সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুমদখল
সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুমদখল রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে জমি বা অন্য কোনো বেসরকারি সম্পত্তি অধিগ্রহণের ব্যবস্থা। অধিকাংশ প্রাচীন ধর্মগ্রন্থেই সম্পত্তি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ সম্পর্কিত বিধিবিধানের উল্লেখ আছে। জমি অধিগ্রহণের ব্যাপ্তি নির্ভর করে রাষ্ট্রের ভূমিকার ওপর। সাধারণ অর্থনীতি ও সমাজ-সংস্কৃতিতে রাষ্ট্রের ভূমিকা ব্যাপক হলে হুকুম দখলের ব্যাপ্তিও বিস্তৃত হতে বাধ্য। যে রাষ্ট্রে ব্যক্তি মালিকানা নেই বা ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পত্তির পরিমাণ কম, সেখানে সম্পত্তি অধিগ্রহণের প্রয়োজনও সীমিত।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রে প্রাথমিক পর্যায়েই রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে জমি অধিগ্রহণ করতে দেখা যায়। সরকারি অফিস-আদালত, রেলওয়ে ও সড়ক নির্মাণ প্রভৃতি কাজে জমি অধিগ্রহণ ও হুকুমদখল করা হয়েছে। তবে ওই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে বিশেষ আইন ও আদেশের মাধ্যমে। ১৮৯৪ সালে সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুমদখলের প্রথম আইন দি ল্যান্ড একুইজিশন অ্যাক্ট, ১৮৯৪ প্রণীত হয়।
১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সরকারি অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল ও রেলস্টেশন নির্মাণের বিভিন্ন কাজে প্রচুর ভূমির প্রয়োজন দেখা দেয়। তাছাড়া উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিদ্যমান আইন সংশোধনসহ পর্যায়ক্রমে কয়েকটি নতুন আইন প্রণীত হয়। যেমন, দি ইমার্জেন্সী রিকুইজিশন প্রোপার্টি অ্যাক্ট ১৯৪৮, দি সিভিল ডিফেন্স অ্যাক্ট, দি রিহ্যাবিলিটেশন অ্যাক্ট, ১৯৫৬। পুনর্বাসন আইনের অধীনে সরকার ব্যক্তিমালিকানাধীন বিভিন্ন ইমারত, পরিত্যক্ত বাড়ি এবং ভূসম্পত্তি অধিগ্রহণের আওতায় আনে। হুকুমদখল ও অধিগ্রহণ সংক্রান্ত আরও যে সকল আইন, বিধিমালা, অধ্যাদেশ ও প্রবিধান জারি করা হয়েছিল তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দি মিউনিসিপ্যাল কমিটি (প্রোপার্টি) রুল্স, ১৯৬০; দি ইউনিয়ন কাউন্সিল (প্রোপার্টি) রুল্স, ১৯৬০; দি বাংলাদেশ এগ্রিকালচারাল ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন অর্ডিন্যান্স, ১৯৬১; দি একুইজিশন অফ ওয়েষ্ট ল্যান্ড অ্যাক্ট, ১৯৫০; দি চিটাগাং হিল ট্র্যাক্টস (ল্যান্ড একুইজিশন) রেগুলেশন, ১৯৫৮; দি ক্যান্টনমেন্ট (রিকুইজিশন অব ইমুভেবল প্রোপার্টি) অর্ডিন্যান্স, ১৯৪৮।
১৯৮২ সালের স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুমদখল অধ্যাদেশের মাধ্যমে সম্পত্তির নতুন সংজ্ঞা দেওয়া হয়। এ সংজ্ঞায় সম্পত্তি ও সম্পত্তির উপর যেকোন স্থাপনা বা অধিকারকে বোঝানো হয়। ধর্মীয় উপাসনালয়, কবরস্থান ও শ্মশানভূমি, এতিমখানা, হাসপাতাল, গণগ্রন্থাগার অধিগ্রহণ বা হুকুম দখল করা নিষিদ্ধ।
হুকুমদখলের পদ্ধতি কোনো সংস্থা কোনো ভূমি বা অস্থাবর সম্পত্তি দখলের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলে ওই সংস্থাকে সর্বপ্রথম সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ভূমি মন্ত্রণালয়ে নির্দিষ্ট ভূমি বা অস্থাবর সম্পত্তি হুকুমদখল করে হস্তান্তরের জন্য লিখিত আবেদন জানাতে হয়। এ আবেদনপত্রে উল্লিখিত সম্পত্তির সরকারি বা বেসরকারি প্রয়োজনীয়তা, উদ্দেশ্য, সম্পত্তির পরিমাণ, নক্সা এবং যে প্রয়োজনে ব্যবহার করা হতে পারে তার ব্যাখ্যা লিপিবদ্ধ করতে হয়। ভূমি মন্ত্রণালয় আবেদনটি পাওয়ার পর তা পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক বরাবরে প্রেরণ করে। জেলা প্রশাসক হুকুমদখলের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কার্যক্রম প্রস্ত্তত ও সম্পন্ন করার জন্য ক্ষমতা প্রদান করেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (ভূমি)। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক উক্ত হুকুমদখল সংক্রান্ত বিষয়টি সম্পত্তির মালিক বা মালিকগণ অথবা অপর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ ও অন্যান্য বিষয় সুরাহা করার জন্য নোটিশ প্রদান করেন এবং বিগত বারো মাসের গড় বাজার মূল্যের ওপর ভিত্তি করে ক্ষতিপূরণ প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
কোনো অস্থাবর সম্পত্তি সরকারি কাজে বা জনস্বার্থে স্বল্পকালীন সময়ের জন্য প্রয়োজন হলে জেলা প্রশাসক লিখিত আদেশ দ্বারা সে সম্পত্তি হুকুমদখল করতে পারেন। অস্থাবর সম্পত্তি হুকুমদখলের ক্ষেত্রেও বিধি দ্বারা নির্ধারিত ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হয় সম্পত্তির মালিক বা মালিকগণকে। অস্থাবর সম্পত্তি হুকুমদখলের ক্ষেত্রেও সরকারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। কোনো ব্যক্তি আদেশ লঙ্ঘন করলে বা লঙ্ঘনের চেষ্টা করলে অথবা আদেশ কার্যকর করার ক্ষেত্রে কোনো বাধা সৃষ্টি করলে তিনি তিন মাস পর্যন্ত কারাদন্ডে বা তিন হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ডে অথবা উভয়বিধ দন্ডে দন্ডিত হতে পারেন।
ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ স্থাবর সম্পত্তির ওপর যেসকল স্থাপনা, পাকা ইমারত, দরদালান, ঘর, গাছপালা, ফসলী জমির ফসল সবকিছুর ক্ষতিপূরণ নির্ধারিত হারে মালিককে প্রদান করতে হয়। নোটিস পাওয়ার পর কোনো ব্যক্তি ১৫ দিনের মধ্যে হুকুমদখলের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসকের নিকট লিখিত আপত্তি দাখিল করতে পারেন। আপত্তিকারীদের শুনানি গ্রহণ করেন জেলা প্রশাসক এবং শুনানির পর তিনি একটি রিপোর্ট তৈরি করেন।
রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে ব্যক্তিমালিকানাধীন স্থাবর-অস্থাবর যেকোন প্রকার সম্পত্তি হুকুমদখল বা অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে সম্পত্তির মালিকের সকল ওজর-আপত্তি আইনত অগ্রাহ্য। হুকুমদখল কার্যক্রমে কোনো বাধা প্রদান শাস্তিযোগ্য অপরাধ। হুকুমদখলের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে কোনো মামলা, ইনজাংশন বা রীট করা চলে না। তবে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের জন্য মালিক সালিসের আশ্রয় নিতে পারেন। বিজ্ঞপ্তি জারির তারিখ হতে ত্রিশ থেকে পয়তাল্লিশ দিনের মধ্যে সালিসের আবেদন করতে হয়। সাবজজ পদমর্যাদা বা ঊর্ধ্বতন বিচার বিভাগীয় কোনো কর্মকর্তাকে সরকার সালিস নিয়োগ করেন। সালিসের রোয়েদাদের বিরুদ্ধে সালিসি আপিল ট্রাইব্যুনালের নিকট আপিল করা যায়।
অস্থাবর সম্পত্তি হুকুমদখল (ক্ষতিপূরণ) বিধিমালা ১৯৯০-এর অধীনে হুকুমদখলকৃত কোনো স্থলযান বা জলযান অথবা বাস, ট্রাক, মিনিবাস ইত্যাদির ক্ষতিপূরণ নির্ধারণের জন্য প্রতি জেলায় ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ কমিটি নামে একটি কমিটি গঠনের বিধান রয়েছে। কোনো স্থলযান বা জলযান হুকুমদখলের সময়, তা কতদিন হুকুমদখলে রাখা হবে এবং কি উদ্দেশ্যে হুকুমদখল করা হবে, ক্ষতিপূরণের পরিমাণ উল্লেখসহ হুকুমনামায় তার স্পষ্ট উল্লেখ থাকতে হবে।
১৯৮৮ সালের বন্যার পটভূমিতে ১৯৮৯ সালের ৯নং আইন জারি করে সরকার ঢাকা শহরের জমি অধিগ্রহণ শুরু করে। ঢাকা শহরের পশ্চিমাঞ্চলে এ আইনের আওতায় মিরপুর-মোহাম্মদপুরে ঢাকা শহররক্ষা বাঁধ নির্মিত হয়। ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বর মাসে সরকার হুকুমদখল ও অধিগ্রহণ আইনের ক্ষতিপূরণ নির্ধারণের বিধানে সংশোধনী এনে এক বিধি জারি করে। এই বিধি অনুসারে জেলা প্রশাসক কর্তৃক নির্ধারিত ক্ষতিপূরণের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সালিসি মামলায় সালিসগণ শুধুমাত্র অতিরিক্ত দশ শতাংশ বৃদ্ধি করার আদেশ দিতে পারবেন এবং আপিল ট্রাইব্যুনালেও এই বর্ধিত দশ শতাংশের মধ্যে ক্ষতিপূরণের অর্থ সীমাবদ্ধ থাকবে। [সাহিদা বেগম]