গ্রাফিক ডিজাইন
গ্রাফিক ডিজাইন নকশা, প্রতীক ও উপস্থাপনা সংশিলষ্ট সুপ্রাচীন নন্দনশিল্পের আধুনিক পরিভাষা। এ পরিভাষার আওতাভুক্ত হয়েছে টেলিভিশন থেকে পত্রপত্রিকা, গ্রন্থাদি ও যাবতীয় প্রকাশনা, বিলবোর্ড, নিওন সাইন, সাইনবোর্ড, ব্যানার, ফেস্টুন প্রভৃতি শিল্প মাধ্যম। নন্দনশিল্প হিসেবে গ্রাফিক ডিজাইন এখন একাডেমিক শিক্ষার অন্তর্গত। অপরদিকে পেশাশিল্প হিসেবে এটি প্রকাশনা, প্রচার, প্রিন্ট ও ডিজিটাল মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত একটি সৃজনশীল প্রক্রিয়া। ছাপা পদ্ধতি উদ্ভাবনের পর থেকে বাণিজ্যিক প্রয়োজনে এ শিল্পমাধ্যমটির নিত্য ব্যবহারের কারণে এটি পরিচিত ছিল বাণিজ্যিক শিল্পকলা (Commercial Art) নামে। তবে জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে রাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক সংগঠন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সাহায্য সংস্থা প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের তথ্য-নির্দেশনা, প্রচার, প্রকাশনা প্রভৃতি কাজে গ্রাফিক ডিজাইনের ব্যবহারও ব্যাপক। এ প্রতিষ্ঠান সমূহের প্রতীক, কালার থিম ও টাইপোগ্রাফি তৈরিতে কনসেপ্ট ও আইডিয়া প্রধান দুটি অনুষঙ্গ। এ কারণে এরূপ নামকরণ। বর্তমান সময়ে গ্রাফিক ডিজাইনকে বলা হয় Visual Communication বা দৃষ্টিনির্ভর ভাষায় যোগাযোগ সৃষ্টির নন্দনশিল্প।
‘গ্রাফিক’ কথাটি ড্রইং, ডিজাইন ও প্রতিচিত্র সম্পর্কিত। আর কোনো বস্ত্ত, বিষয় বা আইডিয়ার শৈল্পিক কল্পনার নকশাকে বলা হয় ডিজাইন। কোনো বিষয় সম্পর্কে তথ্য, পরিচয়, বার্তা, নির্দেশনা বা আইডিয়া দর্শক-গ্রাহকের কাছে আকর্ষণীয় ও সুন্দরভাবে উপস্থাপনের জন্য একটি দৃষ্টিনির্ভর ভাষা অনেক বেশি কার্যকর। এক্ষেত্রে টাইপোগ্রাফি (Typography) ও ইমেজ (Image) এ ভাষা নির্মাণে প্রধান দুটি উপাদান। টাইপোগ্রাফি বলা হয় লিপির একটি সুনির্দিষ্ট ও প্রযুক্তিনির্ভর নান্দনিক রূপায়নকে, আবার টাইপ বা ক্যালিগ্রাফ নিয়ে তৈরি ডিজাইনও টাইপোগ্রাফি। অপরদিকে ইমেজ হলো গ্রাফিক ডিজাইনের শিল্পকর্মে ব্যবহূত ফটোগ্রাফ, ড্রইং, ইলাস্ট্রেশন, ডিজাইন, কোনো আকার আকৃতি, লাইন, টোন বা টেক্সচার।
একটি সৃজনশীল প্রক্রিয়ায় টাইপোগ্রাফিকে ইমেজ সন্নিবেশিত হয়ে এ দৃষ্টিনির্ভর ভাষাটি সৃষ্টি করে। এ ভাষায় তথ্য, বক্তব্য বা আইডিয়া প্রকাশের মাধ্যম হলো লোগো, পোস্টার, বইয়ের প্রচ্ছদ, ইলাস্ট্রেশন, বিজ্ঞাপন, প্যাকেজিং, ওয়েবপেইজ ইত্যাদি। এখানে টাইপোগ্রাফি ও ইমেজ এককভাবে কিংবা সমন্বি^ত কম্পোজিশনে তথ্যের বা আইডিয়ার একটি প্রতিনিধিত্বমূলক স্বত্ত্বা তৈরি করে, যা দৃষ্টির মধ্য দিয়ে দর্শকের উপলব্ধিতে চিত্রিত হয়। সময়ক্রমে এ স্বত্ত্বাটি দর্শক-গ্রাহকের স্মৃতিতে স্থায়িভাবে চিহ্নিত হয় স্টাইল, প্রতীক বা রূপক হিসেবে। গ্রাফিক ডিজাইন এ পর্যায়ে বিষয়টির প্রতি দর্শক-গ্রাহকের মনোযোগ আকর্ষণ করে, আগ্রহ ও সমর্থন সৃষ্টি করে, চিন্তাকে আধুনিক করে, দর্শককে উদ্দীপ্ত-উদ্বুদ্ধ করে ও আনন্দ দেয়। এভাবে একটি অনুভবের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। এটাকেই বলা হয় Visual Communication বা চোখে দেখে চেনা। যেমন, একটি তীর চিহ্ন আমাদেরকে দিকের নির্দেশনা দেয়। অর্ধচন্দ্র বা যোগচিহ্নের মত ঘন লাল আকৃতি চিকিৎসা সম্পর্কিত বিষয়কে বোঝায়। সবুজ আয়তক্ষেত্রে লাল বৃত্ত স্থাপিত হলেই সেটি সরাসরি বাংলাদেশকে উপস্থাপন করে। তেমনিভাবে ‘V’ হরফটি স্কুলছাত্রদের কাছে ল্যাটিন ৫ সংখ্যাকে উপস্থাপন করে, নীল প্রেক্ষাপটে উড়ন্ত পায়রার সাদা ফর্মের সঙ্গে হরফটি Victory বা স্বাধীনতাকে প্রকাশ করে ইত্যাদি।
প্রধানত চারটি বিষয়ের তথ্য, পরিচয়, বার্তা, নির্দেশনা ও আইডিয়া উপস্থাপনের জন্য গ্রাফিক ডিজাইনের মাধ্যমে শিল্পকর্ম (Artwork) তৈরি করা হয়। এগুলো হলো-১. ইনস্টিটিউশন: রাষ্ট্র, সংস্থা, বাহিনী, ফাউন্ডেশন, সংগঠন, প্রতিষ্ঠান, সমিতি, ব্যক্তি। (রাষ্ট্রীয় প্রতীক, রেডক্রস, চাঁদতারা, স্বস্তিকা, রবীন্দ্রনাথের ‘র’ প্রতীক, সীলমোহর) ২. প্রকাশনা/প্রোডাক্ট: টাইপ সেট, বই, পত্রিকা, পোস্টার, টি শার্ট, প্যাকেজিং। ৩. সার্ভিস: শিক্ষা, উন্নয়ন, পর্যটন, হোটেল, চিকিৎসা, টেলিফোন, সেন্টার। ৪. ইভেন্ট: উৎসব, প্রদর্শনী, বার্ষিকী, সম্মেলন, অভিযান, সভা, কর্মশালা, আয়োজন।
শিল্পকর্মের ক্ষেত্রসমূহ-১. লোগো বা মনোগ্রাম, পিকটোগ্রাম ২. টাইপোগ্রাফি, ক্যালিগ্রাফি ৩. পোস্টার, শো-কার্ড, বিলবোর্ড ৪. বইয়ের প্রচ্ছদ, পত্রিকার ফিচার পেইজ, ওয়েব পেইজ ৫. ইলাস্ট্রেশন, ড্রইং, কার্টুন, ডিজাইন, গ্রাফিক্স ৬. বিজ্ঞাপন, লিফলেট, ফোল্ডার, টিভি টেলপ ৭. প্যাকেজিং, হ্যাংগিং ৮. স্ট্যাম্প, বন্ড, কারেন্সি নোট ৯. ক্যলেন্ডার, ম্যাপ, গ্রাফ চার্ট ১০. অ্যানিমেশন, লেজার ডিসপ্লেল ইত্যাদিভাবচিন্তার রূপদৃশ্য প্রকাশের সৃজনশীল প্রক্রিয়া হিসেবে গ্রাফিক ডিজাইনের চর্চা ভিন্ন আঙ্গিকে প্রাচীনকাল থেকেই বিশ্বব্যাপী বিদ্যমান। প্রাচীন গুহাচিত্রে সুদৃশ্য বাইসনের পাশে সংক্ষিপ্ত প্রতীকী স্টাইলে চিত্রিত শিকারীর ছবিগুলি সরল সাধারণ ইলাস্ট্রেশন বলে মনে হয় না। এগুলি শিকার সম্পর্কিত তথ্য, নির্দেশনা বা ব্রতযজ্ঞ পালনের আইডিয়া হতে পারে। এ শিল্পকর্মগুলি দৃষ্টিনির্ভর ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন। এভাবে মেসোপটেমিয় কিউনিফর্ম, মিশরের হায়েরোগিলফিক বা সিন্ধুর সিলমোহরের প্রতীক চিহ্ন ও চিত্রের মাধ্যমে প্রাচীন সভ্যতায় মানুষ তাদের ভাবচিন্তা প্রকাশ করতো। প্রাচীন অশোকলিপি থেকে ভারতীয় উপমহাদেশের টাইপোগ্রাফির উৎপত্তি এবং এর বিবর্তনের পরম্পরায় বাংলা টাইপোগ্রাফি বর্তমান রূপ পেয়েছে। তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক বিস্তার যেভাবে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করছে, অডিও ভিজ্যুয়াল প্রযুক্তি এক্ষেত্রে এক উল্লেখযোগ্য সহায়ক। এ ভিজ্যুয়াল কমিউনিকেশনের কার্যকর ও নান্দনিক মাধ্যমটিই হলো গ্রাফিক ডিজাইন। [মাকসুদুর রহমান]