লিটন, এডওয়ার্ড রবার্ট
লিটন, এডওয়ার্ড রবার্ট (১৮৩১-১৮৯১) ১৮৭৬ হতে ১৮৮০ পর্যন্ত ভারতের ভাইসরয় এবং গভর্নর জেনারেল ছিলেন। উপন্যাসিক এডওয়ার্ড বুলওয়ার লিটনের পুত্র রবার্ট লিটন (লিটনের প্রথম আর্ল) ইংল্যান্ডের হ্যারো এবং জার্মানীর বন এ শিক্ষাগ্রহণ করেন। পন্ডিত ও সুবক্তা রবার্ট লিটন কূটনৈতিক কোরের সদস্য হিসেবে বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় রাজধানীতে কর্মরত ছিলেন।
ভারতে তাঁর দিনগুলি ছিল ঘটনাবহুল। ১৮৭৬ হতে ১৮৭৮ পর্যন্ত দুবছর মাদ্রাজ, বোম্বাই, হায়দ্রাবাদ এবং মহীশূরসহ দক্ষিণ ভারতের প্রায় সবটা জুড়ে এক প্রচন্ড দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। দ্বিতীয় বছরে দুর্ভিক্ষ মধ্যভারত এবং পাঞ্জাবে আঘাত হানে এবং পরিণামে বিপুল সংখ্যক লোক প্রাণ হারায়। ত্রাণ ব্যবস্থায় দশ কোটি রূপীর উপর ব্যয় হয় এবং শষ্যহানির ফলে বিপুল রাজস্ব ঘাটতি দেখা দেয়। সুতরাং লর্ড লিটনের সরকার রিচার্ড স্ট্র্যাচির নেতৃত্বে দুর্ভিক্ষের কারণ এবং জনগণের দুর্দশা লাঘবের জন্য গৃহীত ত্রাণ ব্যবস্থা খতিয়ে দেখার জন্য একটি ত্রাণ কমিশন নিয়োগ করেন। এ কমিশনের প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে একটি দুর্ভিক্ষ কোড তৈরি করা হয়। এতে ভবিষ্যতে দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা করার ব্যবস্থাদি সম্পর্কিত কয়েকটি আইন অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। জীবন বাঁচাতে সরকারি প্রচেষ্টাসমূহ অপ্রতুল ছিল। তবু ভাইসরয় রানী ভিক্টোরিয়ার ‘ভারত-সম্রাজ্ঞী’ উপাধি গ্রহণ উৎসব পালনের জন্য ১৮৭৭ সালে দিল্লিতে এক আড়ম্বরপূর্ণ দরবার অনুষ্ঠান করেন।
পরিষদের নতুন অর্থ-সদস্য জন স্ট্রাচি কর্তৃক সম্পাদিত রাজস্ব সম্পর্কিত কতিপয় সংস্কারের জন্যও লর্ড লিটনের প্রশাসন উল্লেখযোগ্য ছিল। লবণের উপর কর সঙ্গতিপূর্ণ করা হয় এবং আয়কর প্রবর্তন করা হয়। মুক্ত বাণিজ্যের নামে লন্ডনের নির্দেশক্রমে তিনি সুতি বস্ত্রের উপর শুল্ক রহিত করেন। এ পদক্ষেপটি ভারতে বিকাশমান বস্ত্রশিল্পের ক্ষতির কারণ হয়ে প্রকৃতপক্ষে ল্যাংকাশায়ারের বয়নশিল্পকে সাহায্য করে। ১৮৭৯ সালে সংবিধিবদ্ধ সিভিল সার্ভিস প্রতিষ্ঠা করে লর্ড লিটন এতদিন ধরে চুক্তিবদ্ধ চাকরির জন্য রক্ষিত ছয় ভাগের একভাগ পদ তুলে দিয়ে সকল ভারতীয়দের জন্য ভারতীয় সিভিল সার্ভিস উন্মুক্ত করে দেন। এতে ১৮৫৩ সালের সনদ আইনের প্রতিশ্রুতি পূরণ হয় এবং ১৮৫৮ সালের রানীর ঘোষণাকে পুনরায় নিশ্চিত করে। ১৮৭৮ সালে লিটন বহুল আলোচিত ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট পাস করেন। এ আইনের বলে একজন ম্যাজিস্ট্রেট সরকারের বিরুদ্ধে বা বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করতে পারে এমন কোন সংবাদ প্রকাশ না করার জন্য স্থানীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদ পত্রের সম্পাদককে বাধ্য করতে পারতেন।
এ আইনটি তাঁর উত্তরাধিকারী লর্ড রিপন চার বছর পর বাতিল করেছিলেন। লর্ড লিটনের আফগান নীতি এবং সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতির অনুসরণে ১৮৭৮ সালে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ইংল্যান্ড এবং ভারতে নিন্দিত হয়। দ্বিতীয় আফগান যুদ্ধ (১৮৭৮-৮০) ব্যাপক প্রাণহানি ঘটায় এবং এতে অর্থব্যয় হয় প্রচুর এবং শেষ পর্যন্ত তার প্ররোচনামূলক কুটনীতি অকেজো কূটনীতি বলে প্রমাণিত হয়। গ্ল্যাডস্টোন তার আফগান নীতির তীব্র সমালোচনা করেন। ১৮৭৮ থেকে ৮০ সালের দুর্ভিক্ষে বিপুল সংখ্যক লোকের প্রাণহানি, স্থানীয় ভাষায় সংবাদ পত্রগুলির স্বাধীনতা হরণের জন্য গৃহীত পদক্ষেপসমূহ এবং আফগান যুদ্ধের বিপুল ব্যয় লর্ড লিটনের বিরুদ্ধে সমালোচনার বিশাল ক্ষেত্র প্রস্ত্তত করে। ১৮৮০ সালে গ্ল্যাডস্টোন ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করলে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে পদত্যাগ করেন। ১৮৮০ সালে তাঁকে আর্ল-পদ প্রদান করা হয় এবং পরবর্তীকালে তিনি ১৮৮৭ হতে ১৮৯১ পর্যন্ত ফ্রান্সে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৮৯১ সালের ২৪ নভেম্বর লিটনের প্যারিসে মৃত্যু হয়। [কে.এম মোহসীন]