শ্রম আইন
শ্রম আইন শ্রমিক নিয়োগ, শ্রমিকের মজুরি, কাজের পরিবেশ, ট্রেড ইউনিয়ন এবং শ্রম ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত আইন। কর্মরত অবস্থায় শ্রমিকের দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ, ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ, মাতৃত্ব সুবিধা, কোম্পানির মুনাফাতে শ্রমিকের অংশীদারিত্ব এবং এধরনের অন্যান্য বিষয় পরিচালনার সামাজিক আইনও শ্রম আইনের অন্তর্ভুক্ত। এসব আইনি দলিলপত্রের অধিকাংশই শ্রমজীবী মানুষের অধিকার ও দায়িত্ব নিয়ন্ত্রণ করে।
মধ্য-উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ভারত উপমহাদেশে ফ্যাক্টরি ও শিল্পকারখানার বিকাশ ও বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়। এর ফলে প্রাথমিকভাবে শহর এলাকায় অবস্থিত ফ্যাক্টরি ও মিলসমূহে ধীরে ধীরে গ্রামীণ এলাকা থেকে শ্রমশক্তির অভিবাসন ঘটে। সে সময়ে রাষ্ট্রীয় কোনো নিয়ন্ত্রণ বা শ্রমিকদের কোনো সংগঠনের অনুপস্থিতির কারণে নিয়োগকর্তারা তাদের কর্মচারীদের প্রয়োজনের প্রতি তেমন একটা মনোযোগী ছিলেন না; শ্রমিকদের নিয়োগের অসন্তোষজনক শর্তসহ কর্ম-সময় ছিল অনেক বেশি, মজুরি ছিল জীবনযাত্রা নির্বাহের ব্যয়ের তুলনায় অনেক কম। এ অবস্থায় ১৮৮১ সাল থেকে কিছু আইন প্রণয়নের সূত্রপাত হয়। সেগুলির মধ্যে ছিল ফ্যাক্টরি আইন (১৮৮১), শ্রমিকের ক্ষতিপূরণ আইন (১৯২৩), ট্রেড ইউনিয়ন আইন (১৯২৬), শ্রম বিরোধ আইন (১৯২৯), মজুরি প্রদান আইন (১৯৩৬), মাতৃত্ব সুবিধা আইন (১৯৩৯) এবং শিশু নিয়োগ আইন (১৯৩৮)।
১৯৪৭ সালের পর পরিবর্তিত চাহিদার মোকাবেলায় পাকিস্তান সরকার প্রশাসনিক আইনের আদলে এসব আইনের অধিকাংশই পরিমার্জন ও সংশোধন করে বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৭২ সালের প্রথমদিকে জারিকৃত এডপটেশন অফ বাংলাদেশ ল’জ অর্ডার (রাষ্ট্রপতির আদেশ নং ৪৮) অনুসারে স্বাধীন বাংলাদেশেও এসব আইনের অধিকাংশই বহাল রাখার সরকারি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। প্রচলিত যেসব আইন, অধ্যাদেশ, উপবিধি ও বিধান সমন্বয়ে বাংলাদেশের শ্রম ও শিল্প আইন রূপলাভ করেছে, সেসবের একটি সংক্ষিপ্ত বিষয়ভিত্তিক বিবরণ নিম্নরূপ:
সংস্থাপন দেশের শ্রম ও শিল্প আইনের মূলভিত্তি হলো ১৮৮১ সালের ফ্যাক্টরি আইন। এতে শিশু শ্রমিক নিয়োগের ন্যূনতম বয়সসহ নারী ও শ্রমিকের শ্রম-ঘণ্টার বিধানও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ১৯১৯ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) গঠনের পর এই আইন সংশোধন করা হয় এবং অতঃপর ১৯৩৪ সালের ফ্যাক্টরি আইন ঘোষণার ফলে তা বাতিল করা হয়। আইএলও সম্মেলনের কিছু বিধান সংযোজনের মাধ্যমে ১৯৬৫ সালে ফ্যাক্টরি আইন ঘোষণার বছর পর্যন্ত তা কার্যকর ছিল। কোনো ধরনের যান্ত্রিক শক্তি সহ বা যান্ত্রিক শক্তি ছাড়া দশ বা ততোধিক ব্যক্তি নিয়োজিত নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ১৯৬৫ সালের আইনটি প্রয়োগ করা হয়। নারী ও কিশোর শ্রমিকদের জন্য বিশেষ বিধান এবং শ্রমিকদের নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যবিধির বিধান এতে রাখা হয়। অধিকন্তু এতে শিশু-শ্রম নিষিদ্ধ করা হয় এবং ফ্যাক্টরি ও মৌসুমী ফ্যাক্টরিতে শিশু-শ্রম সীমিত করা হয়। সাধারণ শ্রম-ঘণ্টার বাইরে অতিরিক্ত কাজের জন্য সাধারণ মজুরির দ্বিগুণ মজুরি প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। একজন পূর্ণবয়স্ক শ্রমিকের কার্যকাল এমনভাবে নির্ধারণ করা হয় যে, কোনো শ্রমিক অন্যূন এক ঘণ্টা বিশ্রামের বিরতি ছাড়া একনাগাড়ে ছয় ঘণ্টার অধিক সময় অথবা অন্যূন আধ ঘণ্টা বিশ্রামের বিরতি ছাড়া পাঁচ ঘণ্টার বেশি কাজ করবে না। বিশ্রামের বিরতিসহ কাজের মেয়াদ সারা বছর চালু ফ্যাক্টরিতে সাড়ে দশ ঘণ্টার অধিক, আর মৌসুমি ফ্যাক্টরিতে সাড়ে এগার ঘণ্টার অধিক করা হয়। সকল শ্রমিকের জন্য একদিন সাপ্তাহিক ছুটি মঞ্জুর করা হয়। আইনটিতে অবকাশ ও ছুটির বিধান আছে।
যেসব শ্রমিকের ক্ষেত্রে ১৯৬৫ সালের ফ্যাক্টরি আইন প্রযোজ্য নয়, তারা ১৯৬৫ সালের শপস অ্যান্ড এস্টাবলিশমেন্ট অ্যাক্ট-এর আওতায় পড়ে। এছাড়াও এতে পরিচ্ছন্নতা, শ্রম-ঘণ্টা নির্ধারণ, শ্রম-ঘণ্টার বেশি কাজের জন্য অতিরিক্ত মজুরি প্রদান, নারী ও কিশোর শ্রমিকের জন্য বিশেষ বিধান রয়েছে। এই আইন অনুসারে ১২ বছরের কম বয়সী কোনো শিশুকে নিয়োগ করা যাবে না। অধিকন্তু এ আইন অনুসারে যেকোন ব্যবসায়িক বা শিল্প প্রতিষ্ঠান বা বিনোদনমূলক প্রতিষ্ঠানের শ্রম-ঘণ্টা দৈনিক নয় ঘণ্টা এবং সপ্তাহে একান্ন ঘণ্টা সীমিত রাখা হয়েছে। শ্রম-ঘণ্টার অতিরিক্ত বার্ষিক ১২০ ঘণ্টা অনুমোদনযোগ্য এবং এজন্য সাধারণ মজুরির দ্বিগুণ প্রদান করতে হবে। কোনো শ্রমিকই বিশ্রামের বিরতি ছাড়া দৈনিক পাঁচ ঘণ্টার অধিক কাজ করতে পারবে না। এ আইনে প্রতি সপ্তাহে সবেতন দেড় দিন ছুটির বিধান আছে।
১৯২৩ সালের খনি আইন খনিতে নিয়োজিত শ্রমিকদের জন্য প্রযোজ্য। খনির উপরিঅংশে নিয়োজিত শ্রমিকদের শ্রম-ঘণ্টা দৈনিক দশ ঘণ্টা এবং সপ্তাহে পঞ্চাশ ঘণ্টা। বিশ্রামের বিরতিসহ যেকোন দিন শ্রম-কাল দৈনিক বারো ঘণ্টার অধিক হবে না। ভূগর্ভে নিয়োজিত শ্রমিকের শ্রম-ঘণ্টা দৈনিক নয় ঘণ্টার মধ্যে সীমিত। এ আইনে অতিরিক্ত শ্রম-ঘণ্টার বিধান নেই। খনিতে কোনো শ্রমিকই সপ্তাহে ছয় দিনের বেশি কাজ করবে না। এ আইনে সাপ্তাহিক অবকাশ-দিনে মজুরির বিধান নেই।
১৯৮৩ সালের মোটর গাড়ি অধ্যাদেশ অনুযায়ী মোটর গাড়ি চালকের শ্রম-কাল সপ্তাহে ৫৪ ঘণ্টা এবং দৈনিক ৯ ঘণ্টার মধ্যে সীমিত রাখা হয়েছে। নির্দিষ্ট কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য ব্যতিক্রমের অনুমোদন আছে। পাঁচ ঘণ্টা কাজের জন্য অন্ততঃপক্ষে আধ ঘণ্টা বিশ্রাম বিরতির উল্লেখ রয়েছে। ১৯৬১ সালের সড়ক পরিবহন অধ্যাদেশে সড়ক পরিবহনে নিয়োজিত শ্রমিকদের চাকুরির আরও শর্ত যুক্ত করা হয়েছে; ১৯৬২ সালের সড়ক পরিবহন উপবিধি দ্বারা সেগুলি সম্পূরণ করা হয়েছে। এতে শ্রমিকের বয়সসীমা, শ্রম-ঘণ্টা ও বিশ্রাম, অবকাশ এবং চাকুরির অন্যান্য শর্তের বিধান রয়েছে। এই অধ্যাদেশ মোতাবেক গাড়ি চালক ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তিকে বয়স আঠারো বছর পার হলেই কেবল কোনো সড়ক পরিবহন কাজে নিয়োগ করা যাবে এবং গাড়ি চালকের ক্ষেত্রে ন্যূনতম বয়স ২১ বছর নির্ধারণ করা আছে। ১৯৮৩ সালের দি মার্চেন্ট শিপিং অর্ডিন্যান্স এবং ১৯৯২ সালের অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন আইনে (নিয়োগ নিয়ন্ত্রণ) নৌপরিবহন কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের চাকুরির শর্তের বিধান রয়েছে।
১৮৯০ সালের রেলপথ আইনের ৬-ক অধ্যায় মোতাবেক রেলপথ শ্রমিকরা দুই শ্রেণীতে বিভক্ত; যথা বিরামহীন এবং আবশ্যিকভাবে সবিরাম। প্রথমোক্ত শ্রেণীর শ্রমিকরা যেকোন সপ্তাহে দৈনিক আট ঘণ্টা পর্যন্ত নিয়োজিত থাকবে এবং সপ্তাহে সবেতন কমপক্ষে ২৪ ঘণ্টা ছুটির অনুমোদন আছে। অতিরিক্ত শ্রম ঘণ্টার জন্য সাধারণ হারের ১২৫% মজুরি পাবে।
আকাশ পরিবহন কর্মচারীদের জন্য বিশেষ কোনো আইন নেই। ১৯৬৫ সালের শ্রমিক নিয়োগ (স্থায়ী আদেশ) আইন দ্বারা তাদের চাকুরি নিয়ন্ত্রিত হয় এবং সে মোতাবেক চাকুরি বিধি প্রণয়ন করা হয়েছে।
ছুটি ১৯৪২ সালের সাপ্তাহিক ছুটি আইনে যেকোন দোকান, রেস্টুরেন্ট বা থিয়েটারে নিয়োজিত ব্যক্তির বেতনসহ সাপ্তাহিক একদিন ছুটির উল্লেখ আছে (কোনো গোপনীয় কাজ বা ব্যবস্থাপনা পদে নিয়োজিত ব্যক্তিরা ব্যতিক্রম)। সপ্তাহে অতিরিক্ত অর্ধ দিবস বেতনসহ ছুটি অনুমোদনের ক্ষমতা সরকারের আছে। ১৯৬৫ সালের ফ্যাক্টরি আইন মোতাবেক ফ্যাক্টরিতে নিয়োজিত কর্মচারীরা এক বছর কাজ করার পর পূর্ণ বয়স্করা বেতনসহ এক নাগাড়ে দশ দিন এবং শিশুরা চৌদ্দ দিন ছুটি পাবে। খনি শ্রমিকরা বার্ষিক ছুটি ভোগ করার অধিকারী নয়।
আবাদ শ্রমিকরা সবচেয়ে কম বার্ষিক ছুটি ভোগ করে। একজন পূর্ণ বয়স্ক শ্রমিক ৩০ দিন কাজ করার পর এক দিনের ছুটি পায়। তরুণ শ্রমিকরা প্রতি ২০ দিন কাজের পর ১ দিন ছুটি পায়। আবাদ শ্রমিকরা বছরে কেবল ৫ দিন উৎসব ছুটি পায়। তারা অর্ধ বেতনে ১৫ দিনের অসুস্থতা জনিত ছুটি পায়। বেতনসহ তাদের কোনো নৈমিত্তিক ছুটি মঞ্জুর করা হয় না। সড়ক পরিবহন শ্রমিকরা ২২ দিন কাজের পর একদিন বার্ষিক ছুটি ভোগ করে। তারা বছরে ১০ দিন নৈমিত্তিক ছুটি এবং ১৪ দিন অসুস্থতাজনিত ছুটি ভোগ করতে পারে। ১৯৬১ সালের সড়ক পরিবহন শ্রমিক অধ্যাদেশে উৎসব ছুটির কোনো বিধান নেই।
সংবাদপত্রে নিয়োজিত কর্মচারীরা পর্যাপ্ত ছুটির সুযোগ ভোগ করে। তারা দায়িত্বে ব্যয়কৃত সময়ে কমপক্ষে এগারো ভাগের একভাগ সময় পূর্ণ বেতনে অর্জিত ছুটি, কর্তব্য সময়ের কমপক্ষে আট ভাগের একভাগ সময় অর্ধবেতনে চিকিৎসা ছুটি এবং সবেতন দশ দিন নৈমিত্তিক ছুটি লাভ করে।
১৯৬৫ সালের দোকান ও প্রতিষ্ঠান আইন মোতাবেক বেতনসহ বার্ষিক ছুটির যোগ্যতা হলো: পূর্ণ বয়স্ক ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রতি ১৮ দিন কাজের জন্য ১ দিন, কিশোরের ক্ষেত্রে প্রতি ১৪ দিনের কাজের জন্য ১দিন এবং তা নির্ধারিত হবে বিগত ১২ মাসের কার্যকালে তার দ্বারা কৃত কাজের ভিত্তিতে। অধিকন্তু এতে পূর্ণবেতনে বার্ষিক ১০ দিন নৈমিত্তিক ছুটি এবং ১৪ দিন অসুস্থতাজনিত ছুটির বিধান আছে।
শিল্প সম্পর্ক ১৯৬৯ সালের শিল্প সম্পর্ক অধ্যাদেশ এবং এর আওতায় প্রণীত ১৯৭৭ সালের শিল্প সম্পর্ক উপবিধি মিলে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন এবং নিয়োগকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণের বিধি প্রণীত হয়। এই অধ্যাদেশ জারির সময় এদেশে কর্মচারী ও নিয়োগকর্তাদের সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণের তিনটি আলাদা আইন ছিল, যথা, ১৯৬৫ সালের ইস্ট পাকিস্তান ট্রেড ইউনিয়ন অ্যাক্ট, যাতে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন ও কার্যাবলির বিধান আছে; ১৯৬৫ সালের ইস্ট পাকিস্তান লেবার ডিস্প্যুটস্ অ্যাক্ট, যাতে শ্রম বিরোধের তদন্ত ও নিষ্পত্তির বিধান আছে এবং ১৯৬৫ সালের পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক নিয়োগ (স্থায়ী আদেশ) আইন। শেষোক্ত আইনে দোকান, বাণিজ্যিক ও শিল্প প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মচারীর চাকুরির শর্ত নিয়ন্ত্রণের বিধান রয়েছে। ১৯৬৯ সালের অধ্যাদেশ দ্বারা এসব আইনের প্রথম দুটি বাতিল করা হয়। ১৯৬৫ সালের আইনে সংজ্ঞায়িত শিল্প-বিরোধ নিষ্পত্তির বিবিধ পন্থা এই অধ্যাদেশে রয়েছে। শিল্প-বিরোধ নিষ্পত্তিতে জনস্বার্থ জড়িত থাকার কারণে শ্রম আদালতের রায় বেশ গুরুত্ব বহন করে। শ্রম ব্যবস্থাপনা সমস্যা ইস্যুর নিষ্পত্তির মাধ্যমে শিল্পক্ষেত্রে শান্তিরক্ষায় শ্রমআদালত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কাজেই এ আদালত নিয়োগকর্তা ও কর্মচারী উভয়েরই আস্থাভাজন।
বিচার নিষ্পত্তি ব্যবস্থার বিকাশ ছিল ধারণাগত। ১৯২৯ সালের বাণিজ্য বিরোধ আইনের মাধ্যমে এর সূত্রপাত হয়। এটি তদন্ত ও বাণিজ্য বিরোধ নিষ্পত্তি এবং এ সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়ে সহায়তা করে। যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিযুক্ত একজন নিরপেক্ষ চেয়ারম্যান এবং এক বা একাধিক ব্যক্তি নিয়ে তদন্ত-আদালত গঠিত হয়। নিয়োগকর্তা ও তাদের কর্মচারীদের মধ্যকার বিরোধ বিচারপূর্বক নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ১৯২৯ সালের আইনের কিছু কিছু সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য ১৯৩৯ সালের ভারত প্রতিরক্ষা বিধিতে কতিপয় বিধান সংযোজন করা হয়। ১৯৪৭ সালের ৩১ মার্চ পূর্বোল্লিখিত বিধির মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। ১৯৪৭ সালের শিল্প বিরোধ আইন ওই বছর ১ এপ্রিল কার্যকর হয়। এই আইনটি ব্রিটিশ ভারতে সরকার কর্তৃক শিল্প ট্রাইব্যুনালের ব্যবস্থা চালু করে। প্রথমবারের মতো এটি শিল্প বিরোধের বিচারপূর্বক নিষ্পত্তির জন্য একটি পরিপূর্ণ শিল্প ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করে। এরপর ১৯৬৫ সালে ইস্ট পাকিস্তান লেবার ডিস্প্যুট্স অ্যাক্ট ঘোষণা করা হয় এবং তা ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হয়। ১৯৫৯ সালের শিল্প বিরোধ অধ্যাদেশের মতো এ আইন আপীল প্রক্রিয়ার প্রবর্তন করে এবং শ্রম আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ পক্ষ কর্তৃক শ্রম আপিল আদালতে আপিলের সুযোগ দান করে।
১৯৬৫ সালের শ্রমিক নিয়োগ (স্থায়ী আদেশ) আইনের এক বিধান অনুসারে শ্রমিকদের অভিযোগ পেশ করার সুযোগ রয়েছে। এই বিধান মতে কোনো শ্রমিকের নিয়োগ বা কাজের শর্ত ও পরিবেশ বিষয়ে বা সেসব ক্ষেত্রে নিয়মভঙ্গের অভিযোগ থাকলে তা উত্থাপন করার সুযোগ রয়েছে। এর ফলে শ্রম আদালতের বিচার ক্ষমতার আওতা এবং উপর্যুক্ত আইনের অনুবলে নিজ নিজ অধিকার নিয়ে বিশেষ বিশেষ শ্রমিকের অভিযোগ যাচাই করে দেখার এখতিয়ারও প্রসারিত হয়েছে। এ আইনের আওতায় পড়ে বেআইনি বরখাস্তকরণ, অব্যাহতি দান, ছাঁটাই, শ্রমিক ইউনিয়ন করার অপরাধে চাকরিচ্যুতি বা বাধ্যতামূলক অপসারণ এবং উপর্যুক্ত আইনের আওতাভুক্ত যেকোন অধিকার লঙ্ঘন। মালিকরা শ্রমিকদের ওপর কোনো অন্যায় আচরণ করলে তার কার্যকর প্রতিবিধান দেওয়ার এখতিয়ার শ্রম আদালতকে দেওয়া হয়েছে।
১৯৬৯ সালের প্রথমদিকে পাকিস্তানের সামরিক সরকার পরিবর্তিত শিল্প-সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রভাবে সাধারণভাবে শ্রমনীতি পরিবর্তন এবং শ্রম আইনে নতুন ধারণার প্রচলন সমীচীন মনে করে। এই পটভূমিতে এবং নিয়োগকারী ও কর্মচারীর মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ, শিল্প বিরোধ এড়ানো ও নিষ্পত্তির জন্য আইন সংহত করার প্রয়োজনে এবং ট্রেড ইউনিয়ন গঠন ও রেজিস্ট্রিকরণ সম্পর্কিত বিষয় নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৬৯ সালের নভেম্বর মাসে শিল্প সম্পর্ক অধ্যাদেশ ১৯৬৯ ঘোষণা করা হয়। অবশ্য ১৯৭০ সালের অক্টোবর মাসে এই অধ্যাদেশে ব্যাপক সংশোধন আনা হয়।
১৯৬৯ সালের শিল্প সম্পর্ক অধ্যাদেশকে শিল্প আদালতের সংবিধান হিসেবে গণ্য করা হয়। এ আদালতে একজন চেয়ারম্যান এবং তাকে পরামর্শ দানের জন্য দুজন সদস্য থাকেন। সদস্যদের একজন নিয়োগকারীর এবং অপর জন কর্মচারীর প্রতিনিধিত্ব করেন। শ্রম আদালতটি দেওয়ানি আদালত ও ফৌজদারি আদালত হিসেবে কাজ করে এবং শ্রম আইনের আলোকে শাস্তিযোগ্য অপরাধের বিচার করে। তাছাড়াও ১৯৬৯ সালের শিল্প সম্পর্ক অধ্যাদেশ শিল্পবিরোধ বিষয়ে শ্রম আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিবেচনার জন্য শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠনের ব্যবস্থাও করে।
চাকুরির শর্তাবলি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বিকাশের স্বার্থে দীর্ঘমেয়াদী নীতি সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন শ্রম আইনে তুলনামূলকভাবে একটি নতুন ধারণা। দোকান, শিল্প প্রতিষ্ঠান বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত কর্মচারী নিয়োগের বিধিবিধান প্রসঙ্গে বলতে গেলে কোনো আইনি নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ১৯৪৬ সালের শিল্প নিয়োগ (স্থায়ী আদেশ) আইন প্রথমবারের মতো কার্যকর হতে থাকে যখন কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠানে ১০০ জন বা ততোধিক কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে এ আইনে বিধিবদ্ধ স্থায়ী আদেশের সঙ্গে সংগতি রেখে নিয়োগের শর্তাবলি প্রয়োগের বিধান বাধ্যতামূলক করা হয়। ১৯২৩ সালের মার্চেন্ট শিপিং অ্যাক্ট চাকুরির শর্ত অনুসারে শ্রমিক ও মালিকের মধ্যে চুক্তির ব্যবস্থা চালু করে। ১৯৮৩ সালের মার্চেন্ট শিপিং অধ্যাদেশের মাধ্যমে আইনটি বদলানো হয়েছে। ১৯৪৬ সালের শিল্প নিয়োগ (স্থায়ী আদেশ) আইনের স্থলে ১৯৬০ সালে কার্যকর হয় শিল্প ও বাণিজ্যিক নিয়োগ (স্থায়ী আদেশ) অধ্যাদেশ। এ আইনটিও ১৯৬৫ সালের শ্রমিক নিয়োগ (স্থায়ী আদেশ) আইনের মাধ্যমে বদলানো হয়। এতে শ্রমিকের চাকুরির শর্ত, শ্রমিক ও কর্মচারীর অধিকার এবং অন্যদিকে নিয়োগকারীর অধিকার সংজ্ঞায়িত ও নিশ্চিত করার ব্যবস্থা রয়েছে। এ আইনে কর্মচারীর অসদাচরণ সংজ্ঞায়িত হয়েছে এবং নিয়োগকারীর লে-অফ, বরখাস্তকরণ, কর্মচ্যুতি, ছাটাই বা চাকুরির অবসান ঘটানোর অধিকার রয়েছে। কোনো আকস্মিক ঘটনায় নিয়োগকারী তার প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে পারেন। এ আইনে অবৈধ বরখাস্ত বা নিয়োগের অবসান, নিয়োগকারীর যেকোন ক্ষতিকর পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কর্মচারীর প্রতিকারের সুযোগ রয়েছে।
মজুরি শিল্প শ্রমিকের মজুরি প্রদানে অনিয়ম পরিহার নিশ্চিত করতে ভারত সরকার ১৯২৬ সালে একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করে। ১৯২৯ সালে গঠিত শ্রম বিষয়ক রয়্যাল কমিশন উক্ত অনুসন্ধান কমিটির প্রতিবেদন ও সুপারিশ বিবেচনা করে মজুরি প্রদানে অনিয়ম প্রতিরোধে আইন প্রণয়নের সুপারিশ করে। ১৯৩৬ সালে মজুরি প্রদান আইন ঘোষণা করা হয়। এ আইনের লক্ষ্য ছিল, প্রথমত নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শ্রমিকদের প্রকৃত বণ্টনযোগ্য মজুরি প্রদান এবং দ্বিতীয়ত কোনো প্রকার কর্তন ছাড়া কর্মচারীদের পূর্ণ মজুরি প্রাপ্তি নিশ্চিত করা। শিল্প কারখানায় নিয়োজিত নির্দিষ্ট শ্রেণীর কর্মচারীদের মজুরি প্রদান নিয়ন্ত্রণের জন্য এ আইন পাস করা হয়েছিল। এ আইনের মূল লক্ষ্য ছিল কর্মচারীদের জন্য সহজে ও দ্রুত প্রতিকার বিধান করা এবং তাদের প্রাপ্য মজুরি আদায় করা। সে উদ্দেশ্যে একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছিল; তবে আইনটির কিছু কিছু অন্তর্নিহিত ত্রুটির কারণে আইনসঙ্গত মজুরি আদায় কঠিনই রয়ে যায়।
১৯৩৬ সালের মজুরি প্রদান আইন পাকিস্তান শাসনামলে কার্যকর থাকে এবং অতঃপর স্বাধীন বাংলাদেশেও। অবশ্য ১৯৮০ সালের মজুরি প্রদান (সংশোধনী) আইনের মাধ্যমে (১৯৮০ সালের ২৬ নং আইন) ওই আইনটিতে ব্যাপক সংশোধনী আনা হয়। মজুরি নির্বিশেষে কর্মরত কর্মচারীদের ওপর প্রয়োগযোগ্য করে আইনটি সংশোধন করা হয়। এ আইনের অধীন মামলা বিচারের জন্য শ্রম আদালতের চেয়ারম্যানের এক্তিয়ারভুক্ত করা হয় এবং হাইকোর্ট বিভাগের পরিবর্তে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে আপিল করার বিধান রাখা হয়। সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তির অভিযোগের জন্য বেতন প্রদানকারীকে দায়ী করা হয়।
যেক্ষেত্রে যৌথ দরকষাকষির কোনো ব্যবস্থা নেই সেখানে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের জন্য ১৯৬১ সালের ন্যূনতম মজুরি অধ্যাদেশ-এর অধীনে ন্যূনতম মজুরি বোর্ড গঠন করা হয়। এই বোর্ড বিশেষ কিছুসংখ্যক শিল্প কারখানার কর্মচারীর জন্য ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করে; তবে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি ঘোষণার এক্তিয়ার এই বোর্ডের নেই। যৌথ চুক্তির মাধ্যমে প্রায় সকল ক্ষেত্রে মজুরি নির্ধারণ করা হয়। ১৯৮৩ সালের মার্চেন্ট শিপিং অর্ডিন্যান্স-এর অধীনে নাবিকদের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে নাবিকদের মজুরি নির্ধারণ করা হয়।
সামাজিক নিরাপত্তা দুটি অনিশ্চিত সম্ভাবনার ক্ষেত্রে সংবিধিবদ্ধ বিধান রয়েছে, যেমন চাকুরিকালে সংঘটিত আঘাত এবং সন্তানপ্রসব। উভয় ক্ষেত্রে দায়দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে নিয়োগকর্তার। আইনে নির্দেশিত সকল রেলওয়ে ও অন্যান্য শ্রেণীর কর্মচারীসহ যাদের মাসিক মজুরি ৪০০ টাকার উপরে নয় তাদের বেলায় প্রথম নজির হিসেবে ১৯২৩ সালের শ্রমিকের ক্ষতিপূরণ আইন প্রয়োগ করা হয়। এদের মধ্যে পড়ে কারখানা, খনি, আবাদ, মাল বোঝাই বা খালাস, নির্মাণ, যন্ত্রচালিত গাড়ি মেরামতে নিয়োজিত কর্মচারী। ১৯৮০ সালে আইনটি সংশোধনের মাধ্যমে মজুরির পরিমাণের প্রতিবন্ধকতা দূর করা হয়। অধিকন্তু ১৯২৩ সালের আইনে ক্ষতিপূরণ প্রদানযোগ্য পেশাগত ব্যাধির একটি তালিকাও সংযোজন করা হয়।
নিয়োগকারীর দায়দায়িত্ব আইন ১৯৩৮-এ ঘোষণা করা হয় যে, কর্মরত অবস্থায় দূর্ঘটনার শিকার হলে তার জন্য ক্ষতিপূরণের মামলায় রক্ষাকবচরূপে সাধারণ নিয়োগ মতবাদ ও অনুমিত সম্ভাব্য ঝুঁকির কথা উত্থাপন করা যাবে না। ১৯৩৯ সালের মাতৃত্ব সুবিধা আইন, ১৯৫০ সালের মাতৃত্ব সুবিধা (চা বাগান) আইন, ১৯৪১ সালের খনি কর্মচারীদের মাতৃত্ব সুবিধা আইন-এর অধীনে এবং এসব আইনের অধীনে প্রণীত উপবিধিতে মহিলা কর্মচারীরা মাতৃত্বের জন্য বিবিধ সুবিধা পাওয়ার যোগ্য, তবে বাস্তবে তারা শিশু প্রসবের আগে ৬ সপ্তাহ এবং পরে ৬ সপ্তাহ ছুটি ভোগ করে থাকেন।
কোম্পানির মুনাফায় কর্মচারীর অংশীদারিত্ব আইন ১৯৬৮ প্রণয়নের মাধ্যমে কোম্পানির মুনাফার উপর নির্দিষ্ট হারে কর্মচারীর অধিকার বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। যেসব কোম্পানি ১০০ জন কর্মচারী নিয়োগ করে অথবা যেসব কোম্পানির পরিশোধিত পুঁজির পরিমাণ ৫০ লক্ষ টাকা অথবা যাদের নির্দিষ্ট সম্পদের মূল্য এক কোটি টাকার ঊর্ধ্বে (পদবি বা কাজ নির্বিশেষে যে মাসিক ৯০০০ টাকার কম বেতন উত্তোলন করে তাকে এ আইনে শ্রমিক বলে বিবেচনা করা হয়) সেসব কোম্পানি এ আইনের আওতাভুক্ত। ১৯৮৫ সালে সংশোধিত এ আইনের বিধান মোতাবেক শ্রমিকের কল্যাণের জন্য কোম্পানির অর্থে অংশীদারি তহবিল ও কল্যাণ তহবিল নামে দুটি তহবিল গঠন করা হয়েছে।
১৯৬৫ সালের ফ্যাক্টরি আইনে যেকোন চলমান যন্ত্রপাতি পরিষ্কারকরণ বা তাতে তৈল প্রদান কাজে এবং যেসব কারখানায় সুতা তৈরির কাজ চলে সেখানে নারী শ্রমিক নিয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যেসব কাজে শারীরিক মারাত্মক আঘাতের ঝুঁকি, বিষক্রিয়া বা রোগের সম্ভাবনা রয়েছে সেক্ষেত্রে নারীর নিয়োগ নিষেধ করে সরকার প্রয়োজনীয় বিধিবিধান প্রণয়ন করেছে। ১৯২৩ সালের খনি আইন দ্বারা খনির কাজে ভূগর্ভে বা অন্যত্র যেখানে জীবন, নিরাপত্তা বা নারীর স্বাস্থ্যের ঝুঁকি রয়েছে সেসব ক্ষেত্রে নারী শ্রমিক নিয়োগ নিষিদ্ধ বা নিয়ন্ত্রণের বিধিবিধান তৈরির ক্ষমতা সরকারকে প্রদান করা হয়েছে।
১৯৩৩ সালের শিশু (শ্রমে নিয়োগ) আইন মতে ১৫ বছরের কম বয়সী শিশুকে শ্রমে নিয়োজিত করলে সে চুক্তি বাতিল বলে গণ্য হবে। এ আইন অনুসারে শিশুর পিতামাতা বা অভিভাবক এবং নিয়োগকারী চুক্তি সম্পাদন করলে উভয়েই দোষী সাব্যস্ত হবেন। শিশু শ্রমের অঙ্গীকারের লিখিত বা মৌখিক, বিবৃত বা অবিবৃত যে চুক্তির মাধ্যমে শিশুর পিতামাতা বা অভিভাবক কোনো অর্থ বা সুবিধা প্রাপ্তির বিনিময়ে অথবা অনুরূপ অর্থ বা সুবিধার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে চুক্তিবদ্ধ হন, তাতেই ধরে নেয়া হবে যে শিশুকে কোনো চাকুরি বা শ্রমে নিয়োগ করার চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে।
নারী শ্রমিক ১৯৬৫ সালের ফ্যাক্টরি আইনে শ্রম-ঘণ্টার বিধান নারী-পুরুষ উভয় ধরনের শ্রমিকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ১৯২৩ সালের খনি আইনে এই শর্তে নারী শ্রমিকের বেলায় দৈনিক ৯ ঘণ্টার সীমা বেঁধে দেওয়া আছে যে, নারী শ্রমিকের শ্রম-ঘণ্টার কোনো বিশেষ রেয়াত নেই। এই শ্রম-কাল খনির উপরিঅংশে কাজের জন্য দৈনিক দশ ঘণ্টা এবং সপ্তাহে ৫৪ ঘণ্টা; ভূগর্ভের শ্রমিকদের জন্য দৈনিক ৯ ঘণ্টায় সীমিত আছে। অবশ্য এই আইনের আওতায় প্রণীত বিধিবিধান দ্বারা ভূগর্ভে নারীর নিয়োগ বন্ধ রাখা হয়েছে। অবশ্য ফ্যাক্টরি আইন শর্ত জুড়ে দিয়েছে যে, কোনো নারী সকাল ৬টা থেকে বিকেল ৭টা এই সময়ের বাইরে কাজ করতে পারবে না। যেকোন শ্রেণীর ফ্যাক্টরি এই সময়সীমা সকাল ৫টা থেকে বিকেল সাড়ে ৭টার মধ্যে বাড়িয়ে ১৩ ঘণ্টায় প্রসারিত করতে পারে। ১৯২৩ সালের খনি আইন অনুসারে খনিতে উপরে বা ভূগর্ভে বিকাল ৭টা থেকে পরদিন সকাল ৬টার মধ্যে নারীর কাজ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ১৯৬৫ সালের ফ্যাক্টরি আইন মোতাবেক ৫০ জনের অধিক নারী শ্রমিক নিয়োজিত যেকোন ফ্যাক্টরিতে নারী শ্রমিকদের ৬ বছরের কম বয়সী শিশুদের বিশ্রামের জন্য পরিবেশসম্মত কক্ষ সংরক্ষণের বিধান আছে। ১৯২৩ সালের খনি আইন এবং ১৯৪৬ সালের মাইনস্ ক্রেইশ রুলস্-এ খনিতে কর্মরত নারীদের শিশু সন্তানের তত্ত্বাবধানের জন্য ‘ক্রেইশ’ বা শিশুসদন রাখার বিধান রয়েছে।
তরুণ শ্রমিক ১৯৬৫ সালের ফ্যাক্টরি আইন ছেলেমেয়েদের ফ্যাক্টরিতে নিয়োগের ন্যূনতম বয়স নির্ধারণ করেছে ১২ বছর। শারীরিকভাবে উপযুক্ত এমন সনদ না থাকলে কোনো শিশুই ফ্যাক্টরিতে কাজ করার জন্য অনুমোদন পাবে না এবং আইনের বিধান মোতাবেক ১৬ থেকে ১৮ বছরের ছেলেমেয়েদের শারীরিকভাবে উপযুক্ত বলে সনদ না থাকলে শিশুরূপেই গণ্য করা হবে। যাত্রী পরিবহন, রেলপথে মালামাল বা ডাক চলাচল অথবা কোনো বন্দরের সীমার মধ্যে মালামাল ওঠানামা সংক্রান্ত যেকোন পেশায় শিশু নিয়োগ ১৯৩৮ সালের শিশু নিয়োগ আইনে নিষিদ্ধ। তাছাড়া বিড়ি তৈরি, কার্পেট বয়ন, সিমেন্ট উৎপাদন, বস্ত্র ছাপানো, দিয়াশলাই ও বিস্ফোরক উৎপাদনকারী কোনো ওয়ার্কশপ এবং পাথর কাটা ও ভাঙ্গার কাজে ১২ বছরের কম বয়সী শিশুর নিয়োগ দান নিষিদ্ধ।
১৯২৩ সালের খনি আইনে খনি শ্রমে উপরে বা ভূগর্ভে ১৫ বছরের কম বয়সী শিশুর কাজ করার অনুমতি আছে। ভূগর্ভে ১৫ থেকে ১৭ বছরের শিশুর নিয়োগ নির্ভর করে তাদের দৈহিক যোগ্যতার সনদের ওপর। এধরনের কাজে ১৭ বছরের কম বয়সী লোককে নিয়োগ করা যাবে এই শর্তে যে, একটানা ১২ ঘণ্টা কাজের মধ্যে তারা বিশ্রাম বিরতি লাভ করবে এবং এতে বিকাল ৭টা থেকে পরদিন সকাল ৭টা পর্যন্ত কাজের সময় থাকবে ৭ ঘণ্টা।
১৯৬৫ সালের দোকান ও প্রতিষ্ঠান আইন মোতাবেক দোকান ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য এই আইনের আওতাভুক্ত দোকান বা প্রতিষ্ঠানে ১২ বছরের কম বয়সী কোনো শিশু নিয়োগ করা যাবে না। ১৯৮৩ সালের মার্চেন্ট শিপিং অ্যাক্ট মোতাবেক সমুদ্রে নিয়োগের ন্যূনতম বয়স ১৪ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে। ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সের কোনো তরুণকে কেবল তখনই সমুদ্রে নিয়োগ দেওয়া যাবে যখন তাকে দৈহিকভাবে যোগ্য ঘোষণা করা হবে। ১৯৬৫ সালের ফ্যাক্টরি আইন মোতাবেক ফ্যাক্টরির কোনো চালু যন্ত্রাংশ পরিষ্কার করা বা তাতে তৈল প্রদানের কাজে ১৫ বছরের কম বয়সী শিশু নিয়োগ নিষিদ্ধ। তাছাড়াও যেসব কাজে শ্রমিকদের মারাত্মক শারীরিক আঘাত পাওয়ার ঝুঁকি, বিষক্রিয়া বা রোগের সম্ভাবনা আছে তা নিষিদ্ধকরণ বা বিধিনিষেধ আরোপের বিধিবিধান তৈরির ক্ষমতা সরকারের আছে। ১৮ বছরের কম বয়সী ব্যক্তিকে কারখানার চুল্লিতে কয়লা যোগানদার বা ইঞ্জিন পরিষ্কার বা ইঞ্জিনে তৈল দেয়ার কাজে নিয়োগ করা যাবে না। তবে উপকূলীয় জাহাজে ১৬ বছরের বেশী বয়সী লোকদের নিয়োগ করা যেতে পারে।
রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা নতুন প্রতিষ্ঠিত বিশেষ বাণিজ্যিক এলাকার জন্য কতকটা আলাদা শ্রম আইন রয়েছে। সেখানে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত বহুসংখ্যক শ্রমিক শ্রম আইনের আওতা বহির্ভূত। ১৯৮০ সালের দি এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন্স অথরিটি অ্যাক্ট দ্বারা এধরনের যেকোন এলাকায় কিছু কিছু আইন প্রয়োগ নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে সরকারকে ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। শ্রম নিয়োগ (স্থায়ী আদেশ) আইন এসব অঞ্চলে অকার্যকর হওয়ায় এই আইনের অধীনে গঠিত কর্তৃপক্ষ শ্রমিকের চাকুরির শর্ত ও মজুরি প্রদান বিষয়ে দুটি নির্দেশনা ঘোষণা করেছে। অবশ্য এসব আইন কোনো আদালতে কার্যকর নয়।
উদ্ভূত সমস্যা মোকাবিলার জন্য বিভিন্ন সময়ে এদেশে শ্রম আইন প্রণীত হয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে বিদ্যমান আইনের বিষয় বিবেচনা না করে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে অন্য আইনের সঙ্গে এদের সম্পর্ক বিবেচনায় না এনেই আইন প্রণীত হয়েছে, যার ফলে সৃষ্টি হয়েছে বিশৃঙ্খলা ও বিরোধ। বিভিন্ন শ্রম আইন ও শিল্প আইন পর্যালোচনা এবং বিধিবদ্ধ করে সমন্বিত করার লক্ষ্যে ১৯৯২ সালে ৩৫ সদস্য বিশিষ্ট জাতীয় শ্রম আইন কমিশন গঠন করা হয়। ১৯৯৫ সালে কমিশন একটি একক কোডের খসড়া সরকারের নিকট পেশ করে। কিন্তু সে সুপারিশ অনুযায়ী ব্যাপক ভিত্তিক কোনো আইন এখনও প্রণীত হয় নি। [নির্মলেন্দু ধর]