সাতগম্বুজ মসজিদ
সাতগম্বুজ মসজিদ ঢাকা শহরের মোহাম্মদপুর এলাকায় অবস্থিত। সাতগম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটির তিনটি গম্বুজ মূল নামায কক্ষের উপর এবং বাকি চারটি চার কোণের টাওয়ারের উপর স্থাপিত। আর এ কারণেই এটি সাতগম্বুজ মসজিদ নামে পরিচিত।
২৬.৮২ মি × ২৫.৬০ মি পরিমাপের সামান্য উঁচু পাকা একটি ভিতের পশ্চিম অংশ জুড়ে মসজিদটি স্থাপিত। এই ভিত্তিটি নিচু একটি প্রাচীর দ্বারা ঘেরা এবং পূর্ব প্রাচীরের মাঝ বরাবর একটি প্রবেশপথ রয়েছে। পাশের অলঙ্কৃত ছোট মিনারসহ (turrets) এই খিলানপথটি মসজিদের কেন্দ্রীয় প্রবেশপথ বরাবর অবস্থিত। উত্তর ও দক্ষিণ উভয় দিক থেকে প্রবেশপথটির সাথে সংযুক্ত হয়েছে সিঁড়ি।
আয়তাকার মসজিদটির ভেতরদিকের পরিমাপ ১৪.৩৩ মি × ৪.৮৮ মি। কোণের অষ্টভুজী বুরুজগুলির উপর স্থাপিত ফাঁপা গম্বুজ মসজিদটিকে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করে তুলেছে। নামায কক্ষে প্রবেশের জন্য রয়েছে খিলানপথ - তিনটি পূর্ব দেওয়ালে এবং উত্তর ও দক্ষিণ দেওয়ালে একটি করে। পূর্ব দেওয়ালের খিলানপথ বরাবর পশ্চিম দেওয়ালে রয়েছে তিনটি অর্ধ-অষ্টভুজাকার মিহরাব কুলুঙ্গি। কেন্দ্রীয় মিহরাবের পাশে তিনধাপ বিশিষ্ট পাকা মিম্বার রয়েছে। কেন্দ্রীয় মিহরাব ও খিলানপথ এবং উত্তর ও দক্ষিণ দেওয়ালের খিলানপথগুলি সম্মুখভাগে অভিক্ষিপ্ত ফ্রন্টনের মাঝে ন্যস্ত। ফ্রন্টনগুলি পাশে অলঙ্কৃত ছোট মিনার সমৃদ্ধ।
মসজিদ অভ্যন্তর প্রশস্ত দুটি খিলান দ্বারা তিন ভাগে বিভক্ত। মাঝের ‘বে’ টি বর্গাকার এবং পার্শ্ববর্তী আয়তাকার ‘বে’ দুটি অপেক্ষা বড়। মসজিদের ছাদ অষ্টভুজাকার ড্রামের উপর স্থাপিত সামান্য কন্দাকার তিনটি গম্বুজ দ্বারা আচ্ছাদিত। গম্বুজগুলির মধ্যে মাঝেরটি পার্শ্ববর্তী গম্বুজ দুটি অপেক্ষা বড়। প্রশস্ত দুটি খিলান এবং কেন্দ্রীয় মিহরাব ও খিলানপথের উপর স্থাপিত বদ্ধ খিলান এবং এদের কোণের ত্রিকোণাকার পেন্ডেন্টিভের উপর কেন্দ্রীয় গম্বুজটি স্থাপিত। তবে পাশের আয়তাকার স্থানের উপর গম্বুজ স্থাপনে চাতুর্যময় কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। গম্বুজের বক্রাকার ভিত্তি নির্মাণের জন্য পূর্ব ও পশ্চিম দেওয়ালে অর্ধ-গম্বুজ ভল্ট তৈরি করে প্রথমে আয়তাকার স্থানটিকে বর্গাকারে রূপান্তর করা হয়েছে। এই অর্ধ-গম্বুজ ভল্টগুলির সাথে কোণের সারিবদ্ধ পেন্ডেন্টিভের উপর ছোট গম্বুজগুলির ভার ন্যস্ত করা হয়েছে।
ঢাকার খাজা শাহবাজ মসজিদ ও মুসা খান মসজিদের ন্যায় এ মসজিদের কর্ণার টাওয়ারগুলিতে ছোট মিনার (turrets) বিদ্যমান। দ্বিতল বুরুজগুলি নিজেরাই এক একটি স্বতন্ত্র ভবনের মতো। নিচের তলায় উত্তর-দক্ষিণ এবং পূর্ব-পশ্চিম অক্ষে চারটি খিলানপথ রয়েছে। নিচতলার ছাদটি অভ্যন্তরভাগে গম্বুজাকার হলেও এর উপরের অংশ, অর্থাৎ দ্বিতীয় তলার মেঝেটি সমতল। বিস্তৃত পদ্মচূড়া শোভিত গম্বুজ দ্বারা আচ্ছাদিত দ্বিতীয় তলাটি সামান্য পার্থক্যসহ একেবারেই নিচতলার মতো। নিচতলার মতো চার দিকে চারটি খিলানপথ থাকলেও ছাদের দিকে আর একটি বাড়তি প্রবেশপথ রয়েছে। এই পথ দিয়ে মসজিদের ছাদ থেকে মিনারের উপরের তলে প্রবেশ করা যায়।
মসজিদের অনুভূমিক প্যারাপেট এবং গম্বুজের ড্রাম সারিবদ্ধ মেরলোন নকশায় শোভিত। পূর্ব ফাসাদ প্রচলিত মুগল রীতির প্যানেল দ্বারা সজ্জিত। মিহরাবগুলির সম্মুখভাগ মনোরমভাবে খাঁজকাটা। কেন্দ্রীয় মিহরাবকে বেষ্টনকারী আয়তাকার ফ্রেমটির উপরের দিকে রয়েছে বদ্ধ শিখরসদৃশ ফ্রিজ। সবগুলি গম্বুজের চূড়াই কলস ও পদ্ম শীর্ষ সম্বলিত এবং এদের অভ্যন্তরভাগের ভিত্তি পত্র নকশায় সজ্জিত। কেন্দ্রীয় গম্বুজের শীর্ষে রয়েছে পাঁচ স্তর বিশিষ্ট অলঙ্কৃত বিশাল মেডালিয়ন। উত্তর ভারতে অবস্থিত মুগল রীতির অন্যান্য নমুনার মতো মসজিদটির কোন প্রাচীর জাঁকজমকপূর্ণভাবে অলঙ্কৃত নয়, তবে তারপরও মসজিদটি তার বিভিন্ন অংশের জৌলুসময় সুবিন্যস্ততার জন্য আকর্ষণীয়।
মসজিদের শিলালিপিটি বর্তমানে অনুপস্থিত, তাই এটি নির্মাণের সঠিক সময় জানা যায় না। তবে গম্বুজ আচ্ছাদিত ফাঁপা ও বিশালাকার কর্ণার টাওয়ার ব্যতীত এর প্ল্যান ও অন্যান্য নির্মাণ শৈলী বিবেচনা করে মসজিদটিকে সতেরো শতকের শেষ দিকের ঢাকার বিভিন্ন মসজিদ, যেমন- লালবাগ দুর্গ মসজিদ (আনু. ১৬৭৮-৭৯) এবং খাজা আম্বর মসজিদের (১৬৮০) সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ বলে প্রতীয়মান হয়। শৈলীগত দিক বিবেচনা করলে মসজিদটির নির্মাণকাল ১৬৮০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময় বলে মনে হয়। [এম.এ বারি]