের কারাদন্ড প্রদানের এখতিয়ারও ছিল। একটি উচ্চ আদালত হিসেবে এটি কোর্ট অব রিকোয়েস্ট, কোর্ট অব কোয়ার্টার সেশনস এবং আদালতের মেজিস্ট্রেটদের তত্ত্বাবধান করার আইনগত অধিকারী ছিল। বাংলা, বিহার এবং উড়িষ্যার কোর্ট অব অ্যাডমিরলটি হিসাবে সুপ্রিম কোর্ট এর আওতাধীন গভীর সমুদ্রে সংঘটিত ষড়যন্ত্র, হত্যা, দস্যুতা ইত্যাদির শাস্তি প্রদান করতে পারত। বাংলা, বিহার এবং উড়িষ্যায় বসবাসরত সকল ব্রিটিশ নাগরিক এ কোর্টের আওতাধীন ছিল। কিন্তু রেগুলেটিং অ্যাক্ট এবং রাজকীয় সনদ (Royal Charter) সুপ্রিম কোর্টের এখতিয়ার সম্পর্কে যে ব্যাখ্যা প্রদান করে তা ছিল বেশ অস্পষ্ট। ফলে সুপ্রিম কোর্ট কাজ শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই এর অতিরিক্ত এখতিয়ারের দাবি সম্পর্কে সমালোচনা হয়। নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে ইউরোপীয়গণ প্রায়শই এ কোর্টকে ব্যবহার করত। এ ক্ষেত্রে বহুল আলোচিত মহারাজা নন্দ কুমারের আইনি হত্যার বিষয়টি উল্লেখ করা যায়। রেগুলেটিং অ্যাক্ট স্থানীয়দের এ কোর্টের আওতার বাইরে রাখলেও অনেক জমিদারের বিচার এর মাধ্যমে করা হয়। রাজস্ব বকেয়ার বিষয়টি কোম্পানি কখনও কখনও ঋণগ্রস্ততা বলে গণ্য করে। ইউরোপীয় এবং স্থানীয়দের মধ্যে ঋণ সম্পর্কিত বিতর্কিত বিষয় সুপ্রিম কোর্টের আওতাধীন ছিল বলে জমিদারগণের রাজস্ব বকেয়াকে অনেক সময় ঋণ হিসেবে ধরা হতো। কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাসরত স্থানীয়দেরকে সুপ্রিম কোর্টের আওতাধীন করা হয়। কিন্তু কলকাতাবাসী নয় এমন বাঙালিদের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট বিচার পরিচালনা করেছে এমন ঘটনার দৃষ্টান্তও দুর্লভ নয়।
সুপ্রিম কোর্ট এবং গভর্নর জেনারেলের বিরোধ সমসাময়িকদের মাঝে একটি সাধারণ আলোচিত বিষয় ছিল। রেগুলেটিং অ্যাক্ট গভর্নর জেনারেল এবং কাউন্সিলকে বিভিন্ন আইন, অর্ডিন্যান্স এবং নীতিসমূহ প্রণয়নের ক্ষমতা প্রদান করে। ফোর্ট উইলিয়মের বেসামরিক প্রশাসন ও অধীনস্থ ফ্যাক্টরিসমূহে শৃংখলা আনয়ন করা এর উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু শুধু সুপ্রিম কোর্টে রেজিস্ট্রিকৃত আইনসমূহই সুপ্রিম কোর্ট আমলে নিতে পারত। ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যে প্রচলিত আইনসমূহের বিরোধী কোন আইন যাতে গভর্নর জেনারেল প্রণয়ন করতে না পারেন সে দিকে সুপ্রিম কোর্ট দৃষ্টি দিত। আইন প্রণয়নে যেকোন ধরনের বিশ্বাসভঙ্গতার জন্য জরিমানা ও সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের কাছে ন্যস্ত ছিল। আইন প্রণয়ন ও প্রশাসন সম্পর্কিত বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট এবং গভর্নর জেনারেল ইন কাউন্সিলের বিরোধ একটি নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপ এবং অতিরিক্ত অভিভাবকত্বের বিষয়ে কোম্পানি প্রশাসন সব সময়ই সমালোচনামুখর ছিল। অন্যদিকে কোম্পানি প্রশাসনের সমালোচকরা যেমন, মুক্ত ব্যবসায়ী ও ধর্ম প্রচারকগণ সুপ্রিম কোর্টের তৎপরতাকে আবশ্যকীয় বলে প্রশংসা করে। নিজ মাতৃভূমির আইনের শাসন থেকে অনেক দূরে অবস্থান করেও সুপ্রিম কোর্টের মাধ্যমে একটি বণিক নিয়ন্ত্রিত প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়টি এ ক্ষেত্রে তাদের প্রশংসা অর্জন করে।
কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের অনেক কর্মকান্ড বিতর্ক সৃষ্টি করলেও এটি কোম্পানি শাসনের শেষ সময় পর্যন্ত বহাল ছিল। ১৮৫৮ সালে কোম্পানি বিলুপ্ত করা হলে কলকাতা সুপ্রিম কোর্ট তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলে। সুতরাং ১৮৬১ সালের ভারতীয় হাইকোর্ট অ্যাক্টের মাধ্যমে এর বিলুপ্তি ঘটে। এ আইন গভর্নর জেনারেল ইন কাউন্সিলকে সুপ্রিম কোর্টের পরিবর্তে কলকাতা, মাদ্রাজ এবং বোম্বেতে হাইকোর্ট স্থাপনের কর্তৃত্ব প্রদান করে। ১৮৬৫ সালে এ হাইকোর্টসমূহ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আনুষ্ঠানিকভাবে সুপ্রিম কোর্টের বিলুপ্তি ঘটে। [সিরাজুল ইসলাম]