সমুদ্রবন্দর

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৬:০০, ১৯ মার্চ ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

সমুদ্রবন্দর  জাহাজে পণ্যদ্রব্য ভরাট এবং খালাসের জন্য সমুদ্র তীরবর্তী স্থাপনা। পৃথিবীর ৮০% লোক সমুদ্র তীরবর্তী (১০০ মাইলের ভিতর) অঞ্চলে বসবাস করে। সমুদ্র তীরবর্তী দেশগুলির অর্থনীতির জন্য সমুদ্রবন্দরের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রাচীনকাল থেকে সমুদ্র তীরবর্তী দেশগুলিতে গড়ে উঠেছে সমুদ্রবন্দর। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর গুরুত্বপূর্ণ আমদানি-রপ্তানি অবকাঠামো। দেশের সিংহভাগ (৯০%) আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য সম্পাদিত হয় এ দু’বন্দরের মাধ্যমে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরকে দেশের লাইফ লাইন বলা হয়ে থাকে। এ বন্দরের মাধ্যমে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানির তিন-চতুর্থাংশ সম্পাদিত হয়। বাকিটুকু হয় মংলা ও কয়েকটি স্থল বন্দরের মাধ্যমে।

ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ এশিয়ার অন্য দেশগুলির কাছে গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গোপসাগর এ গুরুত্বকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। একটা সময় ছিল যখন চট্টগ্রাম বন্দরকে ব্যবহার করে আশেপাশের দেশের লোকজন তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করত। আশির দশকেও নেপালের ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে চট্টগ্রাম বন্দরকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ব্যবহার করত। পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর ক্রমাগতভাবে চাপ বেড়ে যাওয়া এবং একই সঙ্গে প্রাকৃতিকভাবে কর্ণফুলি নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় বন্দর ব্যবহারকারীদের আগ্রহ কমে যায়।

চট্টগ্রাম বন্দর  পতেঙ্গার কর্ণফুলি নদীর তীরে অবস্থিত বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর। চট্টগ্রাম বন্দর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে ১৮৮৭ সালে। চট্টগ্রাম বন্দর বিশ্বের একমাত্র প্রকৃতিগত বন্দর। নদীর কূলে জেটি নির্মাণ করে পণ্য ওঠানামা করা হয়। কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী এ বন্দর কেবল বাংলাদেশের নয়, বরং ভারত উপমহাদেশের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। কর্ণফুলী নদীর জোয়ারভাঁটার ওপর নির্ভর করেই চলে এ বন্দরের কর্মকান্ড। কর্ণফুলি চ্যানেলটি ৯.৫ নটিক্যাল মাইল দীর্ঘ ও ৫০০ মিটার প্রশস্ত। সর্বোচ্চ ৯.২ মিটার গভীর ও ১৮৮ মিটার দীর্ঘ জাহাজ এ চ্যানেলে চলাচল করতে পারে। বিশ্বের প্রায় সকল বন্দরে জেটি সুবিধা গ্রহণ করা হয়ে থাকে কৃত্রিমভাবে বেসিন তৈরির মাধ্যমে। এ বন্দর ০.৫ মিলিয়ন টন পণ্য ধারণক্ষমতা সম্পন্ন চারটি জেটি নিয়ে ১৯১০ সালে পূর্ণাঙ্গ বন্দর হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বর্তমানে বাংলাদেশের ৯০% আমদানি-রপ্তানি পণ্য এ বন্দরের মাধ্যমে ওঠানামা করে। চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমান জেটির সংখ্যা ১৬। এর মধ্যে ৬টি জেনারেল কার্গো বার্থ ও ১১টি কনটেইনার বার্থ। এ বন্দরটি ১৯৭৬ সালে প্রণীত অধ্যাদেশ অনুসারে পরিচালিত হচ্ছে।

চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার ব্যবহার কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৭৮ সাল থেকে। বর্তমানে এ বন্দরে প্রতিদিনই বাড়ছে কনটেইনারে পণ্য হ্যান্ডেলিংয়ের পরিমাণ। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে কার্গো আমদানি হয়েছে ২৬৭,১৮৮৩৪ মেট্রিক টন এবং রপ্তানি হয়েছে ৩৭,৬৩৭,৪৭ মেট্রিক টন। একই বছর কনটেইনার এসেছে ৫৫৭,৮৯১ TEUS। রপ্তানি হয়েছে সর্বমোট ৫,০৫,০৬৫ TEUS কনটেইনার। ২০০৮-০৯ সালে গড়ে জাহাজ আসা-যাওয়া করেছে ২০৮৮টি। ২০০৯-১০ সালে প্রতিমাসে গড়ে জাহাজ আসা-যাওয়া করেছে ২৫০টি। এছাড়াও ঢাকা ICD-এর মাধ্যমেও পৃথকভাবে পণ্য ওঠানামা হচ্ছে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানি পণ্য বৃদ্ধির হার গড়ে ১২-১৪%। কনটেইনারের মাধ্যমে পণ্য হ্যান্ডেলিং বাড়ার সথে সাথে চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার ওঠানামায় সংযোজিত হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তি। ২০০৬ সালের আগে এ বন্দরে গিয়ারসেল ছাড়া অন্য কোন আধুনিক জাহাজ আসতে পারত না। কারণ গিয়ার ছাড়া (জাহাজের নিজস্ব ক্রেন) জাহাজ থেকে পণ্য ওঠানামার কোন ব্যবস্থা ছিল না। ২০০৭ সালে ৪টি আধুনিক গ্যান্ট্রি ক্রেন সংযোজনের পর গিয়ারলেস জাহাজ আসতে থাকে। পাশাপাশি পণ্য হ্যান্ডলিংয়ে RTG (রাবার টায়ার্ড গ্যান্ট্রি) সংযোজন করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দরে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি বন্দর থেকে জাহাজ আসা-যাওয়া করে। এ বন্দরে জাহাজ আসতে হলে সংশ্লিষ্ট জাহাজ কর্তৃপক্ষকে প্রথমেই চট্টগ্রাম বন্দরে নিবন্ধিত শিপিং এজেন্ট নিয়োগ করতে হয়। শিপিং এজেন্টরাই চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজটি আসা-যাওয়ার ব্যাপারটি ঘোষণা করে। এ ঘোষণার পর জাহাজটির নাম বন্দরের বার্থিং লিস্টে উঠে আসে। এরপর বার্থিং মিটিংয়ে, শিপিং এজেন্টরা জাহাজ বর্থিংয়ের জন্য বন্দরকে প্রস্তাব দেয় এবং পর্যায়ক্রমে জাহাজের বার্থিংয়ের সময়ক্ষণ নির্ধারণ করা হয়। বন্দর বর্হিনোঙরে জাহাজ আসার পর বন্দরের নিজস্ব পাইলটরা জাহাজকে বন্দরের জেটিতে নিয়ে আসে এবং পুনরায় বর্হিনোঙর পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। এরপর জাহাজ বন্দরের নির্দিষ্ট জেটিতে ভেড়ার পর ট্রাফিক বিভাগের তত্ত্বাবধানে পণ্য ওঠানামা করে। এর সথে রয়েছে শুল্কায়নের জন্য কাস্টমসের কিছু আনুষ্ঠানিকতা। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট বন্দরের কর্ণফুলি চ্যানেল সচল রাখতে নিয়মিত ড্রেজিং করা জরুরি। ড্রেজিংয়ের জন্য নির্ধারিত স্পটগুলিকে কয়েকটি বারে বিভক্ত করা হয়েছে। ইনার বার, আউটার বার এবং গুপ্ত বার নামে পরিচিত বারগুলিতে নিয়মিত ড্রেজিং করা অত্যাবশ্যকীয়। ড্রেজিংয়ের জন্য ১৯৮৯ সালে ‘এমভি খনক’ নামের একটি জাহাজ সংগ্রহ করা হয়েছে।

বন্দর চ্যানেল সচল রাখতে সদরঘাট ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পে লাইটারেজ জেটি স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষের। ১৯৯০ সালে শাহ আমানত সেতু নির্মাণের পর, পলি জমে সদরঘাট জেটি অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি কর্ণফুলি নদীতে তৃতীয় সেতু নির্মাণের পর চ্যানেলের নাব্যতা দ্রুত কমতে দেখা গেছে। বন্দর চ্যানেলে এখন জাহাজ চলাচল করছে নাব্যতা সংকটের মধ্য দিয়ে।

চট্টগ্রাম বন্দরের ক্রমবর্ধমান উৎপাদনশীলতা ধরে রাখতে বর্তমানে বেশ কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের (ADB) সহায়তায় ‘চিটাগাং পোর্ট ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন প্রকল্প’, নারায়ণগঞ্জের পানগাঁওয়ে ইনল্যান্ড কনটেইনার টার্মিনাল (ICT) নির্মাণ, নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালের ৪ ও ৫ নম্বর জেটি বার্থ নির্মাণ, নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালের জন্য SOT ভিত্তিতে টার্মিনাল অপারেটর নিয়োগ, PMIS প্রকল্প (ইন্ট্রোডাকশন অব পারসোনাল ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম) এবং সদরঘাট ক্যাপিটাল ড্রেজিং। এছাড়াও রয়েছে ৮টি স্বল্পমেয়াদি, ৫টি মধ্যমেয়াদি ও ৫টি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে বিদ্যমান ১১, ১২ ও ১৩ নম্বর জেটির স্থলে কর্ণফুলি কনটেইনার টার্মিনাল (KCT) নির্মাণ, যুগোপযোগী মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন, ৩ ও ৪ নম্বর রিভারমুরিং-এর আধুনিকায়ন, বন্দর অভ্যন্তরে আরেকটি ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণ, এক্সওয়াই শেড নির্মাণ, আধুনিক হাসপাতাল নির্মাণ, বহুতল কারপার্কিং ভবন নির্মাণ। মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে VTSS সংযোজন, কর্ণফুলি নদীতে অভ্যন্তরীণ নৌযানের জন্য বার্থ নির্মাণ, উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন একটি টাগবোট সংগ্রহ, ৭ থেকে ১০ নম্বর জেটিতে মাল্টিপারপাস বার্থ নির্মাণ। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় রয়েছে বন্দরের অনতিদূরে পতেঙ্গায় কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ, সাত নম্বর খালের মাথায় একটি আধুনিক কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ, পোর্ট এক্সেস রোডে একটি ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণ, ইপিজেড ও বড়পোলে দ্বিমুখী বাইপাস সড়ক নির্মাণ, মেরিন ওয়ার্কশপ এলাকায় বিশেষায়িত শেড নির্মাণ।

মংলা বন্দর  ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। বঙ্গোপসাগর হতে ৭০ নটিক্যাল মাইল অভ্যন্তরে এবং খুলনা শহর থেকে ৪৮ কিমি দক্ষিণে এর অবস্থান। পশুর নদীর দীর্ঘ চ্যানেল (গড় গভীরতা ৬.৫ মিটার) দিয়ে মংলা বন্দরে জাহাজ চলাচল করে। এখানে ২০০ মিটার দীর্ঘ ও ৭ মিটার গভীর জাহাজ যাতায়াত করতে পারে। এ বন্দর দিয়ে পাট, চামড়া, তামাক, হিমায়িত মাছ প্রভৃতি রপ্তানি হয় এবং দেশের ৪০% খাদ্যসামগ্রী, সার, কয়লা, কাঠের মন্ড এবং রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানি করা হয়।

ভারত ও নেপালের সঙ্গে সরকারের সম্পাদিত চুক্তির ফলে মংলা সমুদ্রবন্দরকে ঘিরে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। ভারত, নেপাল ও ভুটানসহ এ অঞ্চলের দেশগুলিকে মংলা বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হলে, এ বন্দর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহৎ বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত হতে পারে। এ বিষয়টি মাথায় রেখে স্বয়ংক্রিয় বাতিঘর, আধুনিক টেলিকমিউনিকেশন ও সড়ক যোগাযোগ সুবিধা, বহুমুখী জেটি ও ICD ড্রেজিং, নৌপথের সুবিধাবৃদ্ধি এবং গভীর সমুদ্রে জাহাজ নোঙরের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। জাহাজ নোঙর করার সুবিধা চট্টগ্রামের চেয়ে সহজ ও তুলনামূলক বেশি। মোহনা সুবিধা চট্টগ্রাম বন্দরের দ্বিগুণ। সুন্দরবনের পাশে অবস্থান হওয়ায় মংলা বন্দরের সামুদ্রিক ঝড় ও উপকূলীয় স্রোতের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার শিকার হওয়ার সম্ভাবনাও কম। অপরদিকে নাব্যতার অভাবে নিকটবর্তী কলকাতা বন্দর ক্রমেই অব্যবহার্য হয়ে পড়ায় মংলা বন্দরের গুরুত্ব অনেক বেড়েছে। ইতিমধ্যে বন্দরকে গতিশীল করার জন্য সরকার নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বন্দরের সামগ্রিক উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ২০ বছর মেয়াদি ২১ হাজার কোটি টাকার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এছাড়াও নির্মিতব্য পদ্মা সেতুতে রেল লাইন থাকবে এবং তা মংলা পর্যন্ত বর্ধিত করা হবে।

মংলা বন্দরের অদূরেই বিশ্ব ঐতিহ্যের সুন্দরবনের অবস্থান। যে কারণে এ বন্দরের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে পর্যটন শিল্পেরও প্রভাব হবে গুরুত্বপূর্ণ। চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে মংলা বন্দরে জাহাজে মালামাল ওঠানামা খরচ তুলনামূলকভাবে অনেক কম। মংলা বন্দরের শুল্ক চার্জ চট্টগ্রাম, মুম্বাই, সিঙ্গাপুর থেকে অনেক কম। মালামাল উঠানামার জন্য লম্বা সময় জাহাজগুলিকে বর্হিনোঙরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না। বন্দরের বর্হিনোঙরেও কাজ করার সুবিধা থাকায়, জাহাজের দুপাশেই লোড-আনলোড করা সম্ভব। তাছাড়া বার্জ অপারেটিং সিস্টেম চালু হলে কারো কাছে জিম্মি হয়ে থাকবে না বন্দর ব্যবহারকারীরা। মংলা বন্দরে মালামাল ও কনটেইনার হ্যান্ডলিং ও সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক যান্ত্রিক সরঞ্জাম, ট্রানজিট শেড, ওয়্যারহাউজ ও কনটেইনার ইয়ার্ড রয়েছে। বন্দরের বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধার মধ্যে রয়েছে একসঙ্গে ৩৩টি জাহাজ খালাস ও বোঝাই করার সুবিধা এবং সমুদ্রগামী জাহাজ বন্দরে নিরাপদে আগমন, নির্গমন ও বার্থিং কাজে সহযোগিতা প্রদানের লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের ৩৫টি জলযান। বছরে ৬৫ লাখ মেট্টিক টন মালামাল এ বন্দরের মাধ্যমে ওঠানামা সম্ভব। বন্দরে ৪টি ট্টানজিট শেড, ২টি ওয়্যারহাউজের মাধ্যমে একসঙ্গে প্রায় ৬০ হাজার মেট্টিক টন মাল গুদামজাত করা সম্ভব। বিদ্যমান সুবিধার মাধ্যমে বছরে প্রায় ৫০ হাজার TEUS কনটেইনার ওঠানামা সম্ভব। এছাড়াও এ বন্দরে কনটেইনার ইয়ার্ড, কার্গোশেড এবং অন্যান্য সুবিধা বিদ্যমান রয়েছে। গত ৪ বছরে মংলা বন্দর দিয়ে ১০ লাখ ৭৬ হাজার মেট্রিক টন সার খালাস হয়েছে। প্রতিবছরই সার আমদানির পরিমাণ বাড়ছে। এ বন্দর দিয়ে আমদানিকৃত সার স্বল্প ব্যয়ে ও দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানোর সুবিধা থাকায় আমদানিকারকরা বর্তমানে এ বন্দরের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন।

গভীর সমুদ্রবন্দর  বাংলাদেশের মহেশখালীর সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে ভারত, চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশই তাদের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বর্তমান সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী ‘ডিপ সি-পোর্ট প্রজেক্ট’ নামে তিন পর্বের প্রকল্প বাস্তাবায়িত হবে ২০৫৫ সালের মধ্যে। প্রথম পর্বের কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৬০ হাজার কোটি টাকা। নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা যায়, ইতিমধ্যে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের জন্য প্রথম দফায় ১৫ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প ADP-তে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বন্দর নির্মাণে মোট ব্যায়ের ৩০% অর্থের যোগান দেবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং বাকি ৭০% অর্থসংস্থান হবে সরকারি-বেসরকারি অংশগ্রহণে (PPP)। উল্লেখ্য যে, প্রথম পর্বের কাজ শেষ হলে (২০১৯ সাল নাগাদ শেষ হওয়ার কথা) ১১টি জেটি-বার্থের মাধ্যমে বন্দরের বাণিজ্যিক পরিচালনা চালু করা সম্ভব হবে। ২০২০ সালে দ্বিতীয় পর্বের কাজ শুরু হয়ে ২০৩৫-এ বন্দরে যোগ হবে আরো ২৫টি জেটি-বার্থ। তৃতীয় পর্বের কাজ ২০৩৫ সালে শুরু হয়ে শেষ হবে ২০৫৫ সালে। বন্দরের কাজ সম্পূর্ণ শেষ হলে মোট জেটির সংখ্যা দাঁড়াবে ৯৬টিতে। তখন গভীর সমুদ্রবন্দরে সর্বমোট ৯৬টি জাহাজ ভিড়িয়ে বা নোঙর করে একসঙ্গে পণ্য ওঠানামা করা সম্ভব হবে। গভীর সমুদ্রবন্দরের প্রথম পর্বের কাজ শেষ হলে দেশের অর্থনীতিতে ১.৫% প্রবৃদ্ধি হবে। এ ছাড়া আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে ১৮ থেকে ৩০% পরিবহণ ব্যয় কমে যাবে। যার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে দ্রব্যমূল্যে।

প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্রবন্দর, সোনাদিয়া

সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দরকে ঘিরে মহেশখালী দ্বীপের প্রায় সাত বর্গমাইল এলাকাজুড়ে গড়ে উঠবে নয়নাভিরাম উপশহর। যেখানে আমদানি-রপ্তানি ও বন্দর সংশ্লিষ্ট যাবতীয় অবকাঠামো গড়ে উঠবে। মহেশখালী থেকে রামু হয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক পর্যন্ত সুপ্রশস্ত সড়ক ও দোহাজারি থেকে মহেশখালী পর্যন্ত প্রায় ৭০ কিলোমিটার রেললাইন স্থাপন করা হবে। ঢাকামুখী কনটেইনার ও পণ্যসামগ্রী নদীপথে পরিবহণের সুবিধার্থে ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের অর্থায়নে বুড়িগঙ্গার পাশে পানগাঁও এলাকায় একটি অভ্যন্তরীণ পণ্যাগার (ICD) গড়ে তোলা হয়েছে। বন্দর বিশেষজ্ঞরা বলেন, বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর বছরে প্রায় ১০ লাখ টন কনটেইনার হ্যান্ডলিং করে। আর গভীর সমুদ্রবন্দরের প্রথম পর্বের কাজ শেষ হলে বাংলাদেশ বছরে নূন্যতম সাত কোটি ৪১ লাখ টন কনটেইনার ওঠানামা করতে পারবে। ২০৫৫ সালে চূড়ান্ত নির্মাণকাজ শেষ হলে কনটেইনার ওঠানামার পরিমাণ দাঁড়াবে ৩২ কোটি ৫২ লাখ টন। সেক্ষেত্রে তিনশ মিটারের প্রতিটি বার্থে হারবার হবে ছ’টি। প্রতিটি হারবারে একসঙ্গে পণ্যবাহী পাঁচটি ও কনটেইনারবাহী চারটি জাহাজ প্রবেশ করতে পারবে, যা এখনকার নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালের চেয়ে তিনগুণ বড় হবে।

গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত হলে বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের হলদিয়া ও কলকাতা বন্দরের পণ্য, তাদের  উত্তরাঞ্চলের সাতটি রাজ্যের মধ্যে আমদানি-রপ্তানির স্বল্প খরচে ও কম সময়ে আনা-নেয়ার সুবিধা হবে। এ ছাড়া মিয়ানমার ও চীনের ইউনান প্রদেশের পণ্যসামগ্রী পরিবহণের কাজে এ গভীর সমুদ্রবন্দরকে সহজে ব্যবহার করা যাবে।

ভারত ও চীনের স্থলবেষ্টিত প্রদেশগুলির (ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল এবং চীনের দক্ষিণ অঞ্চল) অন্যতম মাধ্যম হবে বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রবন্দর, যা থেকে আমরা যেমন লাভবান হব, তেমনি চীন ও ভারত সমানভাবে উপকৃত হবে। এটা অর্থনীতিতে বহুমুখী ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। সোনাদিয়ায় নির্মিত গভীর সমুদ্রবন্দর এ অঞ্চলের জন্য ‘সাব রিজিওনাল বাণিজ্যিক হাব’ হিসাবে পরিগণিত হবে। বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য এ সমুদ্রবন্দর অদূর ভবিষ্যতে একটা বড় ভূমিকা রাখবে।  [খন্দকার আক্তার হোসেন]