লাইন সিস্টেম
লাইন সিস্টেম ১৯২০ সালে আসামের কামরূপ ও নওগাঁও জেলায় বাঙ্গালি অভিবাসীদের বসবাসের জন্য একটি সীমারেখা। বিশ শতকের প্রথমার্ধে পূর্ব পাকিস্তান থেকে (বর্তমান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ) মুসলমান জনগণের, বিশেষ করে ময়মনসিংহ জেলার অধিবাসীদের অনেকের আসামের ব্রহ্মপুত্র নদীতীরবর্তী নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে নিজেদের জন্য নতুন করে আবাসন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল। ফলে বিশ শতকের প্রথম দশকে, পূর্ব বাংলা থেকে মুসলমান সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশ আসামে অভিবাসী হয়েছিল (১৯১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী)। লাইন সিস্টেম ছিল মূলত আসাম রাষ্ট্রের স্বদেশীয় সম্প্রদায়কে অভিবাসী মুসলমান বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী থেকে পৃথক করে রাখার বিশেষ এক ব্যবস্থা। আদিবাসী ও বাঙ্গালি অভিবাসীদের মধ্যে নানা কারণে যেন কোন দ্বন্দ্ব সৃষ্টি না হয় এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই লাইন প্রথা প্রবর্তিত হয়।
লাইন সিস্টেম ছিল কতিপয় জেলা পর্যায়ের ব্রিটিশ কর্মকর্তার ব্যক্তিগত উদ্যোগের ফল। নতুন ভূমিতে অভিবাসন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে ভূমি রাজস্ব বৃদ্ধির উপনিবেশিক সরকারের নীতির মত এটা কোন সুস্পষ্ট নীতিমালার অংশ ছিল না। শুধু তাই না, উপনিবেশিক সরকার এবং পরবর্তীকালের আসামের নির্বাচিত সরকারও নিম্ন আসামের জেলা সমূহে এ ব্যবস্থা কার্যকর করার ব্যাপারে কোন প্রকার হস্তক্ষেপই করেনি। তবে গোয়ালপাড়া জেলার ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম ছিল। কারণ সেখানে এ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়নি। লাইন ব্যবস্থায় চার প্রকার ব্যাপক সীমানির্ধারণ নিশ্চিত করা হয়েছিল; (১) শুধুমাত্র আদিবাসীদের জন্য বিশেষ এলাকা সংরক্ষিত রাখা; (২) কেবলমাত্র অভিবাসীদের কৃষির জন্য স্থান নির্দিষ্ট রাখা; (৩) যে সকল গ্রামের ম্যাপের বা ভূমির ওপর সীমারেখা টানা হয়েছিল সেখানে সীমারেখার এক পার্শ্বে আদিবাসীদের আবাস করার এবং অপরপার্শ্ব অভিবাসীদের আবাসনের জন্য চিহ্নিত করে দেয়া এবং (৪) কিছু এলাকা চিহ্নিত হয় যেখানে অভিবাসী এবং স্থানীয় জনগণকে সমষ্টিবদ্ধ হয়ে থাকার ব্যবস্থা করা।
লাইন প্রথা কোন সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে প্রবর্তিত হয়নি। নওগাঁ জেলায় এ ব্যবস্থা প্রবর্তন করার পর স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দাঁড়ায় মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৪ শতাংশ। এর অব্যবহিত পরেই কামরূপ ও ডড়ং জেলায় এত ব্যাপক সংখ্যক জনগণ অভিবাসী হতে থাকে যে খুব দ্রুত একটা জনসংখ্যাতাত্ত্বিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। [উল্লেখ্য যে, উপনিবেশিক শাসনামলের পরবর্তী সময়ে এ জেলাসমূহকে একাধিক জেলায় রূপান্তরের জন্য ভেঙ্গে পৃথক করা হয়েছিল]। ১৯৩১ সালে আদমশুমারির বিবরণ ছিল আশঙ্কাজনক; ‘১৯২১ সালের মধ্যে উপদ্রবকারীদের (অভিবাসীদের এখানে উপদ্রবকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়) প্রথম দল গোয়ালপাড়া অধিকার করে। প্রথম দলের অনুসরণে দ্বিতীয় সৈন্য দল ১৯২১-৩১ সালের মধ্যে একই জেলায় তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করে এবং তারা নওগাঁও অধিকার সম্পূর্ণ করে। কামরূপের বরপেটা সাবডিভিশনও তাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি এবং সম্ভবত সেখানকার জেলা সমূহেই লাইন সিস্টেম প্রবর্তন করা হয়েছিল। দেখা গিয়েছে যে, অভিবাসীরা ডড়ং অঞ্চলের সংরক্ষিত বনাঞ্চল এবং পরিত্যক্ত জমিও বিনা বাধায় দখল করে নিচ্ছিল’। এভাবেই উপরোক্ত জেলাসমূহে লাইন সিস্টেম এর প্রবর্তন ও বহাল রাখার ফলে তা আসামের জন্য বিপদসংকেত হিসেবে দেখা দেয়।
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন প্রবর্তিত হলে নির্বাচনী রাজনীতির গতিপ্রবাহে কার্যকরী কর্মপরিষদের মাধ্যমে অভিবাসীদের পক্ষে রাজনৈতিক ভাবে ভূমিকা পালন করতে শুরু করে। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে আসামের ধুবড়ি (দক্ষিণ) নির্বাচনী এলাকা থেকে নির্বাচিত মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী অভিবাসীদের পক্ষে প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের পূর্ব পর্যন্ত এম এল এ হিসেবে মওলানা ভাসানীর এ ভূমিকা অব্যাহত ছিল।
সুরমা তীরবর্তী অঞ্চলের মুনওয়ার আলী ছিলেন অপর গুরুত্বপূর্ণ নেতা যিনি আসাম আইন সভায় লাইন সিস্টেম অবসানের জন্য একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করেন এ মর্মে যে, ‘‘অভিবাসীরা ঘন বনকে সবধরণের প্রাকৃতিক শস্য উপাদনের মাধ্যমে তাকে হাস্যোজ্জ্বল ধান ক্ষেতে পরিণত করেছে এবং আসাম প্রদেশে বয়ে এনেছে সমৃদ্ধি, স্বাস্থ্য ও সম্পদ।’’ মুসলিম লীগের আবদুল মতিন চৌধুরী এ প্রস্তাবকে সমর্থন করেন। তিনি লাইন সিস্টেমকে একটি ‘বর্ণাশ্রয়ী প্ররোচনা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন যা দেশের অন্য কোন অংশে দেখা যায়নি।
মওলানা ভাসানীর অবস্থান ছিল কিছুটা ব্যতিক্রম। কৃষক নেতা হিসেবে তিনি এ ইস্যুটিকে সামনে রেখে কৃষক সম্প্রদায়ের সব কয়টি শ্রেণিকে একতাবদ্ধ হতে আহবান জানান। তিনি বলেন, উন্নত কৃষি উৎপাদনের জন্য ধর্ম নির্বিশেষে সকল ভূমিহীন জনগণের কাছে জমি থাকা উচিত। কিন্তু রাজস্ব মন্ত্রী রোহিনী কুমার মজুমদার লাইন সিস্টেম পরীক্ষা করে দেখার জন্য একটি রাজস্ব কমিটি গঠন করার আশ্বাস দেয়ার পর মওলানা ভাসানীর প্রস্তাবটি প্রত্যার্পন করে নেয়া হয়। সংসদীয় সভায় এ ইস্যু নিয়ে বিতর্ক চলাকালে লাইন সিস্টেম ইস্যুকে সামনে রেখে অভিবাসীদের পক্ষের আইন সভার সভ্যদের এবং আসামের ভবিষ্যৎ অভিবাসী সংক্রান্ত রাজনৈতিক সম্পর্কের মধ্যে এক ধরণের একতা পরিলক্ষিত হয়।
আসাম আইন সভার সদস্যদের নিয়ে গঠিত নয় সদস্যের লাইন সিস্টেম কমিটি সমাজের সদস্যদের, সরকারি কর্মকর্তা এবং জন নেতাদের সাক্ষাৎকার ও পুনঃসাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। অভিবাসীদের প্রতিনিধি সৈয়দ আব্দুর রউফ দৃঢ়ভাবে লাইন সিস্টেম অবসানের আবেদন জানান; অথচ সাক্ষাৎকার প্রদানকারী সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতৃস্থানীয়গণ স্থানীয় জনগণকে ক্রমবর্ধমান বহিরাগতদের প্রভাব থেকে রক্ষার জন্য এ প্রথা বহাল রাখার পক্ষে রায় দেন। কমিটির সকলের সাধারণ মত ছিল যে, লাইন সিস্টেম ছিল অব্যবহূত এলাকাগুলিতে আগত অভিবাসীদের অপ্রতিরোধ্য প্রবাহকে রোধ করতে ও ধ্বংসকারী ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী জনসংখ্যা সংক্রান্ত নিয়ম প্রতিরোধের স্বার্থে একটি ক্ষণস্থায়ী পন্থা মাত্র। তাঁরা প্রস্তাব করেন যে, ‘এর পরবর্তী সময়ে থেকে এ প্রদেশে আগত কোন অভিবাসী স্থায়ী হতে পারবে না।’ লাইন সিস্টেম অবসানের পক্ষের অনুভূতি এবং কমিটির প্রদর্শিত যুক্তির প্রতিবাদে দু’টি ভিন্নমত সম্বলিত নোট প্রকাশ করা হয়, যাতে অভিবাসীদের ‘অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতিবেশী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তথাপি লাইন সিস্টেম বহাল থাকে এবং এ ব্যবস্থা আসামের বিভিন্ন অঞ্চলে বহিরাগত জনসংখ্যার অবিরাম প্রবাহকে ও তাদের স্থায়ী আবাসনের প্রক্রিয়াকে রোধ করতে পারেনি।
আসামের মুখ্যমন্ত্রী সাদউলাহ এবং কংগ্রেসের মন্ত্রীগণ লাইন সিস্টেমকে অব্যাহত রাখা বা অবসানের ব্যাপারে কোন প্রকার সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। কংগ্রেসের জোট মন্ত্রিসভা ১৯৩৯ সালের ৪ নভেম্বর নিষিদ্ধ অঞ্চলসমূহে, বিশেষ করে গ্রামের চারণভূমি এবং বনাঞ্চল থেকে অভিবাসী বসতি স্থাপনকারীদের উচ্ছেদের জন্য লাইন সিস্টেম সংক্রান্ত একটি নীতিমালা প্রকাশ করে। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যে, নীতিমালা কার্যকরভাবে প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোন বাস্তব পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। প্রকাশিত সরকারের নীতিমালা বিজ্ঞপ্তির জবাবে ১৯৩৯ সালের ১৮ নভেম্বর মওলানা ভাসানী আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের ঘাগমারী সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেই জিহাদের ডাক দেন।
১৯৪০ সালের ৩১ মে লাইন সিস্টেমের ওপর একটি কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। এ কনফারেন্সে স্থানীয় ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর প্রতিরক্ষার জন্য একটি ‘উন্নয়ন কর্মসূচি’ গ্রহণের সুপারিশ করা হয় এবং সাদউলাহ মন্ত্রিসভা তা গ্রহণ ও প্রয়োগ করে লাইন সিস্টেম বহাল রাখতে বাধ্য হয়। যদিও মওলানা ভাসানীর মতে এ সিদ্ধান্ত ছিল ‘লাইন সিস্টেমকে তাকের এক পাশে সরিয়ে রাখার আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতি’। যাই হোক এ পর্যায়ে এসে আসামের অ্যাডভোকেট জেনারেল পিসি দত্ত, মন্তব্য করেছেন যে, ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন দ্বারা লাইন সিস্টেম রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব ছিল না। যদিও এর ফলে মওলানা ভাসানী মুখ্যমন্ত্রী সাদউল্লাহর ‘আসাম ইউনাইটেড পার্টি’র সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করার সুযোগ লাভ করেন এবং লাইন সিস্টেম অবসানের জন্য তিনি তাঁর পূর্ববর্তী দাবির পুনর্ব্যক্ত করেন। ১৯৪১ সালের জানুয়ারি মাসের ৩০-৩১ তারিখে সিলেটের হবিগঞ্জে অনুষ্ঠিত আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্মেলনেই মওলানা ভাসানী এ প্রশ্নটি পুনরায় উত্থাপন করেন। তিনি লাইন সিস্টেম বলবৎ রাখার এবং ১৯৩৮ সালের পূর্বে যারা আসামে অভিবাসী হয়েছে তাদের বসতি স্থাপনে সহযোগিতা করার বিরুদ্ধে অবিরাম প্রচারণা শুরু করেন। ১৯৪২ সালের ২৫ আগস্ট মুখ্যমন্ত্রী সাদউল্লাহর মন্ত্রিসভা দ্বিতীয়বারের মত গঠিত হয়। এ মন্ত্রিসভায় অভিবাসী সংক্রান্ত বিষয়ের এবং লাইন সিস্টেম অবসানের পক্ষের অতি উৎসাহী সমর্থক মুনওয়ার আলী রাজস্ব মন্ত্রী হন। রাজনীতির এ নতুন ধারায় লাইন সিস্টেমকে ‘অধিক খাদ্য ফলাও’ শ্লোগানের চৌহদ্দির মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়। পরবর্তীতে দেশ বিভাগের দাবি, আসামের মন্ত্রিসভা গঠনে ও তা কার্যকর করণের ক্ষেত্রে অস্থিতিশীলতা প্রভৃতি কার্যত লাইন সিস্টেম বহাল রাখার পক্ষেই কাজ করেছিল। তবে তা পূর্ব বাংলা থেকে আসামে কৃষক সম্প্রদায়ের অভিবাসন প্রক্রিয়া প্রতিরোধ না করে বরং লাইন সিস্টেমকে প্রকৃত প্রস্তাবে অকার্যকর করে রেখে তা সম্ভব করা হয়েছিল। [আবু নসর সায়িদ আহমেদ]
আরও দেখুন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী।