রাজ্জাক, আবদুর২
রাজ্জাক, আবদুর২ (১৯৩২-২০০৫) চিত্রশিল্পী, ভাস্কর, ছাপচিত্রকর, চারুকলার শিক্ষক। ১৯৩২ সালে শরীয়তপুর জেলার দিগরমহিষখালিতে আবদুর রাজ্জাক জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৪৮ সালে ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং একই বৎসর ঢাকায় সরকারি চারুকলা ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। তিনি ১৯৫৪ সালে চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অর্জন করে ডিপ্লোমা লাভ করেন। ১৯৫৫ সালে আবদুর রাজ্জাক আইওয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অধ্যয়নের জন্য ফুলব্রাইট বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে গমন করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি মাস্টার অব ফাইন আর্টস (এমএফএ) কোর্স সম্পন্ন করেন। বিদেশ থেকে চারুকলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনকারী বাংলাদেশিদের মধ্যে আবদুর রাজ্জাক প্রথম ব্যক্তি।
আমেরিকা থেকে ফেরার পর ১৯৫৮ সালে আবদুর রাজ্জাক সরকারি চারুকলা ইনস্টিটিউটে লেকচারার পদে যোগদান করেন। তাঁকে ভাস্কর্যকলা সম্পর্কিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের পরিবেশ সৃষ্টি করার গুরুদায়িত্ব পালন করতে হয়। এ জন্য তিনি ১৯৬৩ সালে ভাস্কর্য বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান হিসাবে কাজ শুরু করেন। উপরন্তু, তাঁকে বাংলাদেশ চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করতে হয়। এই সময়ে কলেজটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় চারুকলা ইন্সটিটিউটে রূপান্তরিত হয়। অবদুর রাজ্জাক ভাস্কর্য বিভাগকে গড়ে তোলার পাশাপাশি নিজস্ব চিত্রকর্ম সৃজনে ও ভাস্কর্য নির্মাণে মনোনিবেশ করেন। তিনি ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত চারুকলা ইনস্টিটিউটের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ছিলেন।
ঢাকা নগরী ও এর পরিবর্তনের বৈশিষ্ট্যসমূহকে উপজীব্য করে তিনি জল রং-এ অসংখ্য স্মরণীয় চিত্র সৃষ্টি করেছেন। শিক্ষার্থী থাকা অবস্থাতেই তিনি তেল রং মাধ্যমে দক্ষতার পরিচয় দেন। যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষা গ্রহণকালে তিনি ছাপচিত্র ও গ্রাফিক আর্ট সম্পর্কে অধ্যয়ন করেন। তিনি বিশেষত এচিং, ড্রাই-পয়েন্ট, আকোয়াটিন্ট, মেৎসৌটিন্ট এবং ইনগ্রেভিং-এর মতো বিভিন্ন খোদাই শিল্পকর্ম পদ্ধতির প্রতি অনুরক্ত হন। এ ছাড়া তিনি লিথোগ্রাফ ও উডকাটে যথাক্রমে ধাতু ও কাঠের খোদাইকর্ম থেকে নকশা তৈরিতে দক্ষতা অর্জনে সচেষ্ট ছিলেন। মিশ্র মাধ্যমও ছিল তাঁর বেশ প্রিয়।
তাঁর অঙ্কিত অধিকাংশ তৈলচিত্রের আকৃতি পরিমিত থেকে বৃহদাকারের। এর অঙ্কনশৈলীতে বিমূর্ত অভিব্যক্তিবাদের প্রাধান্য। তাঁর চিত্রকর্মে তৈল-এর স্বাভাবিক দীপ্তি ও উজ্জলতা দেখা যায়। সকল রং ছাপিয়ে প্রবলভাবে দেখা দেয় নীল ও সবুজ। এসব রংয়ের বহু-বৈচিত্রের মাত্রা যেমন প্রকৃতিতে উদ্ভাসিত তেমনি তাঁর ক্যানভাসেও তা প্রস্ফুটিত। এ দুটি রংয়ের রয়েছে প্রতীকী অর্থ- জীবন ও অপার শান্তির প্রতীক এ দুটি রং। অবশ্য তাঁর চিত্রে উজ্জ্বল রংয়ের ব্যবহারও লক্ষণীয়। তাঁর চিত্রকর্মে প্রকৃতি এবং পুষ্প-পত্র অথবা মেঘলা আকাশের মতো প্রাকৃতিক উপাদান থেকে আহরিত প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। আকাশের নীল এবং তুলোর মতো ধবল মেঘের উপস্থিতি রাজ্জাকের চিত্রকর্মকে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য দান করেছে।
১৯৭৫ থেকে ১৯৮৫ সালের মধ্যে বৃহদাকৃতির যে সকল চিত্রকর্ম তিনি সৃষ্টি করেছেন সেগুলিতে লাল, হলুদ, বাদামি, ধূসর ও মিশ্র রংয়ের প্রাধান্য ছিল। এই চিত্রগুলি রং-বিন্যাসভিত্তিক বিমূর্ত অভিব্যক্তিবাদী চিত্রকর্ম। তিনি তাঁর পেইন্টিং-এ সাধারণত বাস্তব চিত্রের প্রতিফলন পরিহার করতেন। বরং এর বদলে তিনি ক্রমশ রংয়ের পরিব্যাপ্তি ঘটিয়ে বিভিন্ন রূপে প্রকাশ ঘটাতে পছন্দ করতেন।
শিল্পী রাজ্জাক ভাস্কর্যকে একটি আধুনিক শিল্প মাধ্যম রূপে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর নেতৃত্বে এ বিষয়ে একটি সুচিন্তিত সম্পূর্ণ আধুনিক শিক্ষা কার্যক্রম বিকশিত হয় এবং একই সময়ে তিনি নিজেকে ভাস্কর্য শিল্প সৃষ্টিতে আত্মনিয়োগ করেন। স্বাধীনতা লাভের পরপরই বাংলাদেশ বিমান বাহিনী তাঁকে দশ ফুট উচ্চতার ‘শাহীন’ ভাস্কর্য নির্মাণের দায়িত্ব প্রদান করে। একই সময়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আমন্ত্রণে তিনি জয়দেবপুর চৌরাস্তার উন্মুক্ত চত্বরে সংস্থাপিত সুবিশাল ‘মুক্তিযোদ্ধা’ ভাস্কর্যটি সৃষ্টি করেন। কংক্রিটের তৈরি এই ভাস্কর্যে আঠারো ফুট দীর্ঘ এক মুক্তিযোদ্ধার মূর্তি চবিবশ ফুট উঁচু বেদির উপর স্থাপন করা হয়। ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’ নামে সুপরিচিত এই ভাস্কর্যটি একাত্তরের পঁচিশে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে বাঙালি সৈনিকদের বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধের স্মারক। এই স্মৃতিসৌধে একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধাকে এক হাতে রাইফেল এবং অন্য হাতে গ্রেনেড নিয়ে আগ্রাসী শত্রুদের মোকাবিলা করতে দেখা যায়। জনবহুল উন্মুক্ত স্থানে বিশাল মানবমূর্তি স্থাপন বাংলাদেশে ভাস্কর্যকলা মাধ্যমে একটি সম্পূর্ণ নতুন মাত্রা যুক্ত করে।
জয়দেবপুর এবং অন্যান্য সেনানিবাসে স্থাপিত রাজ্জাকের নির্মিত ভাস্কর্যগুলির ভিত্তি মূলত মানবমূর্তি। নিজের স্বাধীন শৈল্পিক সত্তার প্রেরণায় তিনি অনেক শুদ্ধ বিমূর্ত এবং অর্ধ-বিমূর্ত ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। তবে এগুলির মাধ্যমে উপাদান এবং আকৃতির ভিন্নতা ছিল। মাধ্যম হিসাবে তিনি সিমেন্ট, ইস্পাত, প্রস্তর, লৌহ, ব্রোঞ্জ ও কাঠের ব্যবহার করেছেন। তিনি ১৯৯০ সালে তৎকালীন বিধি অনুযায়ী ৬০ বছর বয়সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করে দুবছরের জন্য পুনঃনিয়োগ পান। পরবর্তীকালে তিনি আরো দুবছর এবং শেষ পর্যন্ত পঞ্চম বৎসরও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়ে স্বপদে দায়িত্ব পালন করেন।
চারুকলার ক্ষেত্রে সামগ্রিক সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৮৯ সালে আবদুর রাজ্জাক একুশে পদকে ভূষিত হন। একই বছরে তিনি বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদ পুরস্কারও লাভ করেন। ২০০৫ সালের ২৩ অক্টোবর যশোরে একটি চিত্রাঙ্কন কর্মশালায় কর্মরত অবস্থায় হূদরোগে আক্রান্ত হলে তাঁর জীবনাবসান ঘটে। [নজরুল ইসলাম]