সরকারি নীতি
সরকারি নীতি (Public Policy) রাষ্ট্রের বৈধ সরকারি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত জনস্বার্থ সম্পৃক্ত নীতিমালা। এই নীতিমালা প্রণয়নে বাংলাদেশের সংবিধান মূল নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করে। নীতিগুলির মধ্যে রয়েছে জাতীয় উন্নয়নের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং কৌশল নির্ধারণের বিষয়। সংবিধানে বর্ণিত রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়ন সংক্রান্ত মূল আদর্শ জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে। সংবিধান রাষ্ট্রের নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে পরিকল্পিত প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে উৎপাদিকা শক্তির অব্যাহত বিকাশ এবং জনগণকে পূর্ণোদ্যমে কাজ করার এবং যুক্তিযুক্ত বিশ্রাম/বিনোদন ও অবসর লাভের সুবিধা এবং অন্যান্য সুবিধা প্রদানপূর্বক তাদের বৈষয়িক ও সাংস্কৃতিক জীবনমানের উত্তরোত্তর উন্নয়ন সাধনের দায়িত্ব রাষ্ট্রের উপর অর্পণ করেছে (অনুচ্ছেদ ১৫)।
সংবিধানের ৮ থেকে ২৫ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রীয় নীতির মূল আদর্শ বর্ণিত হয়েছে। এগুলোর আলোকেই সরকারি নীতিমালার রূপরেখা তৈরি হয়। এসব অনুচ্ছেদের মধ্যে যেগুলো সরকারি নীতিমালার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত সেগুলোর মধ্যে রয়েছে: (১) সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস (অনু. ৮); (২) স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের উন্নয়ন (অনু. ৯); (৩) জাতীয় জীবনে মহিলাদের অংশগ্রহণ (অনু. ১০); (৪) মালিকানা সংক্রান্ত নীতিমালা (অনু. ১৩); (৫) কৃষক ও শ্রমিকের মুক্তি (অনু. ১৪); (৬) মৌলিক চাহিদার সংস্থান (অনু. ১৫); (৭) পল্লী উন্নয়ন এবং কৃষি বিপ্লব (অনু. ১৬); (৮) বাধ্যতামূলক অবৈতনিক শিক্ষা (অনু. ১৭) এবং (৯) নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ (অনু. ২২)। বাংলাদেশে সরকারি নীতি প্রণয়ন পর্যায়ে সাংগঠনিক কর্মকান্ডের বিস্তারিত বিবরণ নিম্নে প্রদত্ত হলো:
মন্ত্রিপরিষদ রাষ্ট্রীয় নীতিভিত্তিক প্রশাসন পরিচালনায় দিকনির্দেশনা দানের জন্য নিয়োজিত শীর্ষ মন্ত্রীদের সমন্বয়ে মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হয়। ১৯৯৬ সালের কার্যপ্রণালী বিধিমালার ৪ (খ) ধারা অনুযায়ী মন্ত্রিপরিষদের অনুমোদন ব্যতীত নীতি সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্তই গৃহীত হতে পারে না। বিশেষত, সরকারি নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত যেসব বিষয় মন্ত্রিপরিষদ কর্তৃক নিষ্পন্ন হতে হবে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে: (ক) অধ্যাদেশ জারিসহ আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত বিষয়; (খ) গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক নীতি সম্পর্কিত বিষয়; (গ) কোনো বিদ্যমান নীতি অথবা মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্তের পরিবর্তন সংক্রান্ত প্রস্তাব। নির্বাচিত নীতি বিভিন্ন মন্ত্রিপরিষদ কমিটির মাধ্যমে মূল্যায়ন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য মন্ত্রিপরিষদের নিজস্ব কমিটি রয়েছে। এজাতীয় কমিটির মধ্যে আছে: (১) খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিবীক্ষণ কমিটি; (২) প্রশাসনিক সংস্কার বিষয়ক কমিটি; (৩) জাতীয় পুরস্কার প্রদান কমিটি; (৪) সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত কমিটি; (৫) বেতনকাঠামো নির্ধারণ কমিটি; (৬) বিদেশে নিয়োগদান সংক্রান্ত কমিটি; (৭) জরুরি ও জাতীয় স্বার্থ সংক্রান্ত কমিটি; (৮) অর্থ ও অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত কমিটি; (৯) বৈদেশিক বিষয় সংক্রান্ত কমিটি; এবং (১০) আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত কমিটি।
মন্ত্রণালয় স্বতন্ত্র ও নির্দিষ্ট পরিমন্ডলে সরকারি কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য গঠিত একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রশাসনিক ইউনিট। মন্ত্রণালয়ের নীতি সংক্রান্ত বিষয়াবলি এবং এগুলো বাস্তবায়নের দায়িত্ব মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর উপরই ন্যস্ত। জাতীয় সংসদে মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কর্মকান্ড পরিচালনার দায়িত্বভারও মন্ত্রীর উপর ন্যস্ত। সচিবপদে অধিষ্ঠিত শীর্ষস্থানীয় একজন আমলা মন্ত্রণালয়ের দাপ্তরিক প্রধান। মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন এবং যাবতীয় কর্মকান্ড সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য তিনিই দায়ী থাকেন। তিনি মন্ত্রণালয় সংযুক্ত অধিদপ্তর ও অধীনস্থ অফিসসমূহের মুখ্য অর্থ কর্মকর্তাও। তিনি মন্ত্রণালয়ের সকল কর্মকান্ড সম্পর্কে মন্ত্রীকে অবহিত রাখেন। ১৯৯৬ সালের কার্যপ্রণালী বিধিমালার ৪(ঝ) ধারা অনুযায়ী মন্ত্রণালয়ের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে: (১) নীতি প্রণয়ন; (২) পরিকল্পনা প্রণয়ন; (৩) পরিকল্পনা মূল্যায়ন ও বাস্তবায়ন; (৪) আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ; (৫) মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীকে সংসদে তাঁর দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সহযোগিতা প্রদান; (৬) শীর্ষ পর্যায়ে কর্মকর্তাদের চাকুরি সংক্রান্ত বিষয়ের ব্যবস্থাপনা এবং (৭) প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক সময়ে সময়ে প্রদত্ত দায়িত্ব পালন।
বিশেষত অর্থ মন্ত্রণালয় এবং আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সরকারি নীতি প্রণয়ন এবং অনুমোদন প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। কার্যপ্রণালী বিধিমালার ১৩(৪) ধারায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, যেকোন বিষয়ে উদ্ভূত সকল অর্থনৈতিক বা আর্থিক প্রশ্ন সম্পর্কে, বিশেষত (ক) আমদানি ও রপ্তানি নীতি প্রণয়ন; (খ) বাণিজ্য ও বিনিময় চুক্তি সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনা; (গ) ট্যারিফনীতি নির্ধারণ; (ঘ) মূল্যনীতি নির্ধারণ; (ঙ) বিনিয়োগনীতি নির্ধারণ এবং (চ) শ্রমনীতি নির্ধারণের ব্যাপারে অবশ্যই অর্থমন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। অনুরূপভাবে, (ক) আইন প্রণয়ন সম্পর্কিত সকল প্রস্তাব; (খ) যেকোন বিষয়ে উদ্ভূত আইনী প্রশ্ন; (গ) কোনো ধরনের চুক্তি ও আন্তর্জাতিক চুক্তি প্রণয়ন, আন্তর্জাতিক সম্মেলন আহবান ও আন্তর্জাতিক আইনের সংশোধন; (ঘ) যেকোন আইনের ব্যাখ্যা প্রদান এবং (ঙ) কোনো বিধি, প্রবিধান অথবা উপবিধি অনুমোদন অথবা জারির পূর্বে আইন মন্ত্রণালয়ের সাথে পরামর্শ করতে হবে।
সচিব কমিটি মন্ত্রিপরিষদ কমিটির আরও দুটি অতিরিক্ত স্থায়ী কমিটি আছে, যথা সচিব কমিটি এবং প্রশাসনিক উন্নয়ন বিষয়ক সচিব কমিটি। এগুলো বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের নিয়ে গঠিত। এগুলোর কাজ হচ্ছে প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন এবং সরকারের নীতি সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট বিষয়াদির উপর নজর রাখা।
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ প্রধান প্রধান অর্থনৈতিক নীতি ও উন্নয়নকৌশলের অনুমোদন দানের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ। এ পরিষদ নিজ ক্ষমতাবলে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার জন্য জাতীয় নীতি প্রণয়ন ও লক্ষ্য নির্ধারণ করে। এ পরিষদ কর্তৃক নির্ধারিত লক্ষ্য ও অগ্রাধিকার-তালিকা অনুসরণ করেই মন্ত্রণালয়সমূহকে তাদের নীতি, পরিকল্পনা এবং কর্মসূচি গ্রহণ করতে হয়। মন্ত্রিপরিষদভুক্ত সকল মন্ত্রীকে নিয়ে এ পরিষদ গঠিত এবং প্রধানমন্ত্রী এর সভাপতি। পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যবৃন্দ এবং মন্ত্রণালয়/বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত সচিবগণ পরিষদের সভায় উপস্থিত থাকেন। এর বাইরেও যারা উপস্থিত থাকেন তাদের মধ্যে রয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। পরিকল্পনা কমিশনের দায়িত্ব হচ্ছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদকে সব ধরনের সাচিবিক সহায়তা দান করা।
পরিকল্পনা কমিশন পরিকল্পনা প্রণয়নের কেন্দ্রীয় সংস্থা। এটি বিভিন্ন পেশাজীবী ব্যক্তি এবং সামষ্টিক ও ব্যষ্টিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও নীতি প্রণয়নে নিয়োজিত বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত। কার্যত এটি ক্ষমতাসীন দলের আদর্শ, আকাঙ্ক্ষা ও অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করে এবং এর কাজ হচ্ছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্দেশ অনুযায়ী জাতীয় পরিকল্পনা এবং কর্মসূচি, বিশেষত পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি তৈরি করা। এটি সামষ্টিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের ব্যাখ্যা প্রদানপূর্বক বিভিন্ন কালপর্বে সেক্টর পর্যায়ের কাজের উৎপাদন-লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। যদিও পরিকল্পনা প্রণয়ন থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত সমগ্র দায়িত্ব প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়/বিভাগসমূহ এবং পরিকল্পনা কমিশন তুল্যাংশে পালন করে থাকে, পরিকল্পনাপ্রক্রিয়া কার্যত শুরু হয় কমিশন কর্তৃক আর্থিক প্রবণতা স্পষ্টভাবে বর্ণনা এবং বিকল্প সম্ভাবনা চিহ্নিতকরণের মাধ্যমে, যা পরিকল্পনার কারিগরি কাঠামো প্রণয়নের নির্দেশনা প্রদান করে। মন্ত্রণালয়সমূহ এবং এজেন্সিগুলো তথ্যসূত্র হিসেবে পরোক্ষভাবে এই কারিগরি কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করে। পরিকল্পনা কমিশন অর্থবিভাগ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সঙ্গে আলোচনাক্রমে প্রকল্পসমূহের বিস্তারিত আর্থিক ও কারিগরি মূল্যায়ন করে এবং এগুলো বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদের সংস্থান করে।
সংসদীয় কমিটি সংবিধানের ৭৬ অনুচ্ছেদে সংসদ-সদস্যদের নিয়ে কতিপয় স্থায়ী কমিটি গঠনের বিধান রয়েছে। যেমন সরকারি অর্থ বিষয়ক কমিটি, সুযোগ-সুবিধা সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি এবং সংসদীয় কার্যপ্রণালী বিধির প্রয়োজনে গঠিত অনুরূপ অন্যান্য স্থায়ী কমিটি। এছাড়াও প্রয়োজনবোধে সংসদ আরও কিছু স্থায়ী কমিটি গঠন করতে পারে। এরূপ কমিটির কাজ হচ্ছে আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত প্রস্তাবসমূহ পরীক্ষা করা, আইন বলবৎ করার বিষয় পুনর্বিবেচনা করা অথবা কোনো মন্ত্রণালয়ের কর্মকান্ড বা প্রশাসন বিষয়ে অথবা জনগুরুত্বপূর্ণ যেকোন বিষয়ে তদন্ত করা অথবা খোঁজ-খবর নেয়া।
বৈদেশিক দাতাগোষ্ঠী বৈদেশিক সাহায্যদাতা বা দাতাসংস্থা বাংলাদেশের পরিকল্পনা/প্রকল্পসমূহ প্রণয়ন এবং এসবের ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দুই ধরনের দাতা রয়েছে: দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক। দ্বিপাক্ষিক দাতাদের মধ্যে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ডেনমার্ক, জার্মানি, ফ্রান্স, ভারত, জাপান, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড, সুইডেন, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি। অন্যদিকে বহুপাক্ষিক দাতাদের মধ্যে রয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য গঠিত অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশন, খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি এজেন্সি, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, জাতিসংঘ শিশু তহবিল, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংগঠন, বিশ্ব ব্যাংক, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন। বাংলাদেশের উন্নয়নব্যয়ের গড়ে ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশই বিদেশী দাতা সংস্থাসমূহের অর্থানুকূল্যে পাওয়া যায়। দাতারা বিভিন্ন নীতি প্রণয়ন, পরিবর্তন ও সংশোধনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। তাছাড়া নীতিসমূহ বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনার ক্ষেত্রেও তাদের ভূমিকা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বহুপাক্ষিক দাতাদের মধ্যে বিশ্ব ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল শীর্ষস্থানীয়। এরা নীতিসমূহের বিভিন্ন পরিবর্তন ও সংস্কারের জন্য যথেষ্ট চাপ প্রয়োগ ও প্রভাব বিস্তার করে থাকে। [সালাহউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান]