র্যাডক্লিফ রোয়েদাদ
র্যাডক্লিফ রোয়েদাদ ১৯৪৭ সালের ৩ জুন বড়লাট লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারতবর্ষকে ইন্ডিয়া ও পাকিস্তান নামে দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্রে বিভক্ত করার যে সরকারি পরিকল্পনা ঘোষণা করেন তার পরিণতি বা ফলাফল। স্যার (পরে Viscount) সিরিল জন র্যাডক্লিফ (১৮৯৯-১৯৭৭) ১৯৩০-এর দশকের শেষ দিকে উচ্চ আদালতে আইন ব্যবসায় সুনাম অর্জন করেন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তথ্য মন্ত্রণালয়ে নিযুক্ত ছিলেন। যুদ্ধোত্তরকালে তাঁকে ভারতবর্ষে সীমান্ত চিহ্নিতকরণ কমিশনের প্রধান করা হয়। ভারত প্রশাসনে বা অনুরূপ বিরোধ মীমাংসায় তাঁর কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না, তবুও সীমান্ত চিহ্নিতকরণ কমিশনের সভাপতি হিসেবে র্যাডক্লিফের নিয়োগ বিশেষ কোন সমালোচনার ঝড় তোলে নি।
৩ জুনের পরিকল্পনা মতো বঙ্গীয় আইনসভা দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। প্রথম ভাগে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলার সদস্য ও অন্য ভাগে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলার সদস্যগণ অন্তর্ভুক্ত হন। সাময়িকভাবে বিভক্ত ইউনিটদ্বয় ২০ জুন বিভক্তিকরণ বিষয়ের ওপর ভোটা-ভুটির জন্য সমবেত হয়। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলার প্রতিনিধিগণ বিভক্তির পক্ষে এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলার প্রতিনিধিরা বিপক্ষে ভোট দেন। এই ভোটা-ভুটির মাধ্যমেই বাংলা বিভক্তির ক্ষেত্র প্রস্ত্তত হয়। এটি তাৎপর্যবহ যে এই ভোটের পরই পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে চূড়ান্ত সীমানা চিহ্নিত করার জন্য সীমান্ত কমিশন (Boundary Commission) গঠন করা হয়।
র্যাডক্লিফ তাঁর রোয়েদাদ চূড়ান্ত করার পর্যায়ে অনেক বাধা-বিপত্তি ও চাপের সম্মুখীন হন। উপমহাদেশে ব্রিটিশ নীতির বাধ্যবাধকতার কথা স্মরণ রেখে তাঁকে একাই সকল দিক সামলাতে হয়। পূর্ববঙ্গের ভূমি দলিল ও জরিপ (১৯৫১) থেকে দেখা যায় যে, বাংলা প্রদেশের ২৫৭৪৭৮ বর্গ কিমি এলাকা হতে নতুন সৃষ্ট পূর্ববঙ্গের ভাগে ১৩০৩৮৩.১৯ বর্গ কিমি এবং আসাম (সিলেট জেলার বৃহৎ অংশ) হতে আসে ১২৩৯৩.১৫ বর্গ কিমি। পূর্ববঙ্গের লোক সংখ্যা ছিল ৩৯.১১ মিলিয়ন এবং এর মধ্যে ১১.৪ মিলিয়ন ছিল হিন্দু। অপরপক্ষে পশ্চিমবঙ্গের ভাগে পড়ে প্রায় ৭২৫২০ বর্গ কিমি এবং লোক সংখ্যা ছিল ২১.১৯ মিলিয়ন, যার মধ্যে প্রায় ৫.৩ মিলিয়ন ছিল মুসলমান। প্রকৃতপক্ষে র্যাডক্লিফ কংগ্রেস দলের কতগুলি মৌলিক নীতি দ্বারা প্রভাবিত হন। এই নীতিগুলির প্রথমটি অনুসারে বাংলার মুসলমান ও অমুসলমান জনগোষ্ঠীর যতদূর সম্ভব বেশি অংশ যথাক্রমে সাম্প্রদায়িকভাবে বিভক্ত দুই অংশের অন্তর্ভুক্ত হয়। সীমানা কমিশন কংগ্রেসের দ্বিতীয় আর একটি যুক্তিও গ্রহণ করে। এই যুক্তি মতে এক অংশের মুসলিম ও অমুসলিম জনসংখ্যার আনুপাতিক হার অপর অংশের অমুসলিম ও মুসলিম জনসংখ্যার আনুপাতিক হারের যেন প্রায় সমান হয়। এভাবে র্যাডক্লিফ রোয়েদাদের মাধ্যমে যে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয় সেখানে সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আনুপাতিক হার প্রায় সমান দাঁড়ায়।
র্যাডক্লিফ কংগ্রেসের আরও কিছু পরামর্শ গ্রহণ করেছিলেন। কংগ্রেস দলের মতে মুর্শিদাবাদ ও নদীয়া জেলার নদীপ্রবাহ হুগলি নদীর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য অপরিহার্য ছিল। কংগ্রেসের এই যুক্তি তিনি সম্পূর্ণ মেনে নেন এবং সমগ্র মুর্শিদাবাদ জেলা পশ্চিমবঙ্গকে দেওয়া হয়। তিনি আরও সিদ্ধান্ত নেন যে, মাথাভাঙ্গা নদীর পশ্চিমের অংশ ব্যতীত খুলনা জেলা পূর্ববঙ্গের ভাগে পড়বে। একই সময়ে স্থির হয় যে বোদা, দেবীগঞ্জ ও পঞ্চগড় এলাকার পাঁচটি মুসলিম অধ্যুষিত থানা (পুলিশ স্টেশন) ব্যতীত চা উৎপাদনকারী জেলা দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি পশ্চিমবঙ্গের ভাগে পড়বে।
অবশ্য, মুসলিম লীগের পেশ করা যুক্তি র্যাডক্লিফ সম্পূর্ণভাবে বাতিল করে দেন নি। প্রকৃতপক্ষে সংলগ্ন হওয়ার কারণে রাজশাহীর বোয়ালিয়া এবং নদীয়ার একাংশ পূর্ববঙ্গকে দেওয়া হয়। এ সকল সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও সামগ্রিক বিচারে র্যাডক্লিফের কর্মকান্ডে কংগ্রেসের প্রস্তাবের প্রতিফলনই বেশি দেখা যায়।
র্যাডক্লিফ রোয়েদাদ হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকলের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে। মুর্শিদাবাদ ও নবদ্বীপের মুসলমানগণ পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে পড়ায় রুষ্ট হয়, আবার জলপাইগুড়ি জেলার দক্ষিণের পাঁচটি থানার হিন্দু অধিবাসিগণ পূর্ববঙ্গে পড়ায় হতাশা প্রকাশ করে। এরূপ অনিশ্চয়তার কারণে রোয়েদাদ অনেক বিতর্কের জন্ম দেয়। একইভাবে ভুল তথ্য রোয়েদাদ কার্যকর করাকে কঠিন করে তোলে। যথার্থভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে বাংলাকে বিভক্ত করা হলেও অত্যন্ত তাড়াহুড়োর মধ্যে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বিভক্ত করায় দুই-বাংলার সীমারেখা চূড়ান্তভাবে টানা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। [রাজশেখর বসু]
গ্রন্থপঞ্জি Submal Dutt, With Nehru in the Foreign Office, Calcutta, 1977; Jaya Chatterjee, 'The Fashioning of a Frontier: The Radcliffe Line and Bengal's Border Landscape, 1947-1952', Modern Asian Studies, Vol 33, Part 1, February 1999; Willem Van Schendel, The Bengal Borderland: Beyond State and Nation in South Asia, Anthem Press, London, 2005.