শাক্তপীঠ

শাক্তপীঠ  হিন্দু ধর্ম বিশ্বাস অনুসারে ভারত উপমহাদেশে দেবতা শিবের স্ত্রী সতীর বিভিন্ন দেহাংশ ছড়িয়ে থাকা পবিত্র স্থানসমূহ। বাংলা ভাষায় একে সাধারণত বলা হয় পীঠস্থান বা ‘মহাপীঠ’। ‘পীঠ’ শব্দের অর্থ ‘বেদি’ বা ‘আসন’ যেখানে বিষ্ণুচক্রে খন্ডে খন্ডে কর্তিত হওয়ার পর দেবী সতীর (দেবী দুর্গার আরেক নাম) দেহখন্ড পৃথিবীতে পতিত হয়েছিল। প্রচলিত অভিমত অনুসারে মোট একান্নটি শাক্তপীঠ রয়েছে। এই পীঠগুলির যথার্থ অবস্থান নিয়ে তেমন মতৈক্য নেই। মহাপীঠ নিরূপণ নামে একটি জনপ্রিয় প্রাচীন পান্ডুলিপিতে (১৬৯১-১৭২০) এসব পীঠের নাম উলে­খ করা হয়েছে। এই গ্রন্থে বৃহৎ বঙ্গে এবং এর পরিপার্শ্বের এলাকাগুলিতে অবস্থিত মোট ২৩টি পীঠ শনাক্তীকৃত। এগুলির মধ্যে ১৪টি পশ্চিমবঙ্গে এবং ৭টি বাংলাদেশে।

পৌরাণিক উপাখ্যান  শাক্তপীঠের উদ্ভব প্রসঙ্গ মহাভারত-এর ‘দক্ষযজ্ঞ’ নামে একটি পুরাণ কাহিনীতে বর্ণিত হয়েছে। একদিন প্রজাপতি দক্ষ পবিত্র অগ্নির যজ্ঞ করছিলেন। ওই যজ্ঞে তিনি সকল দেবতাকে আমন্ত্রণ জানান, কিন্তু তার কন্যা সতীর স্বামী শিবকে বাদ দেন। এই ঘটনায় অপমান বোধ করে প্রতিবাদ জানাতে বিক্ষুব্ধ দেবী সতী যজ্ঞবেদিতে এসে আগুনে আত্মাহুতি দেন। প্রিয়তমা ভার্যার মৃত্যুর সংবাদ শুনে শোকার্ত দেবতা শিব দক্ষযজ্ঞে এসে সতীর মৃতদেহ কাঁধে তুলে নেন এবং শোকোন্মত্ত হয়ে পদাঘাতে মেদিনী প্রকম্পিত করে পৃথিবীর চারদিকে ঘুরতে থাকেন। ধরিত্রী এই কম্পনে ভয়াবহভাবে বিপর্যস্ত হতে থাকে। শেষপর্যন্ত উন্মত্ত শিবকে থামানোর জন্য দেবতারা বিষ্ণুকে অনুরোধ জানালেন। বিষ্ণু তাঁর অস্ত্রচক্র শিবের প্রতি নিক্ষেপ করেন এবং তা শিবের কাঁধে অবস্থিত সতীর মৃতদেহকে খন্ড খন্ড করে কেটে ফেলে। এই কর্তিত দেহখন্ডগুলিই পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। পৃথিবীর যে স্থানে সতীর দেহখন্ড পড়েছে সেখানেই ভক্তরা দেবীর পূজার জন্য মন্দির নির্মাণ করে বেদি স্থাপন করেছে। সময়ের বিবর্তনে, স্থানীয় লোকদের প্রচেষ্টায় এই স্থানগুলি মাতৃকা পূজার নিমিত্তে তীর্থকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। প্রত্যেকটি পীঠ সতী-সম্পর্কিত পুরাণ কাহিনীর জন্মবৃত্তান্তসহ পৃথক পৃথক পীঠস্থান হিসেবে নাম পরিগ্রহ করেছে। সেগুলি দেবী ও তাঁর স্বামী দেবতার (শিব) নানা নামও গ্রহণ করেছে। দেবী সতী মূল মাতৃকাদেবী বা শক্তিদেবী দুর্গার অন্যান্য লৌকিক নামরূপের সঙ্গে একীভূত হয়ে গেছেন। আবার নানা অবতার মূর্তিতে দুর্গার নামও বিভিন্ন হয়েছে। প্রত্যেকটি পীঠ কেন এক এক দেবীর নামে পরিচিত এবং কেন সেগুলি দেহবিচ্ছিন্ন সতীর নানা নামে পুনর্জন্ম গ্রহণের কাহিনীতে রূপান্তরিত হলো তার কারণ এই লোকায়ত দেবীরূপ ও তার অবতারতত্ত্ব।

বাংলায় শাক্তপীঠের অবস্থান  সারণি ১-এ বাংলায় সাধারণভাবে স্বীকৃত এবং আঠারো শতকের ধর্মীয় পুস্তকাদিতে ও এখনকার মুদ্রিত বাংলা পঞ্জিকাতে প্রকাশিত শাক্তপীঠের তালিকা দেওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে বেশিসংখ্যক পীঠ আছে এবং ঐতিহাসিক রাঢ় এলাকায় এগুলি বেশি কেন্দ্রীভূত। মধ্যযুগ থেকে কলকাতার কালীঘাট জনপ্রিয় পীঠস্থান এবং ওই বিরাট নগরীর বাণিজ্যিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে একটি কালীঘাট মন্দিরও গড়ে উঠেছে। এটি সারা উপমহাদেশের হিন্দুদের জন্য একটি মস্ত বড় তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। সারণিভুক্ত অন্য স্থানগুলির চেয়ে এর আকর্ষণ ও বৈচিত্র্য অনেক বেশি। বীরভূম জেলার বক্রেশ্বর মন্দিরের উষ্ণ ঝরনা যেমন জল চিকিৎসার জন্য বিখ্যাত, তেমনি এই মন্দির বাঙালি তীর্থযাত্রীদের সমৃদ্ধ পুণ্যস্থল হিসেবেও বিখ্যাত। নদীয়া জেলার কাটোয়া শহরের (কালীগঞ্জ ব্লক) কাছে কালীপীঠ ও জয়দুর্গা মন্দির এবং বর্ধমান জেলার কোগ্রামের (মঙ্গলকোট ব্লক) মঙ্গলচন্ডী মন্দিরে প্রধানত পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলির পুণ্যার্থীরাই কেবল যাওয়া-আসা করে। তবে মধ্যযুগে নাটোরের রাজা ও বর্ধমানের রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় এই স্থানগুলি সমৃদ্ধি অর্জন করেছিল। আধুনিক কালে সেগুলিই সবচেয়ে জনপ্রিয় জায়গা যেখানে বাণিজ্য ও পরিবহণ অবকাঠামোর উন্নতিকল্পে বিনিয়োগ করা হয়েছে এবং দূরবর্তী স্থান থেকে আগত লোকজনদের আকৃষ্ট করতে অন্য সুবিধাদিও গড়ে তোলা হয়েছে।

আরও কিছু পীঠ আছে যেগুলি একই নাম বহন করে এবং এগুলি একই রকম শাক্তপীঠ বলে অনেকে মনে করেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ, দুটি অট্টহাস মন্দিরকে শাক্তপীঠ ধরা হয়। একটি বীরভূম জেলার লাভপুর শহরের (লাভপুর বিভাগ) কাছে, এবং অন্যটি বর্ধমান জেলার দক্ষিণ ডিহি (কেতুগ্রাম বিভাগ) গ্রামে। পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলিতে এই মন্দিরগুলির অনেক ভক্ত পূজারী রয়েছে এবং অতীতে এগুলি পরিচালিত হতো স্থানীয় শ্রমজীবী ও জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায়। বীরভূম জেলার বোলপুর শহরের কাছে কাঁকালিতলা মন্দির একটি পীঠ হিসেবে ‘কাকী’ নামের সঙ্গে একীভূত হয়েছে। ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের চেন্নাইয়ের (মাদ্রাজ) কাছে ‘কাঞ্চীপুরম’ নামে অন্য একটি শাক্তপীঠ আছে। দক্ষিণ ভারতে কাঞ্চীপুরম একটি প্রসিদ্ধ তীর্থকেন্দ্র এবং লোকজন একে দক্ষিণের বেনারস (বারাণসি) বলে। শ্রী মদন গুপ্তের ডাইরেক্টরি পঞ্জিকায় উজ্জয়িনী নামটি ভারতের মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের বিখ্যাত তীর্থস্থান উজ্জয়িনীর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। স্থানটি ত্রিবার্ষিক মহতী কুম্ভমেলা উৎসবের জন্য সুপ্রসিদ্ধ। এই নামটি মঙ্গলকাব্য-এ উল্লেখ করা হয়েছে, এটি বাংলায় বর্ধমান জেলার নতুন হাট শহরের (মঙ্গলকোট বিভাগ) কাছে কোগ্রামের উজ্জয়িনীর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে। স্থানটি মনসামঙ্গল কাব্যে বর্ণিত নায়িকা বেহুলার বিয়ের উৎসবস্থল হিসেবে বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ।

১৬৯০-১৭২০ খ্রিস্টাব্দে রচিত মহাপীঠ নিরূপণ গ্রামবাংলায় বেশ কয়েকটি পীঠের নাম উল্লেখ করেছে এবং সেগুলি পূর্ব ভারতে তান্ত্রিক দর্শনের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে জনপ্রিয়ও হয়েছে। এগুলির মধ্যে আটটি নলহাটি, কালীঘাটা (কালীপীঠ), বক্রেশ্বর, যশোরা, অট্টহাস, নন্দীপুর, লঙ্কা ও বিরাট পীঠস্থান পশ্চিমবঙ্গে খুব বিখ্যাত। এইসব পীঠের নামগুলি বর্তমান সময়ের নামগুলির অনুরূপ। নলহাটি, বক্রেশ্বর, অট্টহাস ও নন্দীপুর বীরভূম জেলায়, এবং কালীপীঠ নদীয়া জেলার কাটোয়া শহরের কাছে অবস্থিত। যশোরা ভারতের সীমান্তসংলগ্ন বাংলাদেশের শহর যশোরের নিকটস্থ সাতক্ষীরা জেলায় অবস্থিত। কয়েকটি স্থান পীঠরূপে বেশ দীর্ঘদিন ধরে পরিচিত। হিন্দুসমাজে এগুলি অভূতপূর্ব প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। পরন্তু, এই পবিত্র স্থানগুলি বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্যবহ এবং প্রকৃতপক্ষে, এগুলির অধিকাংশই গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান হিসেবে বিভিন্ন ইতিহাসগ্রন্থেও উল্লেখিত হয়েছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখযোগ্য, পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার তমলুক শহর যেখানে গর্ব ভীমের মন্দির অবস্থিত, প্রাচীনকালে তাম্রলিপ্ত নামে বিখ্যাত ছিল। সপ্তম শতকে তাম্রলিপ্ত ছিল একটি বৌদ্ধকেন্দ্র এবং মধ্যযুগে দক্ষিণ এশিয়াতে মহাযান বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে একটি অপরিহার্য প্রসঙ্গসূত্র হিসেবে বিবেচিত। হিউয়েন-সাঙ (৬০২-৬০৪) ও -ৎসিঙ (৬৩৫-৭১) এই স্থান ভ্রমণ করেছেন এবং তাঁদের বিখ্যাত গ্রন্থগুলিতে এর নাম উল্লেখ করেছেন। ষোড়শ শতকের সূচনায় ত্রিপুরার হিন্দু রাজা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুন্ড পাহাড়ে ও উপত্যকাতে একটি পীঠস্থান প্রতিষ্ঠা করেন। এটি বৌদ্ধদের জন্যও একটি বিখ্যাত তীর্থকেন্দ্র, যেহেতু চন্দ্রশেখর পাহাড়ের চূড়ায় বুদ্ধের পদচিহ্ন এখনও বিরাজমান।

বর্ধমান জেলার ক্ষীরগ্রাম (মঙ্গলকোট বিভাগ) নামের আদি উৎস কলকাতাস্থ এশিয়াটিক সোসাইটিতে সংরক্ষিত পবিত্র পান্ডুলিপি কুব্জিকা তন্ত্রের শ্লোকগুলিতে সন্ধান করা যেতে পারে। গ্রামের ও দেবীর তথ্যপ্রসঙ্গ অন্যান্য সংস্কৃত সাহিত্য বিষয়ক রচনাগুলিতেও, যেমন নীলতন্দ্র, রুদ্রযমালয়তন্ত্র, শিবচরিত, শাক্তানন্দ-তরঙ্গিণী এবং মহাপীঠ নিরূপণ ও মঙ্গলকাব্যেও পাওয়া যেতে পারে। ক্ষীর গ্রামের বর্তমান মন্দিরটি বর্ধমানের রাজা কীর্তিন্দ্র (১৭০২-১৭৪০) ১৭৩০-এর দিকে নির্মাণ করেছিলেন। কিরিটেশ্বরী গ্রাম নাটোরের জমিদার রামকৃষ্ণের তন্দ্রানুশীলনের স্থান হিসেবে বিখ্যাত। এই স্থানটি আরও সুপরিচিত নবাব আলীবর্দি খানের (১৭২৫-৩৯) জন্য, যিনি প্রত্যেক বছর, হোলির (দোল যাত্রা) বসন্ত উৎসব উপলক্ষে হিন্দুদের সঙ্গে নিজেও রঙিন গুঁড়ো বা আবীরে রঞ্জিত হতেন। এতসব বিভিন্ন অনুষঙ্গে বিজড়িত ঐতিহাসিক স্থলগুলিকে বেশির ভাগ লোক মহাপীঠ রূপে স্বীকার করে নিয়েছে এবং তর্কাতীতভাবে এগুলি বাংলার পীঠস্থান হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।

বাংলাদেশে শাক্তপীঠ  মহাপীঠ নিরূপণ বাংলাদেশে সাতটি পীঠ শনাক্ত করেছে। শিবচরিত সাতক্ষীরা জেলার ঈশ্বরীপুর গ্রামের যশোরেশ্বরী কালী মন্দিরকে অন্যতম উপপীঠ হিসেবে উল্লেখ করেছে। বলা হয়, যশোর জেলার নাম ওই একই নামের দেবী থেকে উদ্ভূত। চট্টগ্রামের উপকণ্ঠে কন্যাশ্রম মন্দিরও অন্যতম পীঠ; কিন্তু কেবল স্থানীয় লোকজনই এই মত সমর্থন করে, কারণ বেণীমাধব শীলের ফুল পঞ্জিকায় ভারতের রাজস্থান রাজ্যের স্বতন্ত্র একটি গ্রাম সম্পর্কে এই নামটি উল্লেখ করা হয়েছে। ব্রিটিশ আমল থেকে দুটো মন্দিরই স্থানীয় রাজা ও জমিদারদের পারিবারিক সদস্যদের সঙ্গে ধর্মীয় সম্পর্ক বজায় রেখেছে। আঠারো শতকে নাটোর রাজের আনুকূল্যে বগুড়া জেলার ভবানীপুর গ্রামের শাক্তপীঠ মা ভবানী মন্দিরের সমৃদ্ধি ঘটেছিল। নাটোরের বিখ্যাত রানী ভবানীর নামে মন্দিরটির নামকরণ করা হয়।

জমিদারি প্রথা বিলোপের পর, রাজার পরিবারের বংশধররা ভারতে চলে যায় এবং ভূসম্পত্তিতে রাজার ব্যক্তিগত নাম স্টেট ম্যানেজারের অফিসে স্থানান্তরিত হয়। কলকাতায় বসবাসরত পরিবারের সদস্যরা তখনও বাৎসরিক উৎসবাদিতে মন্দিরের জন্য অর্ঘ্য পাঠাতেন। এখন ভবানী মন্দিরের ধর্মীয় কৃত্য নাটোরের স্টেট ম্যানেজার কর্তৃক নিয়োজিত এক অবধায়কের (নায়েব) তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। সুন্দরবনের কিংবদন্তিতুল্য রাজা প্রতাপাদিত্যকে সাতক্ষীরার যশোরেশ্বরী কালী মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা বলে ধারণা করা হয়। এলাকাটির সর্বত্র প্রাচীন রাজধানীর কিছু ধ্বংসাবশেষ আছে। বর্তমান মন্দিরটি একটি চমৎকার দ্বিতল ভবন, ধ্বংসাবশেষের পাশে এটি নির্মাণ করেছে প্রভূত ভূসম্পত্তির মালিক চট্টোপাধ্যায় পরিবার। প্রচলিত মৌখিক কাহিনী হলো, দেশের এই অংশে চট্টোপাধ্যায় পরিবার এসেছিলেন রাজা প্রতাপাদিত্যের সময়ে এবং তারা রাজ পরিবারের পুরোহিত রূপে কাজ করতেন। ঢাকায় বসবাসরত পরিবারের সদস্যরা এখনও বার্ষিক উৎসবের ব্যবস্থাপনার ভার বহন করেন। অন্য মন্দিরগুলি মন্দির-কমিটি দ্বারা পরিচালিত। আঠারো শতকে সিলেট জেলার কানাইঘাট থানার বউরুভাগ গ্রামে বামযজ্ঞ মন্দির খাসিয়া রাজের পৃষ্ঠপোষকতায় সমৃদ্ধ হয়ে বিশেষ খ্যাতি পেয়েছিল।

১৯৪৭-এ পাকিস্তান সৃষ্টির পরে, বেশিরভাগ রাজপরিবার ভারতের মেঘালয় রাজ্যে আশ্রয় নেয়। স্থানীয় হিন্দুরা মন্দিরের উৎসবাদি ও দেবোত্তর পরিচালনার জন্য মন্দির কমিটি গঠন করে। সিলেট শহরের সন্নিকটে মহালক্ষ্মী মন্দির ব্রিটিশ আমলে স্থানীয় জমিদারের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিল এবং ভারতে তাদের আশ্রয় নেওয়ার পর স্থানীয় হিন্দুরা ১৯৬০ সালে মন্দির পরিচালনার জন্য একটি কমিটি গঠন করেছিল।

সীতাকুন্ডের পবিত্র ভূমির আরও প্রাচীন ঐতিহাসিক পটভূমি রয়েছে। বহু মন্দির, পবিত্র জলাশয় ও তীর্থযাত্রীদের জন্য অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাসহ জলপ্রপাতবিশিষ্ট পাহাড়বেষ্টিত জায়গাটি একটি বিশাল ধর্মীয় স্থান। এটিকে কখনও কখনও বাংলায় হিন্দুর সর্বপ্রাচীন পবিত্র স্থল হিসেবে উল্লেখ করা হয়। সীতাকুন্ডের বর্তমান হিন্দু মন্দিরটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ত্রিপুরার রাজা ধর্মমাণিক্য। ১৪২৩ শকাব্দে রাজা ধর্মমাণিক্য মন্দির ভবন নির্মাণ করেছিলেন এবং পার্শ্ববর্তী পাহাড়ি ভূমিসহ চারশ একরেরও বেশি জমি দেবোত্তর হিসেবে দান করেছিলেন। এখানে একটি বৌদ্ধবিহার রয়েছে যেখানে আরাকান রাজা বুদ্ধের দেহভস্ম এনে সংরক্ষণ করেন বলে বিশ্বাস করা হয়। বস্ত্তত মধ্যযুগ থেকেই সীতাকুন্ড বৌদ্ধদের জন্য যেমন, তেমনি হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্যও তীর্থকেন্দ্র হিসেবে বিখ্যাত। চৈত্রের শেষ দিন অনুষ্ঠিত প্রত্যেক বসন্ত উৎসবে হাজার হাজার তীর্থযাত্রী ও সাধু সন্ন্যাসী উপমহাদেশের সব এলাকা থেকে স্থানটিতে আসেন।

বাংলার প্রত্যেকটি মন্দির নিজস্ব ভঙ্গিতে নানা সময়ে স্থানীয় রাজা ও জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় শাক্তপীঠ হিসেবে গড়ে উঠেছে। তবে অনেক পীঠ আছে যেগুলির সময় নিরূপণ দুঃসাধ্য। কিছু পীঠের সময়কাল যেমন সীতাকুন্ড ও তমলুকের পীঠ প্রাচীন সময়ের বৌদ্ধযুগ পর্যন্ত প্রসারিত। কোন কোন ক্ষেত্রে এই বিখ্যাত পীঠস্থানগুলি আশপাশের মানুষের ধর্মকেন্দ্র রূপে স্থানীয় শাসক ও জমিদারদের আকর্ষণ করেছিল; কারণ তারা এগুলিকে কেন্দ্র করে জমি দান ও মন্দির স্থাপনের মধ্য দিয়ে স্ব স্ব ক্ষমতা বৃদ্ধি করার প্রয়াস পেতেন। বর্তমান যুগে বাংলাদেশে স্থানীয় অভিজাতদের ব্যক্তিগত দান নয়, বরং সাধারণ মানুষের স্বতঃপ্রবৃত্ত প্রয়াসেই শাক্তপীঠের ব্যবস্থাপনা চলছে।  [মাসাহিকো তাগাওয়া]