লাউ-কুমড়া
লাউ-কুমড়া (Gourd) Cucurbitaceae গোত্রের শক্ত খোলকবিশিষ্ট সবজি হিসেবে ব্যবহূত কয়েক ধরনের ফল। লাউ-কুমড়া জাতীয় উদ্ভিদ প্রজাতিগুলির সবাই লতানো বর্ষজীবী। বাংলাদেশে সবচেয়ে পরিচিত লাউ-কুমড়ার মধ্যে উলেখযোগ্য হলুদ ফুলবিশিষ্ট মিষ্টিকুমড়া (Cucurbita maxima), সাদা ফুলবিশিষ্ট লাউ/কদু (Lageneria vulgaris) এবং চালকুমড়া (Benincasa hispida)।
লাউ-কুমড়ার দলে আর যেসব ফল-সবজি অন্তর্ভুক্ত করা হয় সেগুলির মধ্যে রয়েছে উচ্ছে বা করলা, ঝিঙা, কাঁকরোল, চিচিঙ্গা এবং ধুন্দুল। এসব সবজি অনাদিকাল থেকেই মানুষ আবাদ করছে। প্রকৃতপক্ষে মিষ্টিকুমড়া এবং লাউ-এর বন্যজাত কোথায়ও দেখা যায় নি। বাংলাদেশে অধিকাংশ লাউ-কুমড়া জাতীয় সবজি বসতবাড়ির আঙিনাতেই মাচায় অথবা ঘরের চালে জন্মানো হয়।
লাউ (Bottle gourd) উষ্ণমন্ডলীয় সবজি। সাধারণত রবি ফসল হিসেবে বপন করা হয়। সম্ভবত উষ্ণ ও উপউষ্ণ এলাকা এদের আদি নিবাস। লাউ কেরোটিন, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ। এদেশে লাউয়ের চাষ হয় প্রায় ১০,০০০ হেক্টর জমিতে, ফলন হয় প্রায় ৬২,০০০ মে টন। সরাসরি বীজ বপন কিংবা ১৫-২০ দিনের চারা রোপণের মাধ্যমে চাষ করা যায়। লাগানোর ৫৫-৬০ দিনের মধ্যে ফলন শুরু হয়। হেক্টরপ্রতি ফলন হয় ৩৫-৪০ মে টন। লাউয়ের কয়েকটি জাত রয়েছে যেমন, বিরি-লাউ ১, ক্ষেতলাউ, হাজারি-লাউ ইত্যাদি। লাউ প্রধানত মাছের নানা ব্যঞ্জনের সবজি। লতা ও পাতা সুস্বাদু শাক। দুধ ও চিনিসহ কচি লাউের মিষ্টান্ন বেশ জনপ্রিয়।
মিষ্টিকুমড়া (Pumpkin) গ্রীষ্ম-বর্ষার জনপ্রিয় সবজি। এটি শর্করা, ভিটামিন ‘এ’ ও ‘সি’ এবং খনিজের উত্তম উৎস। বাংলাদেশে চাষাধীন জমি প্রায় ১৪,০০০ হেক্টর। এটি উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার স্থানীয় প্রজাতি বলে মনে করা হয়। সরাসরি বীজবপন বা দুই সপ্তাহ বয়সী চারা রোপণের মাধ্যমে চাষ করা যায়। প্রায় ৯০ দিনের মধ্যে ফলন শুরু হয়। বিক্রমপুরী ও বারোমাসী স্থানীয় জাত। হেক্টরপ্রতি গড়পড়তা ফলন ২০-২৫ মে টন। লতা, পাতা, ফুল ও ফল বহুল ব্যবহূত সবজি। ফল তরকারি ও মিষ্টান্ন রান্নায় ব্যবহূত হয়।
চালকুমড়া (Ash gourd) সম্ভবত ভারত উপমহাদেশীয় প্রজাতি। সব ধরনের মাটিতেই জন্মে, তবে ভাল ফলনের জন্য দোঅাঁশ থেকে বেলে-দোঅাঁশ মাটিই উত্তম। বীজবপন শুরু হয় ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাসে। সবুজ ফল তোলা যায় ৪৫-৬০ দিনের মধ্যে। সাদা গুঁড়া-ঢাকা পাকা ফল ৮০-৯০ দিনে হয়। ফলন হয় হেক্টরপ্রতি ২০-৩০ মে টন। কচি লতাপাতা উত্তম শাক। ফলের নানা ব্যবহার রয়েছে যেমন সবজি, মাছ ও অন্যান্য তরিতরকারির সঙ্গে রান্নায়, কখনও ভাজা বা মাষকলাই ডালের সঙ্গে মিশিয়ে ‘বড়ি’ তৈরিতে। পাকা ফলে মোরববাও হয়।
উচ্ছে.করলা (Bitter gourd) গ্রীষ্মকালীন সবজি, Momordica charantea; সম্ভবত এর আদি নিবাস ভারত বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। এটি ক্যারোটিন, ক্যালসিয়াম ও লৌহ সমৃদ্ধ। যেকোন মাটিতেই ফলে, তবে ভাল ফলনের জন্য বেলে-দোঅাঁশ মাটিই উত্তম। বীজ বপন কিংবা ১৫-২০ দিন বয়সী চারা মার্চ-মে মাসে রোপণের মাধ্যমে চাষ শুরু হয়। করলার একটি স্থানীয় জাত ‘গজ করলা’, কিন্তু উচ্ছের কোন বিশেষ জাত নেই। এদেশে উচ্ছে ও করলার ফলন হেক্টরপ্রতি যথাক্রমে ৫ মে টন এবং ১৫-১৮ মে টন। ভাজা ও তরকারিতে এর ব্যবহার জনপ্রিয়।
কাঁকরোল (Teasle gourd) ছোট, উপবৃত্তাকার Momordica dioica, বর্ষার সবজি, সম্ভবত ভারত উপমহাদেশীয়। এর একটি বন্য প্রজাতিও (M. cochinchinensis) আছে। ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহ ও কেরোটিনসমৃদ্ধ এই সবজির চাহিদা রয়েছে দেশে ও বিদেশে। এ সবজি নানা ধরনের মাটিতে জন্মে। মার্চ-এপ্রিলে স্ফীতমূলের মাধ্যমে চাষ শুরু হয়। ফলন শুরু হয় ৯০-১০০ দিনে। স্থানীয় কয়েকটি ভ্যারাইটি মণিপুরী, আমলি, সবুজ, টম্পু ও বর্না টম্পু। ফলন হেক্টরপ্রতি ১০-১২ মে টন। ফল ভাজা এবং অন্যান্য তরিতরকারি, মাছ ও মাংসের সঙ্গে রান্না করে খাওয়া হয়।
ঝিঙ্গা (Ribbed gourd) একটি গৌণ সবজি, Luffa acutangula। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ফলে। এই সবজি শর্করা ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ। মার্চ-এপ্রিল ঝিঙ্গা চাষের অনুকূল সময়। বীজ বপনের ছয় সপ্তাহের মধ্যেই সবজির ফলন শুরু হয়। কচি অবস্থায় এটি সবজি হিসেবে ব্যবহূত হয়। ছোট ফল কখনও কখনও লবণে জারিয়ে সংরক্ষণ করা যায়।
চিচিঙ্গা (Snake gourd) চিচিঙ্গা, Trichosanthes anguina মসৃণ, হালকা সবুজ থেকে সাদা, কখনও ডোরাকাটা, সরু লম্বা ও বেলনাকার। এটি বাংলাদেশের গ্রীষ্মকালীন সবজি। দৈর্ঘ্য ৩০-১০০ সেমি পর্যন্ত। এ সবজি ভিটামিন ‘এ’, ‘সি’ ও ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ। ফেব্রুয়ারি-জুন মাসে মাঠে বীজবপন শুরু হয় এবং দুই মাসের মধ্যে সবজি খাওয়ার উপযোগী হয়। হেক্টরপ্রতি ফলন ১০-১২ মে টন।
ধুন্দুল (Sponge gourd) গ্রীষ্মকালীন সবজি, Luffa cylindrica। মূল আবাস দক্ষিণ আফ্রিকায়। এ সবজি ভিটামিন ‘এ’, ‘সি’, লৌহ ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ। বাংলাদেশে ধুন্দুলের চারা রোপণ করা হয় মার্চ-এপ্রিল মাসে; ৬-৭ সপ্তাহ পর গাছে ফুল ফোটে, ৮ সপ্তাহ পর ফলন দেয়। কচি ফল উত্তম সবজি। হেক্টরপ্রতি ফলন ১০-১৫ মে টন। পরিপক্ক ফলের ছোবড়া বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে স্পঞ্জের মতো ব্যবহূত হয়। [এস.এম মনোয়ার হোসেন এবং এ.কে.এম মতিয়ার রহমান]
আরও দেখুন শাকসবজি।