শবর

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৮:৪০, ১২ মার্চ ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

শবর  ব্রিটিশ শাসনের মাঝামাঝি শবররা উত্তর ভারত থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। তখন তারা যাযাবর ও শিকারী ছিল। পরে তারা চা শ্রমিক হিসাবে মৌলভীবাজার জেলার হরিণছড়া, রাজঘাট ও নন্দরাণী এলাকায় বসবাস করতে থাকে। বর্তমানে এদেশে শবরদের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার।

সমগ্র শবর সমাজ কয়েকটি গোত্রে বিভক্ত। যেমন বড়ভুক্ত, ছোটভুক্ত, নায়েক, কোটাল ও আখারী। শবর সমাজে নিজ গোত্রমধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক নিষিদ্ধ। বর্ণহিন্দুরা তাদেরকে হেয় চোখে দেখে এবং ব্রাত্য জনগোষ্ঠী বলে আচরণ করে। তাদের সমাজে একবিবাহ এবং বিবাহবিচ্ছেদ প্রথা চালু রয়েছে। বিবাহবিচ্ছেদ হলে সন্তানসন্ততি পিতার কাছেই থাকে। বিবাহবিচ্ছেদের পর পুনর্বিবাহ হতে পারে। বিধবাবিবাহের প্রথাও তাদের সমাজে বিদ্যমান। সধবা মহিলারা সিঁথিতে সিঁদুর ও হাতে শাঁখা পরিধান করে। সাধারণত মেয়ের বয়স পনেরো এবং ছেলের বয়স আঠারো হলে বিবাহযোগ্য বলে বিবেচিত হয়। শবর সমাজে যৌথ পরিবার প্রথাও দেখা যায়। বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি পরিবারের অভিভাবক। তার নির্দেশানুযায়ী সবাই চলে। বধূরা শ্বশুর, ভাসুরকে সশ্রদ্ধভাবে এড়িয়ে চলে। সেরূপ জামাতারাও শ্বাশুড়ি, স্ত্রীর বড়বোনকে সশ্রদ্ধভাবে এড়িয়ে চলে। ব্যভিচার, ধর্ষণ, চুরি প্রভৃতি অপকর্মের বিচার সমাজপ্রধান কর্তৃক পরিচালিত হয়ে থাকে। সমাজপ্রধান তথা মুরুববী অর্থদন্ড বা একঘরে করার মাধ্যমে দোষী ব্যক্তির শাস্তিবিধান করে থাকেন। আন্তঃগোত্রীয় সমস্যা নিরসনের জন্য তারা গ্রাম পঞ্চায়েতের দ্বারস্থ হয়। পারিবারিক কাজকর্ম ছাড়াও চা বাগানে নারীরা শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। পারিবারিক ব্যাপারে তারা মতামত প্রদান করতে পারে না বরং সর্বক্ষেত্রে পুরুষের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। পরিবারের পুত্রসন্তান সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়।

বিদ্যালয়ে শিক্ষাগ্রহণ ও অন্য সবার সঙ্গে যোগাযোগে তারা বাংলা ভাষা ব্যবহার করে থাকে। নিজেদের মধ্যে কথোপকথনের সময় তারা হিন্দী ব্যবহার করে। শবর সমাজে শিক্ষার হার ১০%। আর্থিক কারণে পিতামাতা নিজ সন্তানদেরকে বিদ্যালয়ে পাঠাতে চায় না।

শবর জনগোষ্ঠী ধর্মবিশ্বাসে হিন্দু। তারা তাদের আদিধর্মও পালন করে। লক্ষ্মীদেবী এবং মঙ্গলচন্ডীকে তারা পারিবারিক দেবী হিসাবে উপাসনা করে এবং এই সব দেবীর জন্য বেদি নির্দিষ্ট করা থাকে। তারা দুর্গা ও কালীদেবীর পুজাও করে থাকে। এই সমস্ত পুজা অর্চনায় তারা ব্রাহ্মণ পুরোহিতের সাহায্য গ্রহণ করে। পাপ-পুণ্য, স্বর্গ-নরক সম্পর্কে তাদের স্বচ্ছ ধারণা বিদ্যমান। তারা পুনর্জন্মে বিশ্বাসী এবং বর্তমান কর্মফলকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। দুর্গোৎসব ও ফাগুয়া প্রভৃতি তাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। তারা ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈশ্য প্রভৃতিদেরকে উঁচু শ্রণির মনে করে এবং তাদের হাত থেকে খাবারাদি গ্রহণ করে। অপরপক্ষে সমশ্রেণীর কিছু গোত্রকে নিচুশ্রেণীর মনে করে এবং তাদের কোনো খাবারাদি গ্রহণ করেনা। আন্তঃজাতিগোষ্ঠিক বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন থেকেও তারা বিরত থাকে। অবশ্য অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের সম্প্রীতি বিদ্যমান দেখা যায়।

শবর সমাজে বিয়ের প্রস্তাব চূড়ান্ত হওয়ার পর উলুধ্বনির মাধ্যমে সর্বসাধারণের নিকট প্রকাশ করা হয় এবং বরের পিতামাতা অথবা অভিভাবকগণ কনে দেখে। বরের পিতা পাড়াপ্রতিবেশীর জন্য ভোজের ব্যবস্থা করে। একে বলা হয় মঙ্গলাচরণ অনুষ্ঠান। বিবাহের দিন প্রত্যুষেই বরকনে উভয়ে অধিবাস শুরু করে। একজন ব্রাহ্মণ বৈদিক মন্ত্রপাঠের মধ্য দিয়ে কন্যা সম্প্রদান অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেন। বিবাহে যৌতুকপ্রথাও বিদ্যমান। বিবাহের চারদিন পর বরের পিতৃগৃহে বরকনে উভয়ে একটি হলুদে ছোপানো কাপড় একত্রে কাচে। এটি হলো হলুদ কাপড় কাচা অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে বরের পিতা একটি ভোজের আয়োজন করে।

শবর জনগোষ্ঠী মৃতদেহ দাহ করে। মৃত ব্যক্তির নিকটাত্মীয়েরা দশদিন অশৌচকাল পালন করে। এ সময়ে তারা হবিষ্যান্ন আহার করে, ভূমিশয্যায় শয়ন করে এবং একবস্ত্রে থাকে। দশদিন শেষে নাপিত এসে অশৌচকাল পালনকারী পুরুষ সদস্যদের মাথার চুল কামিয়ে দেয়। একাদশ দিনে শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান পালিত হয়। শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে ব্রাহ্মণভোজন করানো হয় এবং শোকপালনকারীরা স্বাভাবিক আহার গ্রহণ করে। শবররা মৃত ব্যক্তির দেহভস্ম গঙ্গায় বিসর্জন দেয়। তারা পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে পিন্ডদান করে।  নারায়ণগঞ্জের লাঙ্গলবন্দে অথবা সীতাকুন্ডের চন্দ্রনাথে তারা পিন্ডদান করে থাকে। তখন হিন্দু ব্রাহ্মণেরাই তাদেরকে সহযোগিতা করে থাকে।

শবররা বিভিন্ন সামাজিক উৎসবাদিতে নানা গল্পকাহিনী লোকগাথা শ্রবণ করে আনন্দ পায়। সমাজের কথকরা নিপুণভাবে গল্পকাহিনী বা লোকগাথা বিভিন্ন উৎসবে পরিবেশন করে। বিভিন্ন উৎসবে নাচগানও পরিবেশন করা হয়। শবর মহিলারা গৃহপ্রাঙ্গণে সুদৃশ্য আল্পনা অঙ্কন করে। হোলি উৎসবে শবর সমাজের নারী-পুরুষ নৃত্যগীতের মাধ্যমে আনন্দ উপভোগ করে। [সুভাষ জেংচাম]